রাজধানীর মিরপুরে আলিফ পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস থামিয়ে অস্ত্রধারীরা গুলি ছুড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। মারধর করে চালক ও তার সহকারীকে। শুক্রবারের গুলি ও অগ্নিসংযোগের এ ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে চাঁদাবাজি।
এর কয়েকদিন আগে পল্লবী বেনারসি পল্লির এক ব্যবসায়ীর কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। ওই ব্যবসায়ী চাঁদা দাবির অভিযোগে পল্লবী থানায় নাম উল্লেখ করে ছয়-সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এরপর আসামিরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ওই ব্যবসায়ী এবং তার পরিবারের জীবন এখন হুমকির মুখে। এ ছাড়া কথা হয় মিরপুরের হোপ মার্কেটের এক পর্দা ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তিনি বলেন, রাস্তার পাশে দোকান বসানোর জন্য আগে যে পরিমাণ চাঁদা দিতে হতো, এখন তার থেকে বেশি দিতে হয়। আগে যারা নিত তারা পলাতক। এখন আরেক পক্ষ এসে নিয়মিত চাঁদা নিয়ে যায়।
চাঁদাবাজির এমন চিত্র এখন সারা দেশের। ক্রমশ ভয়ংকর হয়ে উঠছে চাঁদাবাজরা। চাঁদা না দিলেই তারা গুলি করছে। চাঁদাবাজির এমন অভিযোগ উঠেছে রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, চাঁদা না দিলে নানা হুমকি দেওয়া হয়। কখনো কখনো গুলিও করা হয়। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশের নির্লিপ্ত ভূমিকার কারণেই চাঁদাবাজি ব্যাপক হারে বেড়েছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির অনেকেই চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, ঘুষ-বাণিজ্যসহ এ ধরনের প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। সাংগঠনিক ব্যবস্থার প্রভাব দৃশ্যমান নয়। কঠোর আইনগত ব্যবস্থা না নিলে রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে অপরাধ প্রবণতা বাড়বে। গতকাল নরসিংদীতে অটোরিকশা চালকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের সময় পুলিশ দুজনকে হাতেনাতে আটক করে। পরে হামলাকারীরা আটক হওয়া চাঁদাবাজদের ছিনিয়ে নিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আনোয়ার হোসেনকে মারধর করে। রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জিরো পয়েন্ট থেকে শুরু করে বায়তুল মোকাররমের সামনে দিয়ে চলে যাওয়া সড়ক এবং পীর ইয়েমেনি মার্কেটের সামনের সড়কের দুই পাশের ফুটপাতের পুরোটায়ই বিভিন্ন জামাকাপড়ের দোকান। জিরো পয়েন্ট থেকে গোলাপশাহ্? মাজার হয়ে তাঁতী বাজারের দিকে যেতেই রাস্তার দুই পাশ দখল করে বসেছে শত শত ভ্রাম্যমাণ দোকান। টি-শার্ট, প্যান্ট, শার্ট, বাচ্চাদের জামাকাপড়সহ নানা ধরনের পোশাক নিয়ে বসেছেন দোকানিরা। ফুটপাত দখল করে এসব দোকানগুলোতে ক্রেতার ভিড়ে ছোট-বড় যানবাহন তো দূরের কথা হেঁটে চলাও দায়। এ রাস্তার মাথায় গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নিচের অংশেও বসানো হয়েছে সারি সারি জুতার দোকান। এদিকে জিপিওর সামনে হয়ে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট দিয়ে গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশ দিয়েও রয়েছে বিভিন্ন পণ্যের দোকান। গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড থেকে পাতাল মার্কেটের পাশ দিয়ে যাওয়া ফুটপাতের ওপর ছাউনি দিয়ে দুই পাশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে দোকান। মানুষ চলাচলের ফুটপাতে তৈরি হওয়া এসব অস্থায়ী দোকান বছরের পর বছর ধরে রূপ নিয়েছে স্থায়ী দোকানে। এসব দোকানের মাঝ দিয়ে পা ফেলা তো দূরের কথা, মাথা সোজা করে হেঁটে যাওয়াও দুষ্কর। একই চিত্র দেখা যায় মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরে। এখানে ফায়ার সার্ভিসের সামনে দিয়ে যাওয়া সড়কের দুই পাশ মিরপুর-২ নম্বরে স্টেডিয়াম পর্যন্ত ফুটপাত দখল করে বসেছে শত শত অস্থায়ী দোকান। এসব দোকান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয়। মোহাম্মদপুরে শিয়া মসজিদ মোড় থেকে শ্যামলী মোড় পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে বসেছে বহু দোকান। স্থানীয় চাঁদাবাজ ও থানা পুলিশের সঙ্গে চুক্তি করেই দোকানিরা ব্যবসা করে থাকেন। পথচারীরা সেখানে অসহায়। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন নজরুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে জানান, তার কাছে চাঁদাবাজির ঘটনায় এ পর্যন্ত কত মামলা হয়েছে সেই সংখ্যাটি নেই। তবে চাঁদাবাজির অভিযোগ পেলেই তারা কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকেন। জানা যায়, গতকাল রাজধানীর উত্তরায় সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে চারজনকে আটক করেছে যৌথবাহিনী। দক্ষিণখানের আজমপুর রেলগেট-সংলগ্ন এলাকার একটি বহুতল ভবন থেকে তাদের আটক করা হয়। তারা হলেন- আসাদুর রহমান আকাশ (২৪), তার দুই সহযোগী ফরিদ উদ্দিন (২৬) এবং রবিন (২৫)। শুক্রবার রাতে চাঁদা না দেওয়ায় মিরপুরের সেনপাড়ায় আলিফ পরিবহনের একটি চলন্ত যাত্রীবাহী বাসে গুলি ও আগুন দেওয়ার ঘটনায় নেছার ও তার সহযোগী দীপুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সূত্র জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে শুধু ঢাকা মহানগর এলাকায় ৪১৯টি চাঁদাবাজির মামলা হয়েছে। এ সময়ে ৯ হাজার ৮৪৭টি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে ৭ হাজার ৮১২টি মামলার তদন্ত চলমান। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) আওতাধীন ৫০টি থানায় হওয়া এসব মামলা বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতি মাসে গড়ে ৭০টির বেশি চাঁদাবাজির মামলা হয়েছে। চাঁদাবাজির সবচেয়ে বেশি ৮৩টি মামলা হয়েছে মতিঝিল বিভাগে। এরপর তেজগাঁওয়ে ৭২টি। সবচেয়ে কম ৩৩টি লালবাগে। মামলাগুলোতে ১০ লাখ থেকে ৫ কোটি টাকার চাঁদা দাবির অভিযোগ করা হয়েছে।