এয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক (এআই) অপপ্রচার, গুজব মোকাবিলা এবং জনগণের আস্থা অর্জনই নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন গণমাধ্যমব্যক্তিরা। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের রিটানিং অফিসার করা; নির্বাচনে ডিসি, ওসিদের প্রভাব ঠেকানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা। গতকাল নির্বাচন ভবনের সম্মেলনকক্ষে সকালে ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও বিকালে প্রিন্ট, অনলাইন মিডিয়ার সম্পাদক, সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে সংলাপ করে নির্বাচন কমিশন। আজ মঙ্গলবার সংলাপ হবে নারী নেত্রী ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে।
সংলাপে সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) মেরুদণ্ড সোজা করে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করার পরামর্শ দেন গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা। সংলাপে কালো টাকার প্রভাব রোধ, তথ্যের অবাধ প্রবাহ, ইসি কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব প্রদান ও ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসির অধীন আনার মতো সুপারিশও এসেছে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘ভালো না হওয়ার’ কোনো সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। গতকাল বিকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপের শুরুতে তিনি এমন অভিমত তুলে ধরেন। সিইসি বলেন, ‘এই নির্বাচনটা কিন্তু দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেবে। নির্বাচন ভালো না হওয়ার কোনো সুযোগ জাতি হিসেবে আমাদের কাছে নেই। সুতরাং সবাই মিলে নির্বাচনটা করতে হবে। এটা একটা জাতীয় নির্বাচন এবং জাতীয়ভাবেই আমরা করতে চাই। নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে এককভাবে সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না।’
সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংলাপে চার নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ, তাহমিদা আহমদ, মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার ও আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ উপস্থিত ছিলেন।
নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেছেন, গত ১৬ বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বাচনকে খারাপ করার ভূমিকায় ছিল। এবার হয়তো শক্তিশালী অবস্থায় থাকবে না।
সংলাপে ওঠে আসা নানা মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় ইসির তত্ত্বাবধায়নে সব প্রার্থীকে এক মঞ্চে এনে তাদের নির্বাচনি এজেন্ডা তুলে ধরার ব্যবস্থা করব। একটা ট্রমার মধ্য দিয়ে কিছু কিছু বাহিনী গেছে। পাশাপাশি এর বাইরেও গত ১৬ বছরে সংস্কৃতির যে পরিবর্তন হয় তা তো আমরা রাতারাতি সংশোধন করতে পারি না। গত ১৬ বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হয়তোবা ছিল নির্বাচনে, কিন্তু তারা কোন ভূমিকায় ছিল? তারা তো নির্বাচনকে খারাপ করার কাজটা করেছে অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানে থেকে। এবার অতটা শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে না। কিন্তু নির্বাচন ভালো করার জন্য কাজ করবে। আমাদের যা যা সক্ষমতা আছে জাতীয়ভাবে, এমনকি আমরা স্কাউটকে কাজে লাগাতে পারি।’
ইসিকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ : দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক আবু তাহের বলেন, নির্বাচনের মৌসুমে কিছু কিছু গল্পকার দেখা যায় বিভিন্ন জেলায়। এই গল্পকাররা আমাদের শোনান আড়াই হাজার ভোট ৩৫ মিনিটে কাস্ট হয়ে গেছে। অথবা সারা দিন শুনলাম ৭ ভোটে আবু তাহের পিছিয়ে আছেন। অথচ সন্ধ্যায় ঘোষণা করা হয় তিন হাজার ভোটে আবু তাহের জয়লাভ করেছেন। এই রূপকথাগুলো কারা শোনান! দুই ধরনের ভদ্রসন্তান এই গল্প শোনান। একজন হলেন ওসি, আরেকজন ডিসি। এই দুই ধরনের ভদ্রসন্তান নিয়ে যেন ইসি সজাগ থাকে। তিনি বলেন, ‘সিইসির পক্ষে আল্লাহর কাছে অনুরোধ করব, হে আল্লাহ সিইসির হাতকে তুমি এমন শক্তিশালী করে দাও যেন ওই দুই ভদ্রসন্তানের টুঁটি চেপে ধরতে পারেন।’ দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি কবি হাসান হাফিজ বলেন, ‘প্রত্যেকটা নির্বাচনি এলাকায় আমরা যদি একটা কমিটি করি একদম ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত। রাজনৈতিক নেতা-কর্মী বাদ দিয়ে সামাজিক শক্তি যারা আছে পেশাজীবী ধরেন, একটা এলাকার গণ্যমান্য শিক্ষক যারা সবাই মুরুব্বি। যারা রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়। পেশাজীবী, ব্যবসায়ী ও তরুণদের নিয়ে একটা যদি আমরা কমিটি করি, সেই কমিটি সবকিছুর নজরদারি করবে। সবাইকে যদি এর সঙ্গে যুক্ত করতে পারেন তাহলে এটা একটা বড় কিছু হতে পারে।’
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু এসব কথা বলেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে নির্বাচনটা কীভাবে হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতাই ইসির ক্ষমতাকে নির্ধারণ করে। গত তিন টার্মে সেটাই হয়েছে। যে কারণে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি বা করতে পারেনি। দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, আগামী নির্বাচন যাতে কেউ বানচাল করতে না পারে, সেজন্য দৃঢ়তা দেখাতে হবে। সাংবাদিক নীতিমালা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। এটা দয়া করে সংশোধন করেন। গণমাধ্যমকে শত্রু হিসেবে না নিয়ে সহযোগী হিসেবে দেখেন।
দৈনিক আমার দেশের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ বলেন, ১২টি সংসদ নির্বাচনের মধ্যে গুটি কয়েক ছাড়া বাকি সব নির্বাচন বিতর্কিত ছিল। নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠু নির্বাচনের মেরুদণ্ড শক্ত করে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে।
নয়া দিগন্তের নির্বাহী সম্পাদক মাসুমুর রহমান খলিলী, ইসির প্রতি আস্থার জন্য সিইসি যে আশা ব্যক্ত করেছেন, এর জন্য সবচেয়ে বড় বিষয় যেটা প্রশাসনের মধ্যে নিরপেক্ষ আচরণের আবহ তৈরি করা দরকার। টাকার ছড়াছাড়ি বিষয়ে ইসি যদি নমুনা ব্যবস্থা নিতে পারে তাহলে মেসেজটা চলে যাবে।
খবরের কাগজের সম্পাদক মোস্তফা কামাল বলেন, ‘মবের রাজনীতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। সেই জায়গাটায় কোথায় বাধা। যারা বিগত তিনটা নির্বাচন করেছে, তারাই এবারও করবে। সেই আর্মি, সেই বিজিবি, সেই পুলিশ, সেই সাধারণ প্রশাসন। কাজেই সেই জায়গাটায় ইসির পক্ষ থেকে কঠিন বার্তা যেতে হবে।’
নির্বাচন কমিশন বিটের সাংবাদিকদের সংগঠন রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসির (আরএফইডি) সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বলেন, ইসি গণমাধ্যমকে বললেও অনেক সময় বৈষম্যমূলক আচরণ করেন। প্রশ্ন করলে ক্ষেপে যান, অনেক সময় ফ্যাসিস্টও আখ্যা দেন। পোস্টাল ব্যালট নিয়ে তিনি গণমাধ্যমকর্মী ও তার পরিবারকেও এর আওতায় আনার অনুরোধ জানান। একই সঙ্গে নিবন্ধিত অনেকগুলো দলকে সংলাপের বাইরের রাখার প্রশ্ন তুলে ভবিষ্যতে তাদের সভায় ডাকা হবে কি না, জানতে চান।
আরএফইডির সভাপতি কাজী এমাদ উদ্দীন (জেবেল) বলেন, যে মন্ত্রণালয়গুলো নির্বাচনের সঙ্গে বেশি সম্পৃক্ত সেগুলো যদি ভোটের সময় ইসির অধীনে রাখা যেত তাহলে নির্বাচন কমিশনের ভোট কনডাক্ট করা সহজ হতো। দৈনিক ইত্তেফাকের রাজনৈতিক ও নির্বাচনবিষয়ক সম্পাদক সাইদুর রহমান বলেন, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত করতে হবে।
সংলাপে আরও অংশ নেন ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দিন, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ, সংগ্রামের সম্পাদক আযম মীর শহীদুল আহসান, আজকের পত্রিকার সম্পাদক কামরুল ইসলাম, প্রতিদিনের বাংলাদেশের সম্পাদক মারুফ কামাল খান, ইউএনবির সম্পাদক মাহফুজুর রহমান, প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ, দ্য ডেইলি স্টারের হেড অব নিউজ জিয়াউল হক, ঢাকা মেইলের নির্বাহী সম্পাদক হারুন জামিল, দৈনিক আমাদের সময়ের নির্বাহী সম্পাদক এহসান মাহমুদ, যায়যায়দিনের যুগ্ম সম্পাদক মো. মাহমুদুজ্জামান, বাংলাবাজার পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক রাশেদুল হক ও খবর সংযোগের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক শেখ নজরুল ইসলাম, সারাবাংলাডট নেটের হেড অব নিউজ গোলাম সামদানী।
দ্বিতীয় ভাগে অংশ নেন প্রিন্ট ও অনলাইনের সম্পাদক ও সাংবাদিকরা। এতে অংশ নেন দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দিন, দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ, দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক আযম মীর শহীদুল আহসান, ঢাকা মেইলের নির্বাহী সম্পাদক হারুন জামিল, বাংলাবাজার পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক রাশেদুল হক, দৈনিক খবর সংযোগের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক শেখ নজরুল ইসলাম, আজকের পত্রিকার সম্পাদক কামরুল ইসলাম, সারাবাংলাডট নেটের হেড অব নিউজ গোলাম সামদানী, বাংলাদেশ বেতারের পরিচালক মো. বশির উদ্দিন, যায়যায়দিনের যুগ্ম সম্পাদক মো. মাহমুদুজ্জামান, প্রতিদিনের বাংলাদেশের সম্পাদক মারুফ কামাল খান, ইউএনবির বার্তা সম্পাদক মাহফুজুর রহমান।