ই-কমার্স বাণিজ্যে প্রতারণা ঠেকাতে নতুন একটি আইন করতে যাচ্ছে সরকার, যে আইনে গ্রাহকের দায়দেনা পরিশোধের জন্য ডিজিটাল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ দেওয়ার বিধান যুক্ত করা হচ্ছে। খসড়া আইনে বলা হয়েছে, কোনো ডিজিটাল বাণিজ্যি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হলে এবং প্রতিষ্ঠানটির দায়দেনা থাকলে, কর্তৃপক্ষ সরকারের অনুমতি নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করতে পারবে।
ডিজিটাল বাণিজ্য কর্তৃপক্ষ আইন-২০২৫-এর খসড়ায় এ বিধান রাখা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আইনের খসড়াটি করছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ব্যাপকভাবে ডিজিটাল বাণিজ্যে রূপান্তর হচ্ছে। পাশাপাশি এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতারণার পরিমাণও বাড়ছে। অনলাইন বাণিজ্যে শৃঙ্খলা আনতেই আইনটি করা হচ্ছে। বাংলাদেশে বাণিজ্যরত দেশি-বিদেশি সব অনলাইন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ওপর আইনটি কার্যকর হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২১ সালে ইভ্যালি, ইঅরেঞ্জ, কিউকম, আলীবাবার মতো কয়েকটি কোম্পানি গ্রাহকদের প্রতারিত করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর বিগত আওয়ামী লীগ সরকার এ বিষয়ে একটি আইন করার উদ্যোগ নেয়। আইনের খসড়া মতামতের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়। তবে ওই সময় ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে লবিং করে প্রক্রিয়াটি থামিয়ে দেয়। এখন অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে আইনটি করার উদ্যোগ নিয়েছে।
যা করবেন তত্ত্বাবধায়ক : আইন অনুযায়ী কোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক বসালে তার মেয়াদ হবে এক বছর। তবে সরকারের অনুমতিসাপেক্ষে এ মেয়াদ বাড়ানো যাবে। তত্ত্বাবধায়ক সংশ্লিষ্ট ডিজিটাল প্রতিষ্ঠানের দায়দেনা নিরুপণ করার পাশাপাশি স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির বিবরণ তৈরি করবেন। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দায়দেনা পরিশোধ করবেন; প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করবেন, তবে নতুন সম্পদ, ক্রয়বিক্রয়, হস্তান্তর, আহরণ এবং নতুন কর্মী নিয়োগ দিতে পারবেন না।
অনলাইন ব্যবসা পরিচালনায় পৃথক কর্তৃপক্ষ : খসড়া পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রস্তাবিত আইনের মাধ্যমে একটি কর্তৃপক্ষ গঠিত হবে। এর নাম হবে ডিজিটাল বাণিজ্য কর্তৃপক্ষ। এটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করবে। একজন নির্বাহী চেয়ারম্যান ও চারজন সদস্য নিয়ে এ কর্তৃপক্ষ গঠিত হবে। এদের নিয়োগ দেবে সরকার। আর এই কর্তৃপক্ষই সরকারের অনুমতি নিয়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক বসাবে।
নিবন্ধন ছাড়া অনলাইন ব্যবসা নয় : অনলাইনে অথবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পণ্য বা সেবা বিক্রি করা সব প্রতিষ্ঠানকে এই কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নিবন্ধন নিতে হবে। নিবন্ধন ব্যতীত কোনো ওয়েবসাইট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পেজ খোলা হলে বিটিআরসির মাধ্যমে ওই ওয়েবসাইট বা পেজ বন্ধ করে দিতে পারবে কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে নিবন্ধন ব্যতীত ব্যবসা পরিচালনার জন্য ২৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, নিবন্ধন নেওয়ার পর সাইটে বা পেজে ওই নিবন্ধন নম্বর প্রদর্শন না করলেও পেজ বা সাইট বন্ধ করাসহ জরিমানা করতে পারবে কর্তৃপক্ষ। গ্রাহকের অভিযোগ গ্রহণ ও বিরোধ নিষ্পত্তিও করবে; অসত্য তথ্য বা বিজ্ঞাপন দিয়ে অনলাইনে পণ্য বেচাকেনার বিষয়সহ অনলাইন বাণিজ্যের যাবতীয় বিষয় মনিটরিং করবে কর্তৃপক্ষ।
জুয়া, লটারি, মিথ্য তথ্যে শাস্তি জরিমানা : খসড়া আইনে বিভিন্ন ধরনের অপরাধে বিভিন্ন শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে। অনলাইন মার্কেট প্লেসে লটারির আয়োজন করলে দুই বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড দেওয়া যাবে। দেশের আইনে নিষিদ্ধ পণ্য বিক্রির জন্য অনলাইনে বিজ্ঞপ্তি, অনলাইনে জুয়া বা বেটিংয়ের আয়োজন করলে বা সহায়তা করলে তা জামিন অযোগ্য অপরাধ হবে। এ অপরাধের জন্য তিন বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। আইনের ধারা অনুযায়ী মিথ্যা তথ্য দিয়ে পণ্য বা সেবা বিক্রির উদ্যোগ নিলে তা জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং অনলাইন বিক্রেতাকে দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা ১০ লাখ টাকা অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। নির্ধারিত সময়ে গ্রাহককে বিক্রিত পণ্য বা সেবা সরবরাহ করা না হলে গ্রাহককে পণ্যমূল্যের তিন গুণ অর্থ ফেরত দিতে হবে, অনাদায়ে তিন মাসের কারদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া পেমেন্ট গেটওয়েতে অর্থ যাওয়ার পরও গ্রাহক পণ্য না পাওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের পেমেন্ট গেটওয়ের হিসাব বা ব্যাংক হিসাব ছয় মাসের জন্য স্থগিত; নিষিদ্ধ পণ্য বা সেবা বিক্রির জন্য প্রদর্শন করলে ৩ লাখ টাকা জরিমানা আরোপ ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ; অসত্য বা অতিরঞ্জিত বিজ্ঞাপন দিয়ে পণ্য বিক্রি করা হলে ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা; বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনবিহীন ব্যাংক বা অন্য কোনো মাধ্যমে লেনদেন করলে এক বছর কারাদণ্ড বা ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।