বৃহস্পতিবার, ৯ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

উচ্চতর আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার : সমস্যা ও সমাধান

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

উচ্চতর আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার : সমস্যা ও সমাধান
আমাদের দেশে যে ক’জন নামি ও সত্যিকার অর্থেই বড় আইনজীবী আছেন এঁদের কেউ কোনো আরজি, জবাব বা প্রতিউত্তর বা সম্পূরক শপথনামা বাংলা ভাষায় লিখেছেন তা আমার চোখে পড়েনি। সম্ভবত ইংরেজি ভাষায় আইনশাস্ত্র অধ্যয়নের কারণেই এমন মানসিকতা

কভিড-১৯ এর ভয়াল থাবায় সারা পৃথিবী আজ স্থবির। গতিহীন হয়ে পড়েছে সবকিছু। বাংলাদেশেও চলছে সাধারণ ছুটি। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া শহর-গ্রামের প্রত্যেক নাগরিককেই সামাজিক দূরত্ব মেনে নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করতে অনুরোধ জানিয়েছে সরকার। স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতেই এই নির্দেশনা। গত ১৫ মার্চ থেকে সুপ্রিম কোর্টে গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলছিল, তার সঙ্গে করোনাভাইরাস-জনিত কারণে এই ছুটি প্রলম্বিত হয়। সারা দিন বাসায় বন্দী। ভাবলাম উচ্চতর আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের ওপর একটি প্রবন্ধ লিখব। প্রবন্ধটি সম্ভবত ভাষার মাস ফেব্র“য়ারিতে লিখলেই ভালো হতো। যা হোক, ঘরে বসে ছুটি কাটানোর ফাঁকে আমার ভাবনাপ্রসূত লেখা প্রবন্ধটি আইন ও বিচার সংশ্লিষ্ট সবার কাছে পাঠযোগ্য হবে বলে আশা করছি। 

বছর পাঁচেক আগের কথা। ২০১৫ সালের কোনো এক দিন, সঠিক তারিখটি আজ মনে পড়ছে না। আমি কলকাতা হাই কোর্টের অতিথিশালা সল্টলেকে অবস্থিত ‘বিজন ভবন’ থেকে সকালে বেরোচ্ছি। এমন সময় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ। তার পরনে ছিল হালকা রংয়ের স্যুট, কপালে ছিল চন্দনের তিলক। দেখে বুঝতে পারিনি যে তিনি কোন সম্প্রদায় ও ভাষার মানুষ। জানতাম, কলকাতা হাই কোর্টে পশ্চিম বাংলার বাইরেরও অনেক বিচারপতির পোস্টিং হয়। স্বাভাবিক সৌজন্যতায় আমি তাঁকে সালাম জানিয়ে ইংরেজিতে আমার পরিচয় দিলাম। আমি ঢাকা থেকে এসেছি শুনে ভদ্রলোক আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন- ‘আরে মশাই বাংলায় কন, আমরা দুজনেই তো বাঙালি’। তাঁর এ ধরনের ঢাকাই ভঙ্গিমায় কথা শুনে আমি হতবাক। ভাবলাম তাঁর পূর্বপুরুষ নিশ্চিত ঢাকার বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর কাছ থেকেই জানলাম, তিনি পশ্চিম বাংলার বীরভূমের আদি বাসিন্দা। তিনি বিচারপতি শুভ্রকমল মুখার্জি। সময়ের আবর্তে তিনি আমার একজন অত্যন্ত প্রিয় মানুষ হয়ে ওঠেন। এখন তিনি আমার এক প্রিয় দাদা। ২০১৫ এর পরে কলকাতায় তাঁর সঙ্গে আমার বহুবার দেখা হয়েছে। তাঁর বাড়িতে গিয়েছি  বেশ ক’বার। ২০১৬ সালের ফেব্র“য়ারি থেকে ২০১৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত তিনি ছিলেন কর্নাটক হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি। কর্নাটকের রাজধানী ব্যাঙ্গালোরেও তাঁর বাংলোয় আমাকে সপরিবারে নিমন্ত্রণ করেছেন। 

খুব প্রাণখোলা মানুষ এই বিচারপতি শুভ্রকমল মুখার্জি। আরেক দিন বিজন ভবনের নিচে গাড়ি রাখার পার্কিং থেকে আমি গাড়িতে উঠব। ঠিক তখনই তিনি কোর্ট থেকে ফিরে গাড়ি থেকে নামছেন। এ সময় তাঁর পিছু পিছু আরেকটি পতাকাবাহী গাড়ি এসে বিজন ভবনের নিচে থামল। ওই গাড়ি থেকে একজন মহিলা বিচারপতি নামলেন। তাঁর নাম বিচারপতি নিশিতা নির্মল মাহত্রী। মাহত্রী দেবীকে ডেকে বিচারপতি শুভ্র বাবু বলছিলেন - Madam, look, I am talking with a foreign Judge in my own language. ভদ্রমহিলা পুরোপুরি বুঝে ওঠার আগেই বিচারপতি শুভ্রকমল তাঁর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন- আমরা দু’জনই বাঙালি, আমাদের দেশ ভিন্ন কিন্তু আমাদের ভাষা এক। বিচারপতি নিশিতা মাহত্রী পরবর্তীতে কলকাতা হাই কোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন বেশ কিছুদিন। সে দিন অনুভব করেছিলাম নিজের ভাষার কাউকে কাছে পেলে মনটা উচ্ছ্বাসে গর্বে কতটা পূর্ণ হয়ে ওঠে। আমার সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো বাংলা আমার মাতৃভাষা। আমি একজন বাঙালি। বিচারিক অঙ্গনে নিজের ভাবনা জ্ঞান যুক্তি এই ভাষায় তুলে ধরার মানসিকতা ও দক্ষতা নিয়ে কিছু কথা ও প্রেক্ষাপট তুলে ধরার চেষ্টা করছি। 

পৃথিবীতে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। বাংলাদেশে প্রায় ১৮ কোটি, পশ্চিম বাংলায় নয় কোটি আর ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম ও ভারতের আরও কিছু রাজ্যসহ ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানকারী বাঙালিদের সংখ্যাও প্রায় তিন কোটি। পৃথিবীতে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর অবস্থান পঞ্চম। ২০১৭ সালের UNESCO এর এক জরিপ  অনুযায়ী পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা হলো বাংলা। ভাষাটি যে খুবই মিষ্টি এটি উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী লতা মুঙ্গেশকর ও আশা ভোঁসলের গান শুনলেই বোঝা যায়। তাঁদের দুই বোনের কেউই বাংলা বলতে পারেন না। অথচ ইংরেজি অক্ষরে লিখে বা হিন্দি অক্ষরে লিখে যখন অত্যন্ত শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলায় রচিত গানে তাঁরা কণ্ঠ দেন তখন কোন বাঙালির তা ভালো না লাগে? কার না মনে হয় তার জীবনেও একবার না একবার প্রেম এসেছিল। এ যেন বাংলা ভাষায় অঙ্কিত প্রেম যা হৃদয়কে দোলায়।

বাংলা একটি ঐতিহ্যবাহী পুরনো ভাষা। অন্তত আজ থেকে এক হাজার বছর আগে থেকে এ ভূখন্ডে বাংলা ভাষার প্রচলন। কিন্তু আধুনিক বাংলার প্রচলন শুরু হয় বোধ করি ১৮০০ ইং সালের পর থেকে। বিশ্বসভায় বাংলাকে উঁচু স্থানে পৌঁছে দেওয়ার পেছনে আমাদের অনেক কবি লেখক সাহিত্যিকের অবদান রয়েছে। তাঁদের সবার অবদানই সম্মান ও স্বীকৃতির দাবি রাখে। তবে একই সঙ্গে এ কথা সবাই আমরা স্বীকার করব যে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। ১৯১০ সালের আগস্ট মাসে কবিগুরুর গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয়। বছর দুয়েক পরে ১৯১২ সালের নভে¤¦র মাসে তাঁর ১০৩টি পদ্য নিয়ে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয় ‘গীতাঞ্জলি’। বাংলা গীতাঞ্জলির ইংরেজিতে ভাষান্তর করেছিলেন কবিগুরু নিজেই। ১৯১৩ সালে বাঙালি অর্জন করে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। কবিগুরু নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হলেন তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’ কবিতা গ্রন্থের জন্য।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর অবিভক্ত বাংলার মানুষ আমরা হয়ে গেলাম পাকিস্তানি। একটি নবসৃষ্ট মুসলিম রাষ্ট্রের অধিবাসী। আমাদের বাংলাদেশের  ভূ-খ- একদিন পরিচিত ছিল পূর্ববঙ্গ হিসেবে। দেশ বিভাগের পর তা হয়ে গেল পূর্ব পাকিস্তান। শুরু থেকেই আমরা বাংলাভাষীরা হতে থাকি সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণ ও বৈষম্যের শিকার। আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ওপর নেমে আসতে থাকে পাকিস্তানি আঘাত। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় রেসকোর্স ময়দান, বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এক জনসভায় ঘোষণা করেন যে ‘উর্দু এবং শুধু উর্দুই হবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা’। অন্য কোনো ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পাবে না। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক বিশেষ সমাবর্তন সভায় জিন্নাহ আবারও ঘোষণা দেন যে, কেবল মাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এমন ঘোষণায় তদানীন্তন ছাত্র নেতা শেখ মুজিবসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে গর্জে ওঠে এবং ওই সভাতেই তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনকের সামনেই ‘না না’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত করে তোলে সভাস্থল। 

ওই প্রতিবাদের রেশ থেমে থাকেনি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারির ঘটনা আমার সবাই জানি। এটি এখন আমাদের ইতিহাসের গর্বিত অংশ। রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকাসহ সারা বাংলার রাজপথ প্রকম্পিত করে দাবি জানানো হলো-‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’। সে দিনের বাঙালির এই প্রাণের দাবিকে পদদলিত করার জন্য পাকিস্তান সরকারের অনুগত পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনের নির্দেশে ঢাকায় ছাত্র-জনতার ওপর চালানো হয় গুলি। প্রিয় মাতৃভাষার জন্য শাহাদাত বরণ করেন রফিক, সালাম, বরকতসহ অনেকে। শহীদদের তালিকায় ঠাঁই করে নেন তদানীন্তন ঢাকা হাই কোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমান। ১৯৫৬ সালে তৎকালীন সরকার বাংলাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যতম ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু ১৯৫৬ সালের যে সংবিধান পাকিস্তান গণপরিষদে গৃহীত হয় সেখানে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে কোনো ভাষারই উল্লেখ করা হয়নি। অথচ পাকিস্তান এবং ভারত একই সময়ে পৃথক দুটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা পেলেও ভারতের গণপরিষদ তাদের সংবিধান রচনা করে ১৯৪৯ সালেই। ভারতীয় সংবিধানের ৩৪৩(১) অনুচ্ছেদে ভারত রাষ্ট্রের দাফতরিক ভাষা হিসেবে হিন্দিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় যা দেব নাগরী হরফে লিখিত হবে। ভারতের এই সংবিধানের ৩৪৩(২) অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা আছে যে, উপ-অনুচ্ছেদ (১) এ যা কিছু বলা থাকুক না কেন সংবিধান রচনার সময় হতে ১৫ বছর সময় পর্যন্ত ইংরেজি ভাষায় সমস্ত দাফতরিক কাজ সম্পন্ন হবে। উপ-অনুচ্ছেদ ৩(এ) এ উল্লেখ করা আছে যে, ভারতের সংসদ আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে প্রয়োজনে ১৫ বছর পরও দাফতরিক ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে ব্যবহার করতে পারবে। ভারতীয় সংবিধানের মর্মার্থ অনুযায়ী এটা বোঝা যায় যে, তারা হিন্দি ভাষাকে দাফতরিক ভাষা হিসাবে প্রচলনের একটি চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। 

ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৪৫ অনুযায়ী প্রত্যেকটি রাজ্যের বিধানসভা ওই রাজ্যের দাফতরিক ভাষা কী হবে তা নির্ধারণ করতে পারবে, তবে শর্ত থাকে যে, এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত ইংরেজিই তাদের দাফতরিক ভাষা হিসেবে গণ্য হবে। ভারতের সংবিধানের ৩৪৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের দাফতরিক ভাষাই রাজ্যসমূহের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হবে। তবে শর্ত থাকে যে, যদি একাধিক রাজ্য হিন্দি ভাষাকে তাদের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে চায় তাহলে উভয় রাজ্যের বিধানসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সে ধরনের আইন বা উপ-আইন প্রণয়ন করতে পারবে। ভারতীয় সংবিধানের ৩৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ও বিভিন্ন রাজ্যে অবস্থিত হাই কোর্টসমূহের কার্যক্রম বিশেষত রায়সমূহ ইংরেজিতে প্রদান করতে হবে। সংসদে অথবা বিধান সভায় সমস্ত বিল বা সংশোধনী ইংরেজি ভাষায় উত্থাপিত হবে। এক কথায় বলা যায়, ভারতীয় উচ্চ আদালত, সংসদ, রাজ্যসভা ও বিধানসভার কার্যক্রমের ভাষা ইংরেজি। 

১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিকাংশ আসনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। এই নির্বাচনের ভিত্তিতে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতার ভার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের ওপর ন্যস্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার দৃশ্যমান অনীহার কারণে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালিরা এক দফা তথা স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্বাধিকারকামী বাঙালি জনগোষ্ঠীকে অবদমিত করার নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২৫ মার্চ ১৯৭১ ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন গণহত্যায় মেতে ওঠে ঠিক সেই সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এ ঘোষণাটি বঙ্গবন্ধু ইংরেজিতে দিয়েছিলেন। ঘোষণাটি ছিল নিম্নরূপ :“This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh where ever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go and until the soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved”.   সম্ভবত বৈশ্বিক দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বঙ্গবন্ধু এই ঘোষণাটি ইংরেজিতে দিয়েছিলেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। এরপর ১০ এপ্রিল ১৯৭১ মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রও (the Proclamation of Independence)  ইংরেজিতে  প্রণীত হয়। মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর Laws Continuance Enforcement Order জারি করা হয় ইংরেজিতেই। পরবর্তীতে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল বাঙালি তার বহুল আকাক্সিক্ষত স্বাধীনতার চূড়ান্ত রূপ অবলোকন করে। প্রিয় স্বদেশ শত্র“মুক্ত হয় এই দিনে। বাঙালি জাতি অধীর আগ্রহে ও উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করতে থাকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির আশায়। 

অবশেষে আসে সেই প্রত্যাশিত দিন। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু প্রিয় স্বদেশ বাংলার মাটিতে ফিরে আসেন বীরের বেশে। এ দিন জাতি যেন স্বাধীনতার পূর্ণতা অনুভব করে। পর দিন ১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু জারি করেন সাময়িক সংবিধান আদেশ বা Provisional Constitution of Bangladesh Order 1972. দেশের সংবিধান আসার পূর্ব পর্যন্ত এই আদেশটিই ছিল বাংলাদেশের ‘সাময়িক সংবিধান’। এই আদেশটিও জারি করা হয়েছিল ইংরেজি ভাষায়। পূর্বেই উল্লেখ করেছি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এবং স্বাধীনতা উত্তর সময়ে তাদের সামনে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরার লক্ষ্যেই এই দলিলগুলো ইংরেজিতে প্রণয়ন করা প্রয়োজন ছিল। 

১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়। এই সংবিধানের ৩ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে ‘রাষ্ট্রের ভাষা’ হবে বাংলা। সংবিধানের ১৫৩ নং অনুচ্ছেদের ২ দফায় বলা আছে, ‘বাংলায় এই সংবিধানের একটি নির্ভরযোগ্য পাঠ ও ইংরেজিতে অনূদিত একটি নির্ভরযোগ্য অনুমোদিত পাঠ থাকিবে। উভয় পাঠ নির্ভরযোগ্য বলিয়া গণপরিষদের স্পিকার সার্টিফিকেট প্রদান করিবেন। ১৫৩(৩) অনুচ্ছেদের ৩ দফায় উল্লেখ করা হয়েছে, এই অনুচ্ছেদের ২ দফা অনুযায়ী সার্টিফিকেট যুক্ত কোনো পাঠ এই সংবিধানের বিধানাবলীর চূড়ান্ত প্রমাণ বলিয়া গণ্য হইবে। তবে শর্ত থাকে যে, বাংলা ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাইবে, উপরে উল্লেখিত সাংবিধানিক বিধানাবলী থেকে এটি স্পষ্ট যে, ‘রাষ্ট্রের ভাষা’ হলো ‘বাংলা’। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত বিধানাবলীর মধ্যে সংঘর্ষের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার বিধানাবলীকে আমাদের সংবিধান প্রাধান্য দিয়েছে। কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে, ভারতের সংবিধান ভারত রাষ্ট্রের জন্য কোনো একটি নির্দিষ্ট ভাষাকে রাষ্ট্রের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। এর কারণ ভারত একটি বহু ভাষার দেশ। রাষ্ট্রীয়ভাবে ভারত ২২টি ভাষাকে তাদের দেশের প্রচলিত ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদের বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ভাষার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। সে জন্য তারা সচেতনভাবে উচ্চতর আদালত, সংসদ, রাজ্যসভা ও বিধানসভার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ইংরেজি ভাষাকেই বেছে নিয়েছে।

পূর্বেই উল্লেখ করেছি ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানের সংবিধানে কোনো ভাষাকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তখন পাকিস্তানও একটি বহু ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র ছিল। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এককভাবে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন সত্য। কিন্তু তিনি তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। অন্তত এর কোনো প্রতিফলন ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পরিলক্ষিত হয় না। আমরা বাংলাদেশের বাঙালিরা এখনো অনেক ক্ষেত্রেই দ্বিধান্বিত হই যে, কোন ভাষা আমরা আমাদের কার্যক্ষেত্রে ব্যবহার করব। তবে সুখের বিষয়, একমাত্র বৈদেশিক যোগাযোগ ছাড়া সব সরকারি আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের দাফতরিক কাজের জন্য বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করে আসছে অনেক দিন যাবৎই। শুধু ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয় উচ্চতর আদালতের কার্যক্রমে। 

নিম্ন আদালতের চর্চিত ভাষা প্রধানত বাংলা। যদিও কোনো বিচারক ইংরেজি ভাষায় রায় দিলে তা বাতিল হয়ে যাবে না। উচ্চতর আদালতে দীর্ঘদিন যাবৎ সব কার্যক্রমে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা বিচার বিভাগের একটি প্রথায় পরিণত হয়েছে। ইংরেজি ভাষায় লেখা রায়টি পুনঃলিখন বা অনুবাদের ব্যবস্থা এখন নেই। কেননা উচ্চতর আদালতের রায়ের মাধ্যমে এটিকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অনেক সময় আমার মনে হয়েছে, উচ্চ আদালতে ইংরেজিতে লেখা রায়ের ফলাফল ঠিক রেখে এর পুনঃলিখন বা ভাষান্তর করাটা জনস্বার্থেই জরুরি। 

ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে দুই ধরনের মানসিকতা লক্ষণীয়। একটি হচ্ছে কেউ মনে করেন বাংলা না বলে ইংরেজি বললে বোধ হয় তাকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান, দক্ষ এবং চটপটে মনে হবে (ঝসধৎঃ এর বাংলা শব্দ ব্যবহার করা হলে)। আরেকটি মানসিকতা হলো ইংরেজিকে বিজাতীয় ভাষা মনে করে একে তুচ্ছ জ্ঞান করা। দুটোর কোনোটিই কাম্য নয়। বাংলা ভাষার ওপর দখল কম থাকার কারণে ইংরেজি ভাষার ওপর নির্ভরশীল হয়ে উচ্চতর আদালতের বিচারকগণ কার্যক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষাতেই কাজ করে থাকেন। আরেকটি মুখ্য কারণ ইংরেজি ভাষায় প্রয়োজনীয় আইনের বইয়ের সহজপ্রাপ্যতা।

উচ্চতর আদালতে (হাই কোর্ট) আশির দশকের শেষ দিকে যখন আইন পেশা শুরু করি তখন আদালতের ভিতর কোনো পক্ষের হয়ে বক্তব্য রাখার সময় মুখ ফসকে বাংলা বেরিয়ে গেলে বিচারপতিগণ সেটা পছন্দ করতেন না। এখন এই অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। উচ্চতর আদালতের উভয় বিভাগে আইনজীবীগণ বাংলায় তাঁদের বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারেন। এখানে লক্ষণীয় যে, আইনজীবীগণ আদালতে বাংলায় বক্তব্য উপস্থাপন করেন ঠিকই কিন্তু তাঁদের শতকরা ৯৮ জনই আরজি, জবাব বা প্রতিউত্তর লিখেন ইংরেজিতে। একটি আরজিতে (আরজি শব্দটি সম্ভবত বাংলা নয়) মামলার ঘটনার বিবরণ দেওয়া থাকে, কী কারণে তার মামলাটি রক্ষণীয় হবে বা কী কারণে তিনি বা তাঁর মক্কেল মামলায় প্রতিকার প্রাপ্তির অধিকার রাখে সে  বিষয়ে যুক্তিও লিখেন ইংরেজিতে। বিচারক যখন রায় দেন তখন আরজি, জবাব বা প্রতিউত্তর থেকে ঘটনা তথা মামলা উদ্ভবের কারণ সংক্ষিপ্ত আকারে গ্রহণ করে তা রায়ে উল্লেখ করেন। যদি আইনজীবীগণ আরজি বা জবাব বাংলায় লিখতেন তাহলে বিচারকের জন্যও রায় বাংলায় লেখা অনেক সহজ হতো। দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশে যে ক’জন নামি ও সত্যিকার অর্থেই বড় আইনজীবী আছেন এঁদের কেউ কোনো আরজি, জবাব বা প্রতিউত্তর বা সম্পূরক শপথনামা বাংলা ভাষায় লিখেছেন তা আমার চোখে পড়েনি। সম্ভবত ইংরেজি ভাষায় আইনশাস্ত্র অধ্যয়নের কারণেই এমন মানসিকতা। আমি নিজে মূলত অর্থনীতির ছাত্র ছিলাম। আইন পাস করেছি ধানমন্ডি আইন মহাবিদ্যালয় থেকে। কোনোমতে পাস করার জন্য যার বই পড়ার দরকার ছিল, তাই পড়েছি। বইয়ের লেখকের নামটি উচ্চারণ করলাম না। আইনের যে বইগুলো পড়েছি সেগুলো কোনো মৌলিক গ্রন্থ নয়, এগুলো নোট বই। (Note Book) Note এর বাংলা প্রতি শব্দটি ততটা প্রচলিত নয় বিধায় তা বুঝতে অসুবিধা হবে বলে ইংরেজি শব্দটিই ব্যবহার করলাম।

বিচারক হওয়ার আগে আমার আইন পেশায় যতটুকুই প্রসার হয়েছিল বা পরবর্তীতে বিচারক জীবনে বিজ্ঞ আইনজীবীদের মূল্যায়নে যদি সামান্যতম সফলতার স্বাক্ষর রেখে থাকি তবে তা হয়েছে আইনজীবী থাকাকালে লেখাপড়া করা ও ভালো আইনজীবীদের সান্নিধ্যে থাকার সুবাদে। দুই বছরে অতি সাধারণ মানের নোট বই পড়ে অর্জিত জ্ঞানে সীমাবদ্ধ থাকলে এখন আর বিচারক হিসেবে কাজ চালাতে পারতাম না। পেশা জীবনে যা পড়েছি তা সবই পড়েছি ইংরেজিতে। আমাদের দেশের বড় আইনজীবীগণ আদালতে বাইরের দেশের যে সব উচ্চ আদালতের নজির উত্থাপন করেন তার সবই ইংরেজি ভাষায় প্রদত্ত রায় থেকে। প্রধানত ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ডের আদালতের নজিরই বেশি উত্থাপিত হয় আমাদের আদালতসমূহে। মাঝে মধ্যে সিঙ্গাপুর, আমেরিকার আদালতের নজিরও আমাদের সমানে উপস্থাপন করেন বিজ্ঞ আইনজীবীগণ। এসব নজিরের সবই ইংরেজিতে লেখা। বাংলা ভাষার ওপর তেমন দখল না থাকলে এই নজিরগুলো বাংলায় ভাষান্তর করতে গেলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। 

বাংলাদেশে স্বাক্ষরতার হার শতকরা ৭২-এর কিছু বেশি। এদের মধ্যে মান সম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা কত তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তাই উচ্চতর আদালতের রায় বাংলায় প্রদান করলে শতকরা ৭২ জন লোকই যে পড়তে পারবে সেটি বলা যায় না। এক বিরাট জনগোষ্ঠীকে তাই এমনকি বাংলায় লেখা রায়ের মর্মার্থ বুঝতে হলে শিক্ষিত একজনের সাহায্য নিতে হবে। আর ইংরেজিতে রায় দিলে তা পড়ে এর মর্মার্থ হৃদয়ঙ্গম করার মতো মানুষের সংখ্যা শতকরা কুড়ি জনের বেশি হবে বলে মনে হয় না। কিছুদিন আগে দৈনিক প্রথম আলোতে সাংবাদিক মহিউদ্দীন ফারুকের একটি লেখা বেরিয়েছিল। সমীক্ষাধর্মী লেখা। আদালতে বাংলায় রায় দেওয়ার ওপর লেখাটি অনেকের মতো আমারও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। লেখাটিতে বেশ কয়েকজন বিচারপতির নাম তিনি উল্লেখ করেছেন যারা কিছু কিছু রায় বাংলায় দিয়েছেন। সে তালিকায় আমার নামও রয়েছে। তবে বাংলায় রায় প্রদানের সংখ্যার দিক থেকে আমার অবস্থান খুব ভালো নয়। আমি বিনয়ের সঙ্গে আমার এ দুর্বলতা মেনে নিচ্ছি। তবে ফারুক যদি প্রদত্ত রায় ও আদেশের সংখ্যা পৃথক পৃথকভাবে দেখাতেন তবে ভালো হতো। উচ্চ আদালতের দেওয়া আদেশের পরিধি দুই-তিন বাক্যে বা এক স্তবকে, বা দেড় স্তবকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু রায়ে অনেক প্রাসঙ্গিক আইনি প্রশ্নে সিদ্ধান্ত দিতে গিয়ে লিখতে হয় অনেক কিছু। ঘটনার বিবরণ, উভয় পক্ষের বক্তব্য, যুক্তিসমূহ এবং সর্বোপরি বিচারকের নিজস্ব মতামত, পর্যবেক্ষণ ও সবশেষে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। তাই কোনো আদেশের চেয়ে একটি রায়ের পরিধি অনেক বিস্তৃৃত। 

উচ্চতর আদালতের বার্ষিক কর্ম দিবস হলো ১৮০ থেকে ১৮৫ দিন। এর মধ্যে কেউ ছুটি নিতে পারেন বা অসুস্থ হতে পারেন। ১০ বছরে এই কর্মদিবসের সংখ্যা আঠারশত থেকে আঠারশত পঞ্চাশ দিন। কোনো বিচারক প্রতিদিন যদি একটি করে রায় দেন তবে ১০ বছরে তার প্রদত্ত রায়ের সংখ্যা আঠারশত বা আঠারশত পঞ্চাশ এর বেশি হবে না। তবে গড়ে প্রতিদিন একজন বিচারকের পক্ষে একটি করে রায় লেখা খুবই দুরূহ। পক্ষান্তরে প্রতিদিন আদেশ দেওয়া যেতে পারে ভুরি ভুরি। দেওয়াও হয়ে থাকে তাই। 

লক্ষ্য করেছি যে, আমাদের বিচারাঙ্গনে একটি প্রশ্ন প্রায়ই ঘুরে-ফিরে আসে। আমরা কী চাই? মানসম্মত রায়, না কি শুধু বাংলায় লেখা রায়? আমাকে উত্তর দিতে বললে আমি বলব দুটিই চাই। কারণ বাংলা ভাষায় যেমন রায় দেওয়া প্রয়োজন ঠিক তেমনই প্রয়োজন উচ্চ মানসম্মত রায় দেওয়া। বাংলা ভাষায় কি মানসম্মত রায় দেওয়া যায় না? নিশ্চয়ই যায়। সাবেক মাননীয় প্রধান বিচারপতি জনাব এ বি এম খায়রুল হকের বাংলায় লেখা বেশ কিছু রায় অত্যন্ত মানসম্মত। আমাদের যেসব মাননীয় বিচারক এখন বাংলায় রায় লিখছেন তাঁরা অবশ্যই একটি মহৎ কাজ করছেন। বাংলায় লেখা তাঁদের অনেক রায়ই হয়তো বেশ মানসম¥ত। তবে এটি অস্বীকার করা যাবে না যে, এখনো অধিকাংশ মানসম্মত রায় ইংরেজি ভাষাতেই প্রদান করা হচ্ছে। আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, রায়ের মান খারাপ হলে তা ইংরেজিতেই হোক আর বাংলাতেই হোক এর সমালোচনা শুনতেই হয়। 

আমাদের ভুললে চলবে না যে, কোথাও লেখা থাকুক আর নাই থাকুক দীর্ঘ অনুশীলন ও ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ইংরেজি কিন্তু আমাদের কর্মক্ষেত্রে দ্বিতীয় ভাষার স্থান করে নিয়েছে। কারণ আমরা দেখছি যে, আমাদের দৈনন্দিন বিচারিক কর্মযজ্ঞে ইংরেজির যে ব্যবহার তার পরিধি কম নয়। আমাদের সরকার কর্তৃক প্রকাশিত আইন বইয়ের সংকলন (Bangladesh Code)-এর ৪২ খন্ডের মধ্যে এখনো ২৫ খ- ইংরেজিতে লেখা। আমাদের এই আইন পেশার প্রধান চারটি বই ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড ১৮৯৮, পেনাল কোড ১৮৬০, সিভিল প্রসিডিওর কোড ১৯০৮ ও এভিডেন্স অ্যাক্ট ১৮৭২। এই চারটি আইনের কোনোটিই সরকারিভাবে বঙ্গানুবাদ করা হয়নি। ব্যক্তি উদ্যোগে কেউ কেউ করেছেন কিন্তু সেগুলো নির্ভরযোগ্য নয়। বিচারিক কার্যক্রমে পক্ষগণ কর্তৃক উপস্থাপিত বিশ্বের যেসব দেশের নজির আমরা পর্যালোচনা করি সেগুলোও ইংরেজি ভাষার। ইংরেজি ভাষা না জানা অনেক দেশের বিচার ব্যবস্থাও অনেক উন্নত। ফরাসি বিচার ব্যবস্থা, জার্মান বিচার ব্যবস্থাসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত অনেক দেশের বিচার ব্যবস্থা বেশ উন্নত। কিন্তু যেহেতু, তাদের নিজস্ব ভাষায় আমাদের বিচারকদের বা আইনজীবীদের কোনো বু্যুৎপত্তি নেই তাই আমরা সে দেশগুলোর বিচারের কোনো নজির আদালতে উত্থাপিত হতে দেখি না।

আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের মানসম্মত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে শিক্ষকবৃন্দ পাঠদান করেন তাঁরা প্রায় সবাই বিদেশের নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি মাধ্যমে লোখাপড়া করে এসে ও উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এসে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকতা পেশায় নিবেদিত থাকেন। তাঁদের অর্জিত নিজস্ব শিক্ষার একটি প্রভাব ছাত্রদের ওপর পড়বেই। আমাদের দেশে দেশীয় শিক্ষাপদ্ধতির পাশাপাশি ইংরেজি মাধ্যমেও লেখাপড়া করা যায়। এতে সরকারি কোনো বিধিনিষেধ নেই। আমাদের যেসব ছেলেমেয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা করে বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে ¯œাতক, ¯œাতকোত্তর, ডক্টরেট বা ব্যারিস্টারি সনদ নিয়ে আসছে তাঁদের বিষয়টিও মাথায় রাখা প্রয়োজন। তাঁদের অধিকাংশই চায় দেশে এসে আইনপেশা শুরু করতে। আমরা যদি এখনই আদালত পাড়া থেকে ইংরেজিকে বিতাড়িত করি তবে এদের ভবিষ্যৎ কী হবে? কষ্ট করে হয়তো কেউ কেউ টিকে যাবে তবে অধিকাংশই বিদেশে পাড়ি জমাবে। এটি অবশ্যই দেশের জন্য খুব একটা কল্যাণ বয়ে আনবে না। সার্বিক মেধায় একটা বৈকল্য সৃষ্টি হবে।

মাননীয় বিচারপতি জনাব খায়রুল হক প্রদত্ত কিছু রায় যেমন, স্বাধীনতার ঘোষক সংক্রান্ত রায় বা নদীর উপর দেওয়া তাঁর রায় বাংলায় প্রদান করা হয়েছে। এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রায়। বাংলা ভাষাতেই তিনি এ রায়গুলো লিখেন। এ ছাড়া বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর বিচারিক জীবনে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছেন যেগুলো ইংরেজিতে লেখা। 

আমাদের বিচার ব্যবস্থায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং উচ্চ মানসম্পন্ন রায়গুলোর মধ্যে জাকির আহমেদ বনাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রায়টি অন্যতম। এ রায়টি মুদ্রিত হয় ১৬ ডি. এল.আর (হাই কোর্ট), পৃষ্ঠা ৩৬১-তে। এ মামলায় হেরে যাওয়ার পর এর বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তদানীন্তন পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। আপিল আদালতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হেরে যায়। এই রায়ে Principle of Natural Justice বা Audi Alteram Partem বা বাংলায় বলা যায় ন্যায় বিচারে আত্মপক্ষ সমর্থনের মৌলিক নীতি প্রতিষ্ঠিত হয় (১৬ ডি.এল.আর (সুপ্রিম কোর্ট) পৃষ্ঠা ৭২২)। নিঃসন্দেহে এই আইনি নীতি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আমাদের এ অঞ্চলে কর্তৃপক্ষীয় স্বেচ্ছাচারিতার সম্পূর্ণ অবসান না হলেও তার লাগাম টেনে ধরা গেছে। 

আমাদের জাতীয় জীবনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ রায় হলো অষ্টম সংশোধনীর রায়। এ রায়টিতে সংখ্যাধিক্য বিচারকের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়। মাননীয় বিচারপতি জনাব বদরুল হায়দার চৌধুরী, মাননীয় বিচারপতি জনাব শাহাবুদ্দিন আহমদ, মাননীয় বিচারপতি জনাব এম. এইচ রহমান ও মাননীয় বিচারপতি জনাব এ টি এম আফজাল এই মামলার বিচারক ছিলেন। মাননীয় বিচারপতি জনাব এ টি এম আফজাল সতীর্থ  তিনজন বিচারকের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে পৃথক রায় প্রদান করেন। আমাদের বিচার ব্যবস্থার একটি অন্যতম নীতিসমৃদ্ধ রায় হলো এই রায়। ইংরেজিতে লেখা এই রায়ে শুধু হাই কোর্ট বিভাগের বিভাজনকে বেআইনি বলা হয়েছে তা নয়। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বহু বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। এ রায়টি নিঃসন্দেহে একটি অনন্য রায়। আমার এই কথাগুলো বলার অর্থ হলো, আমরা সব সময়ই উচ্চ আদালত থেকে অত্যন্ত মানসম্পন্ন রায়ই আশা করি। 

[এবার অফিস আদালতে বাংলায় কাজ করার ব্যাপারে যে নির্দেশনাগুলো আছে সেগুলোর ওপর আলোকপাত করা যাক। বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে আমাদের সংবিধান। অনুচ্ছেদ ৩ অনুযায়ী বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা’। বাংলাদেশ গণপরিষদ ১৯৭২ সালের ৪ নভে¤¦র এই সংবিধান প্রণয়ন করে। যা ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর কার্যকর হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৭০ এর ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের পর ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-

‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পন্ডিতেরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তার পরে বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদেরা যত খুশি গবেষণা করুন, আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব, সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে’। (সূত্র : সরকারি কাজে বাংলা ব্যবহারে প্রশাসনিক নির্দেশনা পৃষ্ঠা-১৩, মো. মোস্তফা শাওন)। 

১৯৭১ সালের ১৬ ফেব্র“য়ারি সংবাদে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘সরকারি ভাষা হবে বাংলা (Official Language will be Bengali)’ (সূত্র : সরকারি কাজে বাংলা ব্যবহারে প্রশাসনিক পৃষ্ঠা-১৪ মো. মোস্তফা শাওন)।

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রমের অর্ধিকাংশই চলেছে ইংরেজি ভাষায়। এর একটি যুক্তিগ্রাহ্য করণ অবশ্যই আছে। মুজিননগর সরকার পরিচালিত হয়েছে কলকাতার ৮, থিয়েটার রোড থেকে। ভারতের সরকারি কাজে ব্যবহৃত ভাষা হচ্ছে ইংরেজি তাই সে দেশের সরকারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে কাজ করতে গিয়ে মুজিবনগর সরকারকে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতে হয়। ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্র“মুক্ত হলে বাঙালিরা চূড়ান্তভাবে নিজেদের একটি স্বাধীন ভূখ- অর্জন করে। মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যগণ ২২ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছান। ২৩ ডিসেম্বর বঙ্গভবনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে স্বাধীন দেশে মুজিবনগর সরকারের প্রথম কেবিনেট সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় অনেক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল বাংলা হবে সরকারি ভাষা বা দাফতরিক ভাষা। সেদিনকার সেই প্রথম কেবিনেট সভার কার্যবিবরণীও বাংলায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। (সূত্র : Hundred years of Bangabhaban            পৃষ্ঠা-৬৯, প্রেস উইং বঙ্গভবন)। 

এরপর বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে বাংলাকে সরকারি কাজ-কর্মে ব্যবহার করার নির্দেশনা দেন। ৮ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২ পত্রিকায় এই মর্মে সংবাদ প্রচারিত হয়েছিল যে, ‘তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী বলেছেন, ‘জীবনের সর্বস্তরে বাংলা চালুর প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে।’ ১৯৭২ সালের ১৯ মে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ‘দ্য বাংলা একাডেমি অর্ডার’ ১৯৭২ জারি করেন। এই আদেশ বলে ‘কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড’ বাংলা একাডেমির সঙ্গে সমন্বিত হয় এবং কাউন্সিলের নাম পরিবর্তন করে ‘কার্যনির্বাহী পরিষদ’ করা হয়। বাংলা একাডেমির প্রধান নির্বাহী হিসেবে মহাপরিচালক পদ সৃষ্টি করা হয়। ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি অফিস আদালতে ব্যবহার ও অনুশীলনের জন্য পরিভাষার একটি ছোট কোষ প্রকাশ করে। ১৯৭৩ সালের ১৪ ফেব্র“য়ারি রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মাতৃভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য দ্রুততর কার্যক্রম গ্রহণ এবং সুচিন্তিত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলেন। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ করে বিজ্ঞান ও কারিগরি বিষয়গুলোতে পরিভাষার উপযুক্ত সমস্যা ও এর সমাধানের জন্য শিক্ষক ও ভাষাতাত্ত্বিকদের আহ্বান জানিয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি বাংলা একাডেমি ‘প্রশাসনিক পরিভাষা’ প্রকাশ করে। (সূত্র : সরকারি কাজে বাংলা ব্যবহারে প্রশাসনিক নির্দেশনা, মো. মোস্তফা শাওন-১৪-১৫)।

১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাক্ষরিত একটি কঠোর নির্দেশ জারি হয়- 

‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, স্বাধীনতার তিন বৎসর পরেও অধিকাংশ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই দেশের প্রতি যে তার ভালোবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। দীর্ঘ তিন বৎসর অপেক্ষার পরেও বাংলাদেশের বাঙালি কর্মচারীরা ইংরেজি ভাষায় নথিতে লিখবেন এটা অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর এ উচ্ছৃঙ্খলা চলতে দেওয়া যেতে পারে না। এ আদেশ জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সকল সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও আধা-সরকারি অফিসসমূহে কেবল বাংলার মাধ্যমে নথিপত্র ও চিঠিপত্র লেখা হবে। এ বিষয়ে কোনো অন্যথা হলে উক্ত বিধি লঙ্ঘনকারীকে আইননানুগ শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। বিভিন্ন অফিস-আদালতের কর্তাব্যক্তিগণ সতর্কতার সঙ্গে এ আদেশ কার্যকর করবেন। তবে বিদেশি সংস্থা বা সরকারের সঙ্গে পত্র যোগাযোগ করার সময় বাংলার সঙ্গে ইংরেজি অথবা সংশ্লিষ্ট ভাষায় একটি প্রতিলিপি পাঠানো প্রয়োজন। তেমনিভাবে কোনো সরকার বা সংস্থার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের সময়ও বাংলার সঙ্গে অনুমোদিত ইংরেজি বা সংশ্লিষ্ট ভাষার প্রতিলিপি ব্যবহার করা চলবে। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।’ (সূত্র : সরকারি কাজে বাংলা ব্যবহারে প্রশাসনিক নির্দেশনা, মো. মোস্তফা শাওন ১৪-১৫)। 

বঙ্গবন্ধু তাঁর এই দৃঢ় নির্দেশনাতে দুইবার অফিস-আদালত শব্দ দুটি একসঙ্গে ব্যবহার করেছেন; তাঁর কথার ব্যাখ্যা করার ধৃষ্টতা আমার নেই। তবুও বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই তাঁর প্রদত্ত ব্যাখ্যা করা অংশটুকু পড়লে বোঝা যায় তিনি কার্যালয় বা দফতরে ব্যবহারের ভাষার কথা বলেছেন। কেননা তাঁর এ নির্দেশে অফিস-আদালত একসঙ্গে উল্লেখ করলেও কোথাও তিনি বলেননি যে এখন থেকে বিচারকরাও এ নির্দেশ পালন করবেন। বরং লেখা আছে, ‘বাঙালি কর্মচারীরা’ এবং অফিস-আদালতের ‘কর্তাব্যক্তিগণ’। অফিস-আদালত শব্দগুচ্ছ বঙ্গবন্ধু ব্যবহার করেছেন হয়তোবা কথার একটি প্রচলিত ভঙ্গিমা হিসেবে।

১৯৭৫ এর ২৩ অক্টোবর একটি আদেশপত্রে বলা হয়,-

‘বাংলা রাষ্ট্রভাষা। পূর্বেই আদেশ দেওয়া হয়েছে যে, সরকারি নথি এবং চিঠিপত্র বাংলায় লেখা হবে। এই আদেশ দেওয়া সত্ত্বেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, কোনো কোনো সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং আধা-সরকারি দফতরসমূহে এখন পর্যন্ত ইংরেজিতে নথি এবং চিঠিপত্র লেখা হচ্ছে।  ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের এই প্রবণতা অনভিপ্রেত। অতএব পুনরায় এই মর্মে নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে যে, সকল সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং আধা-সরকারি দফতরে বাংলায় নথি ও চিঠিপত্র লেখা হবে। বিদেশের কোনো সরকার বা সংস্থার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনে বাংলার সঙ্গে অনুমোদিত ইংরেজি বা সংশ্লিষ্ট ভাষায় প্রতিলিপি ব্যবহার চলবে। তবে কোনো বিদেশি সরকার বা সংস্থার সঙ্গে পত্র যোগাযোগ ইংরেজিতে করা যাবে।’ 

বহুবার অনেক আদেশ নির্দেশ জারির মাধ্যমে সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের তাগিদ দিয়ে অনেক পরিপত্র সরকারি কার্যালয়গুলোতে পাঠানো হয়েছে। তবে অবাক হই যখন দেখি যে, সরকারি কার্যালয়গুলোতে বাংলা ব্যবহারের জন্য ১৯৭৯ এর ১২ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে যে আদেশটি জারি হয় সেটি ছিল ইংরেজি ভাষায়। আদেশটি ছিল নিম্নরূপ :

Ò(a) the Bengali language is an integral part of our nationalism and was a key element in our struggle for independence. The failure to use and apply the language at all levels of national life is a sad commentary in our declared intentions and sincerity. All work and files concerning the cabinet and ministries may be conducted in Bengali from now onwards. Report on command over the mother tongue should be made a part of the ACR of each officer. 

(b) Stress should laid on preparing the coming generation from there very elementary school-level for application and use of Bengali in all activities of life and living. A responsible committee may be formed to ensure preparation of text books in simple and lucid Bengali, rather than the difficult language in which many school text books have been written. Imposing the use of the language from the top will not bear fruit unless adequate preparation is made at the base level. 

(c) The report of the national Education committee is being awaited pending receipt of which no further committee should be set up. A number of steps have been taken to expand the use of Bengali in practical life. Instructions at college and university level are being given usually in Bengali and the students have an option to appear in the exemption in English also. In the armed services and police, the word of command has been changed into Bengali. The PSC may conduct the examination in Bengali which will influence the university and the officers to adopt wider use of Bengali. The departmental examinations and the in-service training programmers of Govt, employees may also be conducted in Bengali. With sincerity of purpose, it will not be difficult to use Bengali at all official levels. The language itself will develop and grow in quality with practice. The language must rid itself of the grip of the ‘pundits’ and must reach for the people. That is why it can be made simple effective and progressive.” (সূত্র : ঐ-পৃষ্ঠা-১৬-১৭) [পরবর্তী অংশ আগামী শনিবারের সংখ্যায়]

            লেখক : সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর