৪ মার্চ, ২০২৩ ১০:১০

টাকা তুমি...

অনলাইন ডেস্ক

টাকা তুমি...

‘টাকা’ অথবা নিজস্ব নোট স্বাধীন রাষ্ট্রের সার্বভৌম এখতিয়ারের প্রতীক। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে কাগজি মুদ্রার (টাকা বা টঙ্ক) প্রচলন শুরু হয় ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ। প্রথম কাগজি মুদ্রার প্রচলনের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে তৃতীয়বারের মতো ‘টাকা দিবস’ পালিত হবে আজ।

মুদ্রা প্রচলনের আগে মানুষ লেনদেন করত বিনিময় প্রথায়। কোনো একটি পণ্যকে একক হিসেবে গণ্য করে পণ্যের সঙ্গে পণ্য বিনিময় করা হতো। ওই পণ্যটিই ‘মুদ্রা’র কাজ করত। কালক্রমে এ ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়। তখন মানুষ ‘কড়ি’র মাধ্যমে বিনিময় করত। তখন ‘গদ’ নারায়ণের যুগ।

ক্রমে ধাতব পদার্থ বিনিময়ের মাধ্যম হয়ে ওঠে। প্রচলন শুরু হয় তামা, লোহা বা রুপার মুদ্রা। এর ধারাবাহিকতায় একসময় স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন হয়। এরপর স্বর্ণমুদ্রা থেকে কাগজি মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। ‘মুদ্রা’ প্রচলনের যুগটিই ‘নগদ’ নারায়ণের যুগ। এখনো মানুষ নগদ নারায়ণেই আছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রযুক্তির বিকাশের (বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির) ‘নির্ব্যক্ত-নিরুক্ত’ চাপে বা প্রভাবে আগামী দশকে কাগুজে বা বহনযোগ্য মুদ্রার প্রয়োজনীতা কমবে। টাকা ছাপানোর খরচও কমে আসবে।

তথ্য-সাবুদ বলে, প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে মিসরে বিনিময়প্রথার প্রচলন ছিল। আর পুরাণ-ব্যাকরণ বলে, এ প্রথার শুরু হয়েছিল ভারতে। প্রজাপতি বেণের সময়ে বিনিময়প্রথার শুরু। যা-ই হোক, নথিবদ্ধ তথ্যে গুরুত্ব দিয়ে বলতে হয়, বিনিময়ের জন্যই ‘একক’ পণ্যের ব্যবহার শুরু। মানবসমাজ অনেক কিছুই মুদ্রা বা টঙ্ক (টাকা) হিসেবে ব্যবহার করেছে। লবণ, কফি বিন, শস্যদানা, গরু ও হাঙরের দাঁত, মূল্যবান পাথর প্রভৃতি। আর ভারত উপমহাদেশে (বাংলাদেশসহ) চল ছিল কড়ির।

খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ বা পঞ্চম অব্দে তুরস্কের এশিয়া মহাদেশীয় অংশে (এশিয়া মাইনর) লিদিয়া অঞ্চলে প্রথম মুদ্রার চল তৈরি হয়। লিদীয়দের মুদ্রা প্রচলনের কাছাকাছি সময়ে প্রাচীন ভারতে ‘মুদ্রা’র প্রচলন হয়। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে সুমেরীয়রা বার্লি বিক্রির জন্য প্রথম ধাতব মুদ্রা ব্যবহার করে।

ধাতব মুদ্রার পথ ধরেই আসে কাগুজে মুদ্রা। কাগুজে মুদ্রা বা নোটের প্রচলন শুরু হয় চীনে; তাঙ রাজবংশের রাজত্বকালে (৬১৮-৯০৭ খ্রিষ্টাব্দ)। ১৬৯০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস বে কলোনিতে কাগজের নোটের প্রস্তাব করা হয়। ১৭৬০ সালে প্রথম ডলার ছাপানো হয় এবং তা সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়।

আজকের যে অর্থব্যবস্থা তাতে স্বর্ণ-রৌপ্যের ভূমিকা সরাসরি তেমন নেই। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক পর্যন্ত মুদ্রাব্যবস্থায় কাগজের মুদ্রার সঙ্গে স্বর্ণের সরাসরি যোগসূত্র ছিল। বিশে^র উন্নত দেশগুলোর আস্থা ছিল স্বর্ণ বা স্বর্ণমানের ওপর। মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে ও মুদ্রামান নির্ণয়ে স্বর্ণ হয়ে ওঠে নিয়ামক।

বাংলাদেশে টাকার প্রচলন
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্থান করে নেয়। স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্বের অন্যতম প্রতীক হলো নিজস্ব মুদ্রা। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রচলন করে নিজস্ব ব্যাংক নোট। ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ বাংলাদেশের ১ টাকা ও ১০০ টাকার ব্যাংক নোট চালু হয়।

আগে এ দেশে পাকিস্তানের ব্যাংক নোট চলত; মুদ্রার নাম ছিল রুপি। বাংলাদেশের মুদ্রার নাম রাখা হয় টাকা। টঙ্ক কথা থেকে এর উদ্ভব। ৪ মার্চ ১৯৭২ প্রকাশিত দুটি ব্যাংক নোট ভারতের সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে ছাপানো হয়। ১ টাকার নকশায় বাংলাদেশের মানচিত্র ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কথাটি স্থান পায় এবং তাতে স্বাক্ষর করেছিলেন তখনকার অর্থসচিব কে এ জামান। আর ১০০ টাকার নকশায় দেখা যায় বাংলাদেশের মানচিত্র এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি এবং তাতে লেখা বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নোটটিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম গভর্নর এ এন হামিদ উল্ল্যাহ্র স্বাক্ষর ছিল। এখন বাংলাদেশে ১, ২, ৫, ১০, ২০, ৫০, ১০০, ২০০, ৫০০ এবং ১০০০ টাকা মূল্যমানের কাগুজে নোট রয়েছে। পাশাপাশি ১, ২ এবং ৫ টাকা মূল্যমানের ধাতব মুদ্রাও আছে। আগে ১, ৫, ১০, ২৫ ও ৫০ পয়সার প্রচলন ছিল, যা বর্তমানে অচল। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের পক্ষে কাগুজে নোট প্রচলনের ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে ছাপানো টাকা ও কয়েন (মুদ্রা) মিলে রয়েছে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। ব্যাংক নোট ২ লাখ ৯০ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকার। আর সরকারের নোট ও কয়েন ১ হাজার ৭১৭ কোটি টাকার। তবে দেশে ব্রড মানির পরিমাণ ১৭ লাখ ৫৭ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা।

চাইলেই কি নোট ছাপানো যায়?
কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলেই টাকা ছাপাতে পারে না। এর জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে, তা মেনে কাজ করতে হয়। পুরো বিষয়টি অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল। বাজারে অর্থের প্রবাহ বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। এতে দ্রব্যমূল্য বেড়ে বাড়িয়ে দেবে জীবনযাত্রার খরচ। অর্থনীতির স্বার্থেই ভারসাম্য রাখতে হয়।

পুড়িয়ে ফেলা ব্যবহার অযোগ্য নোট ও বাজার সার্কুলেশন বা অর্থের প্রবাহের বিষয়টি দেখেই নতুন নোট ছাপা হয়। অনেক সময় বিশেষ পরিস্থিতিতে টাকা ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ছিঁড়ে যাওয়া, পুড়ে নষ্ট হওয়া বা রি-ইস্যু করা যায় না এমন নোট ব্যাংকিং চ্যানেলে মার্কেট থেকে তুলে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ঘাটতি পূরণেও নতুন নোট সরবরাহ করা হয়।

ডলার, সরকারের ট্রেজারি বিল বা বন্ডের বিপরীতে বাজারে টাকা ছাড়তে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকার যদি বিদেশি ঋণ না পায়, তবে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতে ট্রেজারি বিল বা বন্ড ছাড়ে। এসব বিল বন্ডের বিনিময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় সরকার। ব্যাংকে তারল্যসংকট তৈরি হলে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব বিল বা বন্ডের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে টাকা দেয়। আবার বিল ও বন্ডের বিপরীতে ডিভলবিং ফান্ড (নতুন টাকা ছাপিয়ে) থেকে সরকারকে ঋণ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

টাকা ছাপাতে সরকারের খরচ
প্রতি বছর নতুন টাকা ছাপাতে সরকারের খরচ হয় সর্বনিম্ন ৫০০ কোটি টাকা। কোনো বছর ৭০০ কোটিও ছাড়িয়ে যায়। নানা কারণে টাকা নষ্ট হয়। প্রতি বছর বাংলাদেশ ব্যাংক নষ্ট নোট বাজার থেকে তুলে নিয়ে তার বিপরীতে নতুন নোট ছাড়ে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, ১০০০ টাকার নোট ছাপাতে ৫ টাকা ও ৫০০ টাকার নোট ছাপাতে খরচ পড়ে ৪ টাকা ৭০ পয়সা। ২০০ টাকার নোটে ৩ টাকা ২০ পয়সা, ১০০ টাকার নোটে ৪ টাকা, ১০, ২০, ৫০ টাকার সব নোটেই দেড় টাকা। আর ৫ টাকা, ২ টাকার নোট ছাপাতে খরচ পড়ে ১ টাকা ৪০ পয়সা। সবচেয়ে বেশি খরচ হয় কয়েন তৈরিতে। প্রতিটি কয়েনে প্রায় সমপরিমাণ টাকা খরচ হয়। তবে কয়েন বেশি টেকসই। নোট ছাপানোর খরচের কথা চিন্তা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল মুদ্রা তথা ক্যাশলেস ব্যবস্থার দিকে যেতে চায়।

টাকার প্রচলন কমানোর উদ্যোগ
তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এখন নগদ টাকার ব্যবহার কমেছে। বাংলাদেশ সেই পথে হাঁটতে শুরু করেছে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তঃব্যাংকিং লেনদেনের সুবিধার্থে নিয়ে এসেছে ‘বিনিময়’ নামে অ্যাপ। এর সাহায্যে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে সহজে লেনদেন করা যাবে। আর কেনাকাটায় গ্রাহক ও দোকানির মধ্যে সহজ লেনদেনের জন্য রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘বাংলা কিউআর’।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, যদি ডিজিটাল কারেন্সিকে জনপ্রিয় করা যায়, তাহলে অর্থ বেঁচে যাবে। ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ আরফান আলী বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যে উদ্যোগগুলো নিয়েছে, সেগুলো ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।

সৌজন্যে দেশ রূপান্তর

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর