২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপির ক্ষমতাকালীন প্রধানমন্ত্রীর দাপুটে রাজনৈতিক সচিব ছিলেন হারিছ চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বসলেও তার মূল ক্ষমতার উৎস ছিল হাওয়া ভবন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ইয়াজউদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকার গঠনের পর থেকে হারিছ চৌধুরী হাওয়ায় মিলিয়ে যান। তার কোনো সন্ধান পায়নি ওয়ান-ইলেভেন সরকার। এ সময় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, চট্টগ্রাম ও বগুড়ায় অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধার, এস এ এম এস কিবরিয়া, আহসানউল্লাহ মাস্টারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে হারিছ চৌধুরীকে খুঁজতে থাকে গোয়েন্দা সংস্থা। কিন্তু তার সন্ধান আর মেলেনি। গত ১২ বছরে তিনি কোথায় আছেন, জীবিত না মৃত- কেউ জানে না। এমনকি তার পরিণতি অন্য কারও মতো গুম কিনা তাও কেউ বলতে পারছে না। হারিছ যেন এক রহস্য এখনো।
কেউ বলেন লন্ডন, কেউ বলেন পাঞ্জাব
বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আলোচিত হাওয়া ভবনের আশীর্বাদপুষ্ট নেতা আবুল হারিছ চৌধুরী বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন, এ নিয়ে জল অনেক ঘোলা হয়েছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এই প্রতাপশালী রাজনৈতিক সচিব দীর্ঘদিন অন্তরালেই ছিলেন। যার ফলে ছড়িয়ে পড়েছিল তার মৃত্যুর গুজব। তবে হারিছ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছেন, তিনি এখন ভারতের পাঞ্জাবে রয়েছেন। সেখানে প্রকাশ্যে চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসা। সেখানকার একজন আত্মীয়ের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে তিনি ব্যবসা পরিচালনা করছেন। অবশ্য তারই আস্থাভাজন আরেকটি সূত্র বলছেন, মাঝেমধ্যে তাকে লন্ডনের বিভিন্ন এলাকায় মুখভর্তি দাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। হারিছ চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলায়। তার নানাবাড়ি ভারতের করিমগঞ্জে। নানাবাড়িতে যাওয়া-আসার সুবাদে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল সম্পর্কে আগে থেকেই জানাশোনা ছিল তার। চারদলীয় জোট সরকারের বিদায়ের পর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে পতন ঘটে হাওয়া ভবন সাম্রাজ্যের। একের পর এক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হতে থাকেন হারিছ চৌধুরী। এরপর নিজেকে রক্ষা করতে ২০০৭ সালের ২৯ জানুয়ারি জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে রাতের আঁধারে ভারতে পালিয়ে যান বিএনপি সরকারের দাপুটে এই নীতিনির্ধারক। প্রায় এক দশক পেরিয়ে গেলেও এরপর আর দেশমুখী হননি তিনি। গুজব রয়েছে, ২০১৫ সালে গোপনে দেশে এসেছিলেন হারিছ চৌধুরী। কিছুদিন সিলেটে অবস্থান করে নিজের সহায়-সম্পত্তি বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে ফের চলে যান ভারতে। সিলেটে হারিছ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সূত্র জানান, ২০১৫ সালের পর থেকে প্রায় দুই বছর দেশে কারোর সঙ্গেই যোগাযোগ করেননি হারিছ চৌধুরী। তখন তিনি মারা গেছেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তবে গত বছর থেকে দেশে নিজের বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে ফের যোগাযোগ রাখছেন। দেশের রাজনীতি ও রেখে যাওয়া সম্পত্তির খবরও রাখছেন তিনি। হারিছ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সিলেট বিএনপির এক নেতা জানান, বিভিন্ন দেশ ঘুরে বর্তমানে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে থিতু হয়েছেন আবুল হারিছ চৌধুরী। সেখানে তার মামাবাড়ির আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে পুরনো ব্যবসা রয়েছে। হারিছ চৌধুরীও জড়িয়ে পড়েছেন ব্যবসায়। তবে ঠিক কী ধরনের ব্যবসার সঙ্গে হারিছ চৌধুরী জড়িত, তা খোলাসা করতে চাননি তিনি। পাঞ্জাবে কোনো রাখঢাক না করে প্রকাশ্যেই চলাফেরা করেন হারিছ চৌধুরী। সেখানে বাংলাদেশি কিছু ব্যবসায়ী থাকলেও হারিছ চৌধুরীর চেহারা ও বেশভূষায় খানিকটা পরিবর্তন আসায় তাকে সবাই চিনতে পারেন না। সেখানকার ব্যবসায়ীরা তাকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবেই জানেন। সেখানে পরিচয় দিতে আসামের করিমগঞ্জে থাকা মামাবাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করেন হারিছ চৌধুরী। সূত্র জানান, প্রায় ছয় মাস আগে নিজের আস্থাভাজন ও ঘনিষ্ঠ সিলেট বিএনপির এক নেতার সঙ্গে ইন্টারনেট কলিংয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন হারিছ চৌধুরী। প্রায় আধা ঘণ্টার সেই আলাপে রাজনীতি, দেশে ফেরা-না ফেরা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলাপ করেন তিনি। ওই সময় বিএনপি নেতাকে তিনি জানান, পাঞ্জাবে তিনি সুস্থ আছেন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। তিনি দেশে ফিরতে চান। দেশে ক্ষমতার বদল ঘটলে এবং খালেদা জিয়াই বিএনপির নেতৃত্বে থাকলে তিনি দেশে ফিরবেন বলে জানান। হারিছ চৌধুরীর স্ত্রী ও সন্তানরাও রয়েছেন দেশের বাইরে। তার স্ত্রী একমাত্র মেয়েকে নিয়ে যুক্তরাজ্যে আছেন। সেখানে ব্যারিস্টারি করছেন মেয়ে। হারিছ চৌধুরীর ছেলে বর্তমানে নরওয়েতে একটি তেল কোম্পানিতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছেন, সন্তানদের সঙ্গে হারিছ চৌধুরীর নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। মাঝেমধ্যে ভারত থেকে লন্ডনের উদ্দেশেও পাড়ি জমান বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রভাবশালী এই নেতা। সূত্র বলছেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন নিজের নানাবাড়ি আসামের করিমগঞ্জে আত্মগোপন করে ছিলেন হারিছ চৌধুরী। তিনি ভারতে যাওয়ার কয়েকদিন পর তার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও টাকা বস্তায় ভরে সীমান্ত দিয়ে সেখানে পাঠানো হয়। করিমগঞ্জ থেকে মেঘালয়ে গিয়ে কিছুদিন থাকেন তিনি। পরে ভারত থেকে যুক্তরাজ্যে যান। সেখান থেকে ইরানে ভাই আবদুল মুকিত চৌধুরীর কাছে যান হারিছ চৌধুরী। কয়েক বছর সেখানেই ছিলেন। মুকিত চৌধুরী ইরানে একটি সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন। তবে মুকিত চৌধুরী মারা যাওয়ার পর আর ইরানমুখী হননি হারিছ। যুক্তরাজ্যে থাকার ইচ্ছা থাকলেও সেখানে প্রচুর বাংলাদেশি থাকায় নিরাপদ মনে করেননি তিনি। ফিরে আসেন ভারতে। পাঞ্জাবে থিতু হলেও প্রায়ই তিনি মামাবাড়ি করিমগঞ্জে আসা-যাওয়া করেন। একই সঙ্গে দেশে সহায়-সম্পত্তিরও খোঁজ রাখেন। হারিছ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সূত্র জানান, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় আসামি হওয়ার আগে দেশে আসার পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। এজন্য বিএনপি স্থায়ী কমিটির এক সদস্যের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার অনুমতি চেয়েছিলেন হারিছ চৌধুরী। কিন্তু ওই সময় দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাকে দেশে ফিরতে নিষেধ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
দেশে ফিরতে চেয়েছেন একাধিকবার : ২০০৭ সালে দেশ ছাড়ার পর বিভিন্ন সময়ে দেশে ফেরার চেষ্টা করেছেন হারিছ চৌধুরী। ২০১০ সালে একবার দেশে ফেরার পরিকল্পনা করেও পিছু হটেন। পরে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় জড়ানোর আগেও একবার দেশে আসতে চেয়েছিলেন তিনি। তবে মামলায় জড়ানোয় আর দেশমুখী হননি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সিলেট-১ আসনে হারিছ চৌধুরীকে প্রার্থী করার দাবি জানিয়ে পোস্টারিং হয়েছিল। তখন তিনি দেশে ফিরে নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু বিএনপি সে নির্বাচন বর্জন করায় সেবারও ভেস্তে যায় তার দেশে আসা। সিলেটে হারিছ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজনরা জানান, বিভিন্ন সময়ে দেশে আসার পরিকল্পনা করলেও দলের হাইকমান্ড থেকে গ্রিন সিগন্যাল না পাওয়া, একের পর এক মামলা, প্রতিকূল পরিস্থিতি ও পরিবারের সদস্যদের আপত্তিতে ফিরতে পারেননি তিনি।
ইরানে তাকে দেখা গেছে
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় হাওয়া ভবনের প্রভাবশালী নেতা ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব আবুল হারিছ চৌধুরী এখন কোথায়— এ নিয়ে চলছে নানামুখী গুজব। কেউ বলছেন, তিনি মারা গেছেন, আবার কেউ বলছেন তিনি এখনো বেঁচে আছেন। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতারা বলছেন, হারিছ চৌধুরী এখন ইরানে অবস্থান করছেন। তিনি এখন ক্যান্সারে আক্রান্ত। সেখানে নাগরিকত্ব নিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন। হারিছ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে আছেন, এটা সঠিক নয় বলে জানান নেতারা। এ প্রসঙ্গে জাতীয়তাবাদী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা-জাসাসের যুক্তরাষ্ট্র শাখার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা লন্ডনে বসবাসরত হারিছ চৌধুরীর এক নিকটাত্মীয়ের বরাত দিয়ে জানান, ‘হারিছ চৌধুরী ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। নিয়মিত রক্ত পরিবর্তন করতে হয়। ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে দুইবার তিনি আমেরিকাতে চিকিৎসা করালেও আরোগ্য লাভ হয়নি। তিনি ইরানে তার এক নিকটাত্মীয়ের তত্ত্বাবধানে বর্তমানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ওই নেতা আরও জানান, হারিছ চৌধুরী ইরানের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। এখন তার শারীরিক অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে। হারিছ চৌধুরী ব্রিটেনে আত্মগোপন করেছেন এই তথ্য সঠিক নয়। মাঝে মধ্যে হারিছ চৌধুরী মূলত ইসলামী দেশগুলোতে ভ্রমণ করছেন। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার দাপুটে রাজনৈতিক সচিব ছিলেন হারিছ চৌধুরী।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা হলেও তিনি ছিলেন তৎকালীন আলোচিত হাওয়া ভবনের নিয়ন্ত্রক ও প্রভাবশালী নেতা। তার ভাড়া করা বাসায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান অফিস করতেন। সেখান থেকেই দল ও সরকার পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসত বলে অভিযোগ ছিল।