২০ অক্টোবর, ২০২১ ০৮:২৮

কোথাও নেই নিয়ন্ত্রণ

১০ জেলায় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর-মন্দিরে হামলা । ইউপি ভোটে সরকারদলীয় ও বিদ্রোহী প্রার্থীরাই সংঘর্ষে লিপ্ত রাষ্ট্র সরকার ও ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে চলছে বিকৃত সাইবার যুদ্ধ ই-কমার্স ব্যবসার নামে হাজার হাজার কোটি টাকা উধাও নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে অসহায় ক্রেতা । সরকারে বেড়েছে আমলানির্ভরতা । এখনো শৃঙ্খলা ফেরেনি গণপরিবহনে

মাহমুদ আজহার ও রফিকুল ইসলাম রনি

কোথাও নেই নিয়ন্ত্রণ

প্রতীকী ছবি

সম্প্রতি দেশের অন্তত ১০ জেলায় হিন্দু সংখ্যালঘুদের মন্দির, ঘরবাড়ি ও পূজামন্ডপে ধারাবাহিক হামলার ঘটনায় সর্বত্র উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। অনেক ঘটনা ঘটেছে প্রকাশ্যেই। এ হামলা কি স্থানীয় প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না? আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার এ দায় কার- এমন প্রশ্ন সব মহলে।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অবশ্যই রাষ্ট্রের দায়িত্ব সব মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া। এখানে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও দায় এড়াতে পারে না। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে কি কোনো খবর ছিল না? তা ছাড়া আমাদের সমাজে এখন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অসুস্থতা বিরাজ করছে।’ শুধু আইনশৃঙ্খলায় নয়, সমন্বয়ের অভাব সবখানেই। স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ভোট ঘিরে সরকারদলীয় কর্মী-সমর্থকরাই এখন বিবাদে জড়াচ্ছেন। এমনকি নিজেরা নিজেরাই খুনোখুনিতে জড়িয়েছেন। দলীয়ভাবে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। সম্প্রতি মাগুরায় আওয়ামী লীগের দুই সাধারণ সদস্য (মেম্বার) প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়েছেন। রাঙামাটিতে এক ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থীকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যেই বিভিন্ন স্থানে চলছে সংঘর্ষ। ভোট এগিয়ে আসার আগেই শুরু হয়েছে খুনোখুনি। ফলে তৃণমূলে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণহীন আওয়ামী লীগ।

দ্বিতীয় ধাপে ৮৪৮ ইউপিতে নির্বাচন কেন্দ্র করে কয়েক জেলায় বড় ধরনের সংঘর্ষ, গোলাগুলি ও প্রাণহানি ঘটেছে। তৃতীয় ও পরবর্তী ধাপগুলোয়ও অতৃণশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর আগে পুলিশ সদর দফতরে অনুষ্ঠিত সভায় ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচন কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় মাঠপুলিশকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী মাঠপুলিশ ইউপি ও পৌর নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত এলাকাগুলোয় টহল ও নজরদারি জোরদার করেছে। এর পরও প্রতিদিনই কোনো না কোনো এলাকায় হামলা, সংঘর্ষ ও খুনোখুনির মারাত্মক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।
ই-কমার্স, এমএলএম বা সমবায়ের নামে দেড় দশকে লাখ লাখ গ্রাহকের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এখনো কেউ ফেরত পাননি। যুবক, ই-কমার্স এবং বহুস্তর বিপণন (এমএলএম) কোম্পানি ও সমবায় সমিতি সব মিলিয়ে গত ১৫ বছরে ২৮০টি প্রতিষ্ঠান মানুষের অন্তত ২১ হাজার ১৭ কোটি টাকা লোপাট করেছে। সব ক্ষেত্রেই উপায় ছিল গ্রাহককে বেশি মুনাফা ও ছাড়ের লোভ দেখানো। এর মধ্যে ২০০৬ সালে ‘যুবক’-এর ২ হাজার ৬০০ কোটি, ২০১১ সালে ‘ইউনিপে টু ইউ’র ৬ হাজার কোটি, ২০১২ সালে ‘ডেসটিনি’র ৫ হাজার কোটি এবং ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল সময়ে ২৬৬টি সমবায় সমিতির গ্রাহকদের ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। এসবের বাইরে ২০২১ সালে ১১টি প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের টাকা ফেরত দিচ্ছে না বলে খোঁজ পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে- ই-অরেঞ্জের গ্রাহক ও সরবরাহকারীদের ১ হাজার ১০০ কোটি, ইভ্যালির ১ হাজার কোটি, ধামাকার ৮০৩ কোটি, এসপিসি ওয়ার্ল্ডের ১৫০ কোটি, এহসান গ্রুপের ১১০ কোটি, নিরাপদডটকমের ৮ কোটি, চলন্তিকার ৩১ কোটি, সুপম প্রোডাক্টের ৫০ কোটি, রূপসা মাল্টিপারপাসের ২০ কোটি, নিউ নাভানার ৩০ কোটি ও কিউ ওয়ার্ল্ড মার্কেটিংয়ের গ্রাহকদের ১৫ কোটি টাকা। অবশ্য এরই মধ্যে সরকার এমএলএম ও ই-কমার্স নিয়ে একটি আইনি কাঠামো দাঁড় করানোর উদ্যোগ নিয়েছে।

রাষ্ট্র, সরকার বা ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে চলছে বিকৃত সাইবার যুদ্ধ। কারও ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা অনলাইন প্ল্যাটফরমে যা ইচ্ছা তা-ই লেখা হচ্ছে বা বিকৃত ভিডিও বানিয়ে আপলোড করা হচ্ছে। বিষয়টি দেখার কেউ নেই। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যেন অসহায়। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের সুযোগ নিয়ে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধেই চলছে সাইবার যুদ্ধ। স্বাধীনতাবিরোধীরা সরকারকে ঘায়েল করতে দেশ-বিদেশ থেকে অতিমাত্রায় মিথ্যাচার করে চললেও ঠেকাতে পারছে না সংশ্লিষ্ট দফতর। সাইবার সন্ত্রাসীদের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ দৃশ্যমান হচ্ছে।

সম্প্রতি ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, ‘ফেসবুক, ইউটিউবের কাছে সরকার অসহায়। আপত্তিকর ব্যক্তিগত ছবি কিংবা ভিডিও অপসারণের ব্যাপারে অনুরোধ করা হলেও সব ক্ষেত্রে তারা শোনে না। এখন সবচেয়ে বেশি অপরাধের মাধ্যম ইন্টারনেট।’

নিত্যপণ্যের বাজারও এখন নিয়ন্ত্রণহীন। বেড়েছে চাল, ডাল, আটা, মুরগি, তেলসহ সব ধরনের সবজির দাম। হঠাৎ এমন দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এ বিষয়ে কথা বলার অধিকার আমার নেই। এ বিষয়ে কথা বলবেন খাদ্যমন্ত্রী। এটা তাঁর অধিকার। আমি তাঁর অধিকার ভঙ্গ করতে চাই না।’ এরপর খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার বললেন, ‘ব্যবসায়ীদের মুনাফার প্রতি অতিলোভের কারণে মাঝেমধ্যেই চালের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। বাজার মনিটরিংয়ের জন্য মূল্য কমিশন গঠন করে বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।’ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে দুই মন্ত্রীর দুই ধরনের বক্তব্যেই ফুটে ওঠে সমন্বয়হীনতা।

আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মী এমনকি অনেক এমপিরও অভিযোগ, মাঠ প্রশাসনের সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সম্পর্ক খুব একটা সুখকর নয়। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে দূরত্ব আরও বেড়েছে জনপ্রতিনিধিদের। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার এখন পুরোপুরি আমলানির্ভর। তাদের নেতিবাচক কর্মকান্ডে সরকারও বিব্রত হয়। আর ক্ষমতাসীন হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিতে হচ্ছে তার দায়ভার। কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগের অবস্থান দুর্বল রাখতে স্থানীয় নেতাদের মধ্যে গ্রুপিং জিইয়ে রাখতে সরকারি কর্মকর্তারা ভূমিকা পালন করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। প্রশাসনেও আছে সমন্বয়হীনতা।

অভিযোগ আছে, অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর কথাও শোনেন না সচিবরা। ইচ্ছামতো অফিস করা, অবকাশ যাপনে ঘুরে বেড়ানোর কথা শোনা যায়। কেউ কেউ ঠিকদারদের টাকায়ও বিদেশ ঘোরেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অনেক মন্ত্রণালয় আছে যেখানে নিয়োগ থেকে বদলিতে কিছুই জানেন না মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা। আবার মন্ত্রী-এমপি, মেয়রের সঙ্গেও বিরোধে জড়াচ্ছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। উপজেলা চেয়ারম্যানদের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক নেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের। কে বড়- এ কর্তৃত্ববাদী টানাপোড়েন চলছে উপজেলাগুলোয়।

করোনার এই সময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতার চিত্র ফুটে উঠেছে। সর্বশেষ বিমানবন্দরে করোনা পরীক্ষা করা নিয়েও চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে প্রবাসীদের। করোনা পরীক্ষাগার করা নিয়েও স্বাস্থ্য ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা দেখা গেছে। কার্যত করোনার শুরু থেকেই স্বাস্থ্য খাতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখা দেয়। করোনার পরীক্ষা জালিয়াতির সনদ, চিকিৎসাব্যবস্থা, টিকাসহ সবকিছুতেই এখনো শৃঙ্খলা ফেরেনি। রাজধানীতে গণপরিবহনব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আসেনি। সড়ক-মহাসড়কে চলছে ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় বাস, চলছে চালক-হেলপারদের দৌরাত্ম্য। চালকদের সিগন্যাল না মানা, যেখানে সেখানে বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো, পাল্লা দিয়ে ছুটে চলার প্রবণতা এখনো বহাল আছে। একই সঙ্গে পথচারীদের পুরনো অভ্যাসও পরিবর্তন হয়নি। তারাও ফুটওভার ব্রিজ রেখে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হতে দ্বিধা করছেন না।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে এখন বেসামাল পরিস্থিতি। জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকলে দেশ ও জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা থাকে। কিন্তু এ সরকারের জনপ্রতিনিধিরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন কি না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এ কারণেই মনে হয়েছে এ সরকারের জনগণের প্রতি কোনো জবাবদিহি নেই। আমি মনে করি সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা প্রশ্নে দায় এড়াতে পারে না স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি বা সরকার। এখন এ নিয়ে দোষারোপের রাজনীতি চলছে। এ সুযোগে প্রকৃত দোষীরা আড়াল হয়ে যেতে পারে। নির্দোষ ব্যক্তির ওপর নেমে আসতে পারে শাস্তির খড়্গ। এটা কাম্য নয়।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় যখন রাজনৈতিক দলগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে, গণতান্ত্রিক উপায়ে যখন নেতৃত্ব নির্বাচিত হয় না তখন অন্যরা ছড়ি ঘোরাতে সাহস পায়। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের দুর্বল নেতৃত্ব হলে এ সুযোগটি অন্যরা কাজে লাগায় বেশি। আবার অভ্যন্তরীণ কোন্দলকেও পুঁজি করে রাজনীতিবিদদের ওপর ছড়ি ঘোরানো হয়। রাজনৈতিক ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ার কারণেই আমলাদের কর্তৃত্ব বেড়েছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক যে হামলাগুলো হলো সেখানে প্রশাসন যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে সেটা তেমন চোখে পড়ে না। আবার রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধিদেরও তৎপরতা চোখে পড়েনি। কুমিল্লার ঘটনা মেয়র অফিস থেকে ৪০০ গজ দূরে। সেখানে মেয়র পরদিন বেলা ১১টায় পরিদর্শন করেছেন বলে গণমাধ্যমে এসেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগ হলো- সেখানে উপজেলা, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বা এমপি কী ভূমিকা পালন করেছেন? শুধু আওয়ামী লীগই নয়, প্রতিটি রাজনৈতিক দলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব আনতে হবে।’

বিডি প্রতিদিন/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর