৬ ডিসেম্বর, ২০২১ ১০:৪৭

সাগরপথে মানব পাচার, সেই গডফাদারকে বাদ দিয়ে চার্জশিট!

মাহবুব মমতাজী

সাগরপথে মানব পাচার, সেই গডফাদারকে বাদ দিয়ে চার্জশিট!

ফাইল ছবি

প্রথমে মানি লন্ডারিংয়ের সব তথ্য তুলে ধরে মানব পাচারের গডফাদার বলে অভিযুক্ত করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পরে মামলার চার্জশিট থেকে সেই গডফাদারকেই বাদ দিয়েছে সংস্থাটি। ওই ব্যক্তি হলেন মোহাম্মদ আছেম। তার বাড়ি কক্সবাজারের টেকনাফে। তার বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ৩ মে রাজধানীর বনানী থানায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করেন সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক আবদুর রাজ্জাক খান। মামলায় আসামি করা হয় আরিফুজ্জামান আকন্দ, মোহাম্মদ আছেম, তার মা খতিজা বেগম, ওসমান সরোয়ার ও মো. একরামকে।

অপর পরিদর্শক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. ইব্রাহিম হোসেন গত বছর ৯ আগস্ট আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। ২০ আগস্ট আদালত তা গ্রহণ করে। এখানে আছেমকে বাদ দিয়ে সবাইকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

২০১৮ সালের ১৫ আগস্ট আছেমকে এবং একই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর একরামকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করে সিআইডি। দুজনই এখন জামিনে আছেন। মামলাটি এখনো বিচারাধীন আছে বলে আদালত সূত্র জানিয়েছে। ওই সময় সিআইডি কর্মকর্তারা জানান, এক সপ্তাহের ব্যবধানে আছেম দুবার গ্রেফতার হয়েছেন, দুবারই জামিনে বেরিয়ে গেছেন। চার্জশিটে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, আসামি আছেমের বিরুদ্ধে মামলার ঘটনা প্রমাণিত না হওয়ায় বিচারার্থে প্রেরণ করা গেল না। নিরপেক্ষ তদন্তে তার জড়িত থাকার ব্যাপারে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
চার্জশিট থেকে আছেমকে বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মো. হুমায়ুন কবির এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বিষয়টি আমার নলেজে নেই। কাগজপত্র না দেখে কিছু বলা যাবে না।’

গ্রেফতারের পর আছেম সম্পর্কে যা বলেছিল সিআইডি : ২০১৮ সালের ২০ আগস্ট রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির তৎকালীন বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, সাগরপথে মালয়েশিয়ায় মানব পাচারকারী চক্রের গডফাদার মোহাম্মদ আছেম। আন্তর্জাতিক এই মানব পাচারকারী কক্সবাজার সাগর চ্যানেল দিয়ে গত কয়েক বছরে হাজার হাজার মানুষকে মালয়েশিয়া পাচার করেছেন। সাগরপথে মালয়েশিয়ার যাওয়ার সময় অনেক বাংলাদেশি মারাও গেছেন। এখনো অনেক মানুষ নিখোঁজ। তারা দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজার-থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ায় সাগরপথে মানব পাচার করে মুক্তিপণের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থের মালিক হয়েছেন। তাকে ১৯ আগস্ট (২০১৮) রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে সিআইডি গ্রেফতার করে। আছেমের বাবা আনোয়ার হোসেন দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় ছিলেন এবং তার বড় ভাই মোহাম্মদ খোবায়েদও মালয়েশিয়ায়। এ সুবাদে তারা আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রের সঙ্গে যোগ দেন। আছেম ২০১০ সালে তাদের সঙ্গে মানব পাচারের কাজ শুরু করেন। আছেম ও তার ছোট ভাই জাভেদ মোস্তফা মানব পাচারের জন্য প্রথমেই বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় দালাল নিয়োগ করেন। দালালরা লোক ঠিক করে নিয়ে আসে। এরপর তাদের কাছ থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার খরচ নিয়ে টেকনাফে নিয়ে যাওয়া হয়। টেকনাফ থেকে ট্রলারে করে মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে রাখা হয়। পাচার হওয়া লোকদের আটকে রাখা হয় সেখানে। এরপর ভিকটিমদের নির্যাতন করে বাংলাদেশে থাকা স্বজনদের কাছে মুক্তিপণ চায় পাচারকারী চক্র। এরপর আছেম ও তার সহযোগীরা মুক্তিপণ আদায় করে। আর যারা মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হয় তাদের থাইল্যান্ডের জঙ্গলে মেরে ফেলা হয়। আছেম পাচারের টাকা দিয়ে টেকনাফে বাড়ি ও জমি কিনেছেন। এ ছাড়া জমি কিনেছেন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। এগুলো সব অবৈধ টাকার। সিআইডি কর্মকর্তারা জানান, আছেম রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারে বসবাস করতেন। তিনি তেজগাঁও কলেজের বিবিএ ডিপার্টমেন্টের প্রভাষক। তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং ও মানব পাচারের তিনটি মামলা ছিল। একটি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানায়, একটি রাজধানীর বনানী এবং অপর মামলাটি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থানায়। ২০১৮ সালের ১৫ আগস্ট আছেমকে প্রথমে গ্রেফতার করা হয়। তিন দিন রিমান্ডে থাকার পর দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত তাকে জামিন দিয়ে দেয়। পরে অন্য একটি মামলায় ১৯ আগস্ট সিআইডি আবারও তাকে কারওয়ান বাজার থেকে গ্রেফতার করে। পরদিন আদালতে তোলা হলে তিনি জামিন পান।

পুলিশের সাবেক প্রধানরা যা বলছেন : সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মামলা সাধারণত হয় প্রাথমিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। চূড়ান্ত তদন্তে সেটি প্রমাণিত না হলে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারে। তবে মানি লন্ডারিং মামলার ক্ষেত্রে যেটি হয়েছে সে সম্পর্কে তদন্ত কর্মকর্তাই ভালো বলতে পারবেন। কথা হয় আরেক সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্যে এজাহার হয়। সেটি চূড়ান্ত নয়। চূড়ান্ত তদন্তের মাধ্যমে মামলাটি নিষ্পত্তি হয়। যদি কারও ইনফ্লুয়েন্সে এই চার্জশিট হয় তাহলে কিন্তু ৫ বছর কিংবা ১০ বছর পর আবারও ব্যাক করতে পারে। তখন কিন্তু ওই ব্যক্তি আবার জেলে যাবে।

মামলার এজাহারে যা ছিল : মামলায় সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক আবদুর রাজ্জাক খান অনুসন্ধান করে জানতে পারেন, মাদারীপুরের শিবচরের শামিম নামে এক কিশোরকে চাকরি দেওয়ার প্রলোভনে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি মালয়েশিয়ায় নিয়ে যায়। ২০১৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তার মা মমতাজ বেগমকে টেলিফোনে ইসলামী ব্যাংকের মহাখালী শাখায় আড়াই লাখ টাকা জমা দিতে বলা হয়। এ টাকা না দিলে শামিমকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। পরে আড়াই লাখ টাকা মমতাজ বেগম জমা দেন। ওই হিসাবের মালিক আরিফুজ্জামান আকন্দসহ মোহাম্মদ আছেম মানব পাচারে জড়িত বলে জানা যায়। আরিফুজ্জামান আকন্দ তার ব্যাংক হিসাবে মানব পাচারের টাকা লেনদেন করেছেন। মালয়েশিয়ায় ছোট ভাই মাসুদ ও ভাতিজা তোফাজ্জলের মুক্তিপণ বাবদ আরিফের ব্যাংক হিসাবে ৫ লাখ টাকা জমা দেন নরসিংদীর স্বপন মিয়া। এমন অন্তত ২০ জন বিভিন্ন সময়ে আত্মীয়স্বজনের মুক্তিপণ বাবদ টাকা জমা দিয়েছেন। ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আরিফের ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তার ব্যাংক হিসাবে ৯৪ লাখ ৬৬ হাজার ৭৪০ টাকা জমা হয়েছে। এই হিসাব থেকে আছেমের মা খতিজা বেগমের ইসলামী ব্যাংক টেকনাফ শাখার হিসাবে ৫৪ লাখ ২১ হাজার ৩৬৫ টাকা স্থানান্তর করা হয়। আরিফ ও আছেম সুকৌশলে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় নেওয়ার কথা বলে লোকজনকে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে পাচার করতেন। মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের কাছ থেকে জনপ্রতি ২ লাখ ১০ হাজার টাকা করে নিতেন তারা। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ড. মোহাম্মদ মোমতাজ উদ্দীন আহমেদ মেহেদী বলেন, সিআইডির কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলনের সময় যা বলেছেন তা ভুল কিংবা মিথ্যা হতে পারে না। তবে চার্জশিট যেভাবে দেওয়া হয়েছে তা অবশ্যই প্রভাবিত হয়ে দিয়েছে। তদন্তও করেছে প্রভাবিত হয়ে।

সিআইডি সূত্রে আরও যা জানা যায় : ২০১৬ সালে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার একটি মামলায় প্রথম আরিফুজ্জামান আরিফ ও আছেমের নাম আসে। মামলাটি করেন আবদুস সালাম। তিনি অভিযোগ করেন, ২০১৪ সালে আরিফুজ্জামান আরিফ ও মো. আছেম তার ছেলে মো. মাসুদ ও মো. আবদুল আলিমকে অল্প খরচে নৌপথে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার টোপ দেন। ওই বছরের ২ অক্টোবর রাত ৮টার দিকে তাদের বাড়ি থেকে নিয়ে যান আসামিরা। এর দুই মাসের বেশি সময় পর আবদুস সালামের কাছে একটি ফোন আসে। মাসুদ তার বাবাকে জানান, তিনি ও আলিম একটি জঙ্গলে আটকে আছেন। ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করলে তারা ছাড়া পাবেন। এরপর আবদুস সালাম ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর উল্লাপাড়ায় ইসলামী ব্যাংকের একটি শাখায় টাকা পরিশোধ করেন। এতেও ওই দুজন মুক্তি পাননি। পরিবারটি পরে জানতে পারে, মাসুদ ও আলিম দুজনই মালয়েশিয়ার জেলে আটক আছেন।

বিডি প্রতিদিন/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর