আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি, রাত পোহালেই মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। আগামীকাল রবিবার ঈদের নামাজ শেষে পশু কোরবানি করবেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। ইতিমধ্যে বেশির ভাগ মানুষেরই যার যার পছন্দের পশু কেনা হয়ে গেছে। কোরবানির হাটের শেষ মুহূর্তে রাজধানীর হাটগুলো ঘুরে এমনই চিত্র চোখে পড়েছে। হাটে আসা বেশির ভাগ পশু বিক্রি হয়েছে, সেই সাথে কমেছে ক্রেতাদের আনাগোনাও। শেষ পর্যায়ে হাটে যেমন কোরবানির পশুর সংখ্যা কম, সে অনুযায়ী ক্রেতার সংখ্যাও কম। এছাড়া আজ সারাদিন হাট ঘুরে বোঝা গেল, ছোট ও মাঝারি গরুর চাহিদা বেশি, কিন্তু বড় গরুর ব্যাপারীরা অনেকটাই হতাশ।
রাজধানীর বিভিন্ন হাটের ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের ঈদে যা বেচা-বিক্রি হয়েছে তাতে বিক্রেতারা যেমন খুশি, ক্রেতারাও তেমনি খুব একটা অখুশি নন। ঈদ সামনে রেখে গত তিনদিনই গরুর দামে একই রকম চিত্র দেখা গেছে, দামের ক্ষেত্রে সেই অর্থে বড় কোনো হেরফের দেখা যায়নি। তবে ক্রেতারা বলছেন, গতবারের তুলনায় এবার প্রত্যেক গরুর দাম ১৫-২৫ হাজার টাকা বেশি মনে হয়েছে। তারা এটাও বলছেন, যেহেতু সব কিছুর দাম বেড়েছে- সে তুলনায় গরুর দামটা এরকম বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। যদিও এবার ঈদের আগে বন্যা, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা ও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আশঙ্কা করা হয়েছিল, পশুর দাম হয়তো বেশি হতে পারে, এমনকি চাহিদার তুলনায় পশুর সংকট দেখা দিতে পারে- কিন্তু তেমন কোনো পরিস্থিতি হয়নি। এবার কোরবানির হাটগুলোতে পর্যাপ্ত পশুর সমাগম হয়, সেই সাথে ক্রেতাদের নাগালেই ছিলো পশুর দাম। কিন্তু হাট জমে উঠার আগে ব্যাপারী ও বিক্রেতাদের ভয় ছিলো, এবার হয়তো বন্যা ও দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে কোরবানিতে সেভাবে ক্রেতা সমাগম ও দাম না-ও পাওয়া যেতে পারে। এমনকি বেচা-বিক্রিও কম হতে পারে। তবে সেরকম কোনো অবস্থা তৈরি হয়নি।
ব্যাপারীদের ভাষ্য, পশুর চাহিদা ও দাম নিয়ে ভয় থাকলেও যতটুকু আশা করা হয়েছিল সেরকমই পেয়েছি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশিও পেয়েছি। অন্যদিকে ক্রেতারাও আশানুরূপভাবে পছন্দের পশু কিনতে পেরেছেন। সব মিলিয়ে এবারের কোরবানির হাটে গরুর ক্রেতারা যেমন খুশি ছিলেন তেমনি ব্যাপারীদের মুখেও ছিলো হাসি।
আজ শনিবার বিকালে রাজধানীর ধোলাই খাল কোরবানির হাটে চুয়াডাঙ্গা থেকে আসা গরুর ব্যাপারী হবিবর রহমান জানান, তিনি ১২টি গরু নিয়ে এই হাটে এসেছিলেন, এরই মধ্যে তার ১০টি গরু বিক্রি হয়েছে। তিনি আশা করছেন আজ ঈদের আগের রাতে বাকি দু’টো গরুও ছেড়ে দিতে পারবেন। অন্যদিকে, যাত্রাযাড়ী থেকে আসা ক্রেতা সাকিব হাসান পছন্দের গরু কিনে জানান, এবার কোরবানির পশু কেনা নিয়ে আশঙ্কা ছিলো দাম হয়তো অনেক বাড়তে পারে। তবে হাটে এসে দেখলাম সে অনুযায়ী বাড়েনি। গরুর দাম ১৫-২৫ হাজার টাকা বেশি মনে হলেও পছন্দের গরু কিনতে পেরেছি। সবচেয়ে বড় কথা কোরবানি দিবো তাই এখানে লাভ-লসের কোনো হিসাব করছি না।
এদিকে, ধোলাই খাল হাট ব্যবস্থাপনা কমিটিও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারা জানান, এবার কোরবানির হাট ভালোই গিয়েছে। কোরবানির পশুর চাহিদা অনুযায়ী হাটে যেমন ক্রেতা সমাগম হয়েছে, তেমনি বেচা-বিক্রিও হয়েছে বেশ। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত পশু হাটে উঠেছিল। ঈদ সামনে রেখে সময়ের সাথে সাথে যেমন বিক্রি বেড়েছে তেমনি পশু কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রেতারাও কমেছে। একাধিক হাট ঘুরে দেখা গেছে, আজ ঈদের আগের দিন শেষ পর্যায়ে হাটে পশুর সংখ্যা যেমন কমছে তেমনি ক্রেতাও কমতে শুরু করেছে। মনে হয়েছে, এবার আগে ভাগেই ক্রেতারা নিজেদের পছন্দের পশু কিনে নিয়েছেন। তবে বড় গরুর তুলনায় এবার ছোট ও মাঝারি গরুর চাহিদা ছিলো চোখে পড়ার মতো। হাটের শেষ তিনদিনে ছোট গরু বিক্রি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তবে কিছু কিছু বড় গরুও বিক্রি হয়েছে।
এর আগে, এবার কোরবানির ঈদ সামনে রেখে সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নজর কেড়েছিল বেশ কিছু গরু। যাদের রঙের মতো নামও বাহারি- কেউ বাদশা, কেউ রাজা, কেউ সম্রাট, কেউ কালাপাহাড়, কেউ আবার ধলাপাহাড়। তবে বেচাকেনার শেষ দিনে এসে এসব বড় গরুর মালিকরা ভুগছেন ক্রেতা সংকটে। এবারের ঈদ বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি বলছে, সাধ ও সাধ্যের মধ্যে মিল রেখে ছোট ও মাঝারি গরুই মানুষ কিনেছে বেশি।
হাটগুলোতে ক্রেতাদের পছন্দ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মূলত ১ লাখ ৩০ হাজার থেকে ২ লাখ ২০ হাজার দামের মধ্যে থাকা গরুর চাহিদাই বেশি। ২ লাখের ওপরের দামের গরুর ক্রেতার সংখ্যা হাতে গোনা। আর যারা বেশি দামে গরু কিনতে চান, তারা আগে থেকেই অনলাইন কিংবা সরাসরি খামার থেকে দেখেশুনে দরদাম করে নিজের পছন্দের পশুটি কিনে ফেলেছেন। তাই হাটে আসা বড় গরুগুলো তুলনামূলক কম ক্রেতাদের চাহিদায় ছিলো।
হাটের খবর বলছে, গোপালগঞ্জ থেকে উত্তরা পশুর হাটে আসা এক ব্যাপারী চারটি গরু নিয়ে হাটে এসেছেন। যার প্রতিটি গরুর ওজন হবে ৪২ মণের ওপরে, প্রতিটির দাম হেঁকেছেন ১০ লাখ টাকার বেশি। কিন্তু ক্রেতারা আশানুরূপ দাম না বলায় সেগুলো বিক্রি করেননি। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন ওই ব্যাপারী। কেবল তিনি নন, তার মতো আরও অনেক বড় গরু ব্যাপারীই পড়েছেন একই সংকটে। জানা গেছে, ‘কালাপাহাড়’ ও ‘ধলাপাহাড়’ নামে অনলাইনে ঝড় তোলা গরু দুটির বিক্রেতারাও প্রত্যাশিত দাম পাচ্ছেন না। রাজধানীর কমলাপুরে গত তিনদিন যাবৎ কয়েকটি বড় গরুর খুব আকর্ষণ থাকলেও শেষ দিকে এসে কোন ক্রেতারাই আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
ঢাকার বাইরেও একই অবস্থা। ছোট গরুর চাহিদা থাকলেও শেষ মুহূর্তে কাঙ্ক্ষিত ক্রেতা পাচ্ছে না বড় গরুগুলোর ব্যাপারীরা। অন্যদিকে, ক্রেতারা জানাচ্ছেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বাজারের অস্থিরতার কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। ফলে, মধ্যম ও ছোট আকারের গরু কেনার দিকে ঝুঁকেছেন তারা। তবুও বিক্রেতাদের প্রত্যাশা, তারা শেষ মুহূর্তে হলেও বড় গরুগুলোর ন্যায্য দামে বিক্রি করতে পারবেন।
বিডি-প্রতিদিন/শফিক