বর্ডার গার্ড বাংলাদেশে (বিজিবি) যোগদানের ছয় মাস আগেও অনেকটা লক্ষ্যহীন জীবন ছিল তাদের। ছিল সংকীর্ণতা। সেই সংকীর্ণতা দমিয়ে রাখতে পারেনি তাদের। ৯৯তম রিক্রুট ব্যাচের মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষে তারা এখন বিজিবির গর্বিত সৈনিক। এবার দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার সুমহান দায়িত্ব তাদের। তাই প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজে নবীন সৈনিকদের দৃপ্ত শপথ- জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও দেশের জন্য কাজ করবো। সততা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবো, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবো।
রবিবার চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার বায়তুল ইজ্জতে বর্ডার গার্ড ট্রেনিং সেন্টার অ্যান্ড কলেজের (বিজিটিসিএন্ডসি) প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের শপথ গ্রহণ পর্বে সীমান্ত রক্ষায় এমন দৃপ্ত শপথ নেন ৯৯তম রিক্রুট ব্যাচের নবীন সৈনিকরা। অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে নবীন সৈনিকদের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও অভিবাদন গ্রহণ করেন। অভিবাদন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নবীন সৈনিকদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণ প্রদান করেন।
তিনি বিজিবি’র নবীন সৈনিকদের প্রদর্শিত তেজোদীপ্ত কুচকাওয়াজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন এবং নবীন সৈনিকদের নতুন জীবনে পদার্পনের শুভলগ্নে তাদের স্বাগত জানান এবং ৯৯তম রিক্রুট ব্যাচের সেরা সৈনিকদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন। গত বছরের ২০ নভেম্বর বিজিটিসিএন্ডসিতে তাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষণ ভেন্যুতে সর্বমোট ৫৩৯ জন রিক্রুটের মধ্যে ৫০২ জন পুরুষ এবং ৩৭ জন নারী রিক্রুট মৌলিক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন। দীর্ঘ ২৪ সপ্তাহের অত্যন্ত কঠোর ও কষ্টসাধ্য এ প্রশিক্ষণ সফলভাবে শেষ করেন। অথচ ক'দিন আগেও এদের অনেকের চলার গতিতে ছিল ছন্দহীনতা, আজ তদের চলার গতিতে পেল পূর্ণতা।
অনেক সৈনিকের বাবা-মা সন্তানদের কুচকাওয়াজ দেখতে আসেন। তারা দর্শকসারিতে বসেছিলেন। প্যারেড কমান্ডারের নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গে সৈনিকরা তা পালন করা দেখে উচ্ছ্বাসিত পরিবারের সদস্যদের করোতালিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠছে প্যারেড ময়দান। অনুষ্ঠান শেষে সন্তানদের জড়িয়ে ধরে আবেগে কেঁদেছেন অনেক বাবা-মা।
বিজিবির ৯৯তম রিক্রুট ব্যাচের মৌলিক প্রশিক্ষণে সর্ব বিষয়ে সেরা নবীন সৈনিক সুহেল মিয়া বলেন, দীর্ঘ ছয় মাসের কঠিন ট্রেনিং শেষ করে আমরা এখন পূর্ণ সৈনিক হয়ে উঠেছি। আমার এখন দেশের জন্য প্রস্তুত। নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে হলেও দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষা করবো। প্রত্যেকটি বাহিনীর সদস্যরা দেশের জন্য কাজ করেন। কিন্তু বিজিবি দেশের সীমান্ত পাহারা দেন সেটা অন্য বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হয় না। ট্রেনিংয়ে আমরা শিখেছি কিভাবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হয়। আমরা গ্রামের সাধারণ ছেলে ছিলাম। কিন্তু আজ দেশের জন্য জীবন দিতে শপথ নিলাম। যখন সবাই ঘুমাবে তখনও আমরা দেশের সীমান্তে অতন্ত্র প্রহরী।
কঠোর ট্রেনিংয়ের মধ্যে দিয়ে শিখেছি কঠিন ট্রেনিংয়ে সহজ যুদ্ধো। ট্রেনিংয়ে যত বেশি ঘাম ঝরবে যুদ্ধে তত কম রক্ত ঝরবে। শেষ দিন পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় বাবা-মাকে বলে আসছি দেশের জন্য গেলাম। এক বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে সুহেল তৃতীয়। পরিবারে একমাত্র বাহিনীতে চাকরি জীবন শুরু করেছেন তিনি। ২৪ সপ্তাহের ট্রেনিংয়ে তার প্রামাণের স্বাক্ষর রেখেছেন সুহেল। নারী ও পুরুষ ৫৩৯ জন সৈনিকের মধ্যে সর্ব বিষয়ে শ্রেষ্ট হয়েছেন তিনি। কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে একটি কন্টিজেন্টের নেতৃত্বেও দিয়েছেন সুহেল।
নারী সৈনিকদের মধ্যে শারীরিক উৎকর্ষে সেরা লাখি আক্তারও আবেগে আপ্লুত। এক ভাই তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট সে। তার ছোট বেলা থেকেই শখ ডিফেন্সে চাকরি করবেন। যাতে দেশের জন্য কিছু করতে পারি। এছাড়া গানের গলাও বেশ ভালো, কিন্তু ডিফেন্সে চাকরির ইচ্ছা থেকেই বিজিবিতে ভর্তি হওয়া। লাখি বলেন, নারীও দেশের জন্য কিছু করতে পারে, সেটা আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি ট্রেনিংয়ে মনযোগী ছিলাম প্রথম থেকেই, আজ তার প্রাপ্তিও পেলাম। আমার বাবা-মা গ্যালারিতে বসে দেখেছে আমি প্যারেড করছি। আমি সেরা হয়েছি। এখন দেশের তৈরি। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি একজন মানুষের জীবনে আর কি হতে পারে।
এসময় কথা হয় লাখির বাবা দোয়াত আলী ও মা সুফিয়া বেগমের সঙ্গে। আমার ছোট মেয়ে আজকে কত বড় হয়ে গেছে। ওর ছোটবেলা থেকেই খুব শখ বিজিবিতে কাজ করা। সীমান্তে দেশের হয়ে কাজ করবে। ট্রেনিংয়ে মধ্যে দু'বার এসে দেখা করে গেছি। আজকে তার জীবনের পূর্ণতার দিন। বাবা-মা হয়ে কি করে দূরে থাকি। এই সংবাদ শুনে মানিকগঞ্জ থেকে চট্টগ্রাম চলে এসেছি। আমার ছেলে সেনাবাহিনীতে আর ছোট মেয়ে বিজিবিতে দেশের জন্য কাজ করে। বাবা-মা হয়ে এর চেয়ে গর্বের আর কি আছে।
ফায়ারিংয়ে সেরা নবীন সৈনিক আকিজ জাভেদ বলেন, অনেক সরকারি চাকরিই তো আছে। কিন্তু বিজিবিই দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার কাজ করেন। আজকে শপথ নিলাম শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও রক্ষা করবো মাতৃভূমি, সততা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন করবো। নিজের জীবন বিপন্ন করে হলেও অর্পিত দায়িত্ব পালন ও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবো। মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষে আমি এখন বিজিবির গর্বিত সৈনিক। এবার দেশমাতৃকার সীমান্ত রক্ষায় কাজ করবো।
শারীরিক উৎকর্ষে সেরা হওয়া ফাহিম আবরারও সীমান্ত রক্ষায় দৃপ্ত শপথ চাকরি জীবনের প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করার অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন।
শুধু সুহেল, লাখি কিংবা আকিজ আর ফাহিমই নন, তাদের মতো ৯৯তম রিক্রুট ব্যাচের নবীন সৈনিকরা দেশমাতৃকার সেবায় নিজেদের সর্বদা নিয়োজিত রাখার আশা ব্যক্ত করেন। তবে তাদের অনেকের জীবনে রয়েছে দুর্বিষহ স্মৃতি। সাফল্যের এমন মুহূর্তে সেই স্মৃতি মনে করে কেঁদে ফেলেন কেউ কেউ। ৬ মাস আগেও চাকরির জন্য হতাশায় ভুগছিলেন তারা। পরিবারের অভাব-অনটন আর সংকীর্ণতা যেন পিছুই ছাড়ছিল না। বিজিবিতে চাকরির সুযোগ পেয়ে সেই সংকীর্ণতা থেকে আজ তার উত্তীর্ণ হয়েছেন। এখন দেশের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে প্রস্তুত তারা। তারা বলছিলেন, শপথের প্রতিটি শব্দ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন। দেশ ও দেশের মানুষের সেবায় নিজেদের বিলিয়ে দিবেন।
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত