ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ শ্যামলী আর ইউনিক ছাড়া অন্য আরও বাস যায়। তবে ভ্রমণ তেমন আরামদায়ক হবে না। সুনামগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে সাহেববাজার ঘাট পর্যন্ত রিকশায়। সেখান থেকে টাঙ্গুয়া হাওরের উদ্দেশে ইঞ্জিনচালিত নৌকা।
নীল আকাশ যেখানে পানির সঙ্গে খেলা করে, সাদা মেঘ যেখানে পাহাড়ের কোলে ঘুমায়, গাছের সারি যেখানে প্রতিনিয়ত সবুজ পানিতে গোসল করে, আর পানির নিচে যেন রঙিন বনের বসতি। সূর্যমামা আগে এখানে ওঠে, তারপর হাসে; তাড়াহুড়ো করে চাঁদ এসে জলের আয়নায় তার রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে থমকে দাঁড়ায়; ঢেউয়ের কোলে দুলতে দুলতে ঘুমিয়ে পড়ে তারার সারি। ভাবছেন কাল্পনিক কিছু বলছি? না, এক দমই না- এ জায়গাটার নাম হলো টাঙ্গুয়া হাওর। এটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষিত। সুনামগঞ্জের সাহেববাজার ঘাট থেকে ইঞ্জিন নৌকা চারপাশের চৌহদ্দি ছাড়ানো সবুজ দেখে আপনি ভুল করে ভেবে বসতে পারেন যে নিউজিল্যান্ডের কোথাও আছেন। সুরমা নদীর ওপারেই মেঘালয়ের পাহাড় মেঘ কোলে নিয়ে অতিথির জন্য বসে আছে। চোখের সামনে ঠিক যেন নিউজিল্যান্ডের ডেইরি ফার্মের গরুগুলো ঘাস খাচ্ছে। তাদের পেছনে বাঁক খেয়ে ওঠে গেছে পাহাড়ের দেয়াল। যতদূর চোখ যায়, সবুজের মুখমণ্ডল। নিচে নীলচে পানি, পানির নিচে শেওলার অস্তিত্ব পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। নলখাগড়ার ডগা ভেসে ভেসে ঢেউয়ের দোলায় নাচছে হাওরজুড়ে। মাছ আর পাখির অভয়াশ্রম টাঙ্গুয়া হাওর। সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলার মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে এ হাওরের অবস্থান। এর আয়তন ৯ হাজার ৭২৭ হেক্টর। শীত মৌসুমে পানি শুকিয়ে গেলে প্রায় ২৪টি বিলের পাড় জেগে উঠলে শুধু কান্দার ভেতরের অংশই আদি বিল থাকে। আর শুকিয়ে যাওয়া অংশে কৃষকরা রবিশস্য আবাদ করে। টাঙ্গুয়ার হাওরের জীব-বৈচিত্র্যের মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন জাতের পাখি। স্থানীয় বাংলাদেশি জাতের পাখি ছাড়াও শীতকালে, সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আগত পরিযায়ী পাখিরও আবাস এই হাওর। এ হাওরে প্রায় ৫১ প্রজাতির পাখি বিচরণ করে। পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বিরল প্রজাতির প্যালাসেস, ঈগল, বড় আকারের গ্রে-কিংস্টক রয়েছে এই হাওরে। স্থানীয় জাতের মধ্যে শকুন, পানকৌড়ি, কালেন, বৈদর, ঢাহুক, বালিহাঁস, গাঙচিল, বক, সারস, কাক, শঙ্খচিল, জলকুটকুট এই হাওরের ২৮ থেকে ২৯ শতাংশ ইত্যাদি পাখির নিয়মিত বিচরণ এই হাওরে। এ ছাড়া আছে বিপন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। এ ছাড়া ছয় প্রজাতির স্থন্যপায়ী প্রাণী, চার প্রজাতির সাপ, বিরল প্রজাতির উভচর, ছয় প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটিসহ বিভিন্ন রকমের প্রাণীর বাস। এসব পাখি হাওরের জীব-বৈচিত্র্যকে করেছে ভরপুর। ১৯৯৯ সালে পরিবেশ-প্রতিবেশগত দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে বিশেষ সরকারি ব্যবস্থাপনার অধীনে আনা হয় টাঙ্গুয়ার হাওরকে। উদ্দেশ্য এখানকার প্রাণীবৈচিত্র্য সংরক্ষণ, হাওরপাড়ের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন। ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি এটি লাভ করে বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইটের মর্যাদা। হাওরের দেখভালের দায়িত্ব পায় জেলা প্রশাসন। হাওরপাড়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঐতিহ্যবাহী হাওরটি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। *মাসুম হেলাল, সুনামগঞ্জ