১৭ আগস্ট, ২০১৬ ১৩:০০
ধারাবাহিক উপন্যাস

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান পর্ব ১৩

রণক ইকরাম


অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান পর্ব ১৩

 


 পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা শাসক তিনি। মুসলিম শাসকদের মধ্যেও সবার শীর্ষে সুলতান সুলেমান খান। অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্যের শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে ছিল রাজ্যের সেরাগ্লিও বা হেরেম। এটা কেবল সুলতানের মনোরঞ্জনের ক্ষেত্রেই নয়, রাজ্যের ক্ষমতাশালী সব নারীর বসবাসই ছিল এখানে। আবার কখনো কখনো সাধারণ যৌনদাসী থেকে সুলতানা হয়ে বিশ্ব কাঁপিয়েছেন কেউ কেউ। সুলতান সুলেমানকে নিয়ে অনেক গল্প লেখা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে আলোচিত-সমালোচিত টিভি সিরিয়াল মুহতাশিম ইউজিয়েল। আমাদের এই উপন্যাসের ভিত্তি সেই টিভি সিরিজ বা গল্প উপন্যাস নয়। মূলত ইতিহাসের নানা বইপত্র ঘেঁটে সুলতান সুলেমানের আমলটি তুলে ধরার চেষ্টা। ইতিহাস আশ্রয়ী এই উপন্যাসের মূল ভিত্তি অটোমানদের ইতিহাস। বাকিটুকু লেখকের কল্পনা।

 
উপন্যাসের শুরুর দিকে যুবরাজ সুলেমানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন পাঠক। সিংহাসনে তখন সুলেমানের বাবা সুলতান প্রথম সেলিম। সুলতান সেলিমের সর্বশেষ বিজয়, অসুস্থতা ইত্যাদি পথপরিক্রমায় অটোমান সুলতান হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন সুলেমান খান। এর মধ্যেই হেরেম সংস্কৃতি, প্রাসাদ, প্রশাসনসহ নানা দিক উঠে এসেছে। সুলেমান খানের ক্ষমতা গ্রহণের পর নতুন সূর্যোদয়ের দিকে হাঁটতে শুরু করে অটোমান সাম্রাজ্য। সে যাত্রায় পীরে মেহমুদ পাশাকে স্বপদে বহাল রেখে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন সুলতান। সবার প্রত্যাশার বাইরে পারগালি ইব্রাহীমকে বানিয়েছেন নিজের খাসকামরা প্রধান। এর মধ্যেই সুলতানের জীবনে যৌনদাসী থেকে প্রিয়পাত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন আলেকজান্দ্রা। এবারের পর্বে দেখা যাবে ফরাসি দূতের আগমনকে কেন্দ্র করে সবার ব্যস্ততা ও ইব্রাহীমের ব্যক্তিগত ভাবনা। প্রতি শনিবারের এ বিশেষ আয়োজনে আজ ছাপা হলো ত্রয়োদশ পর্ব।


[পূর্ব প্রকাশের পর]

তোপকাপি প্রাসাদের চারদিকেই উৎসবের আমেজ। প্রাসাদের তিন ভাগ বাইরুন, এন্ডেরুন এবং মেয়বেনের দেয়ালগুলো নতুন সুলতান আসার পরপরই নতুন করে রং করা হয়েছে। প্রাসাদের সবচেয়ে ভিতরের আঙ্গিনা এন্ডেরুনের ঠিক পাশেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রাসাদের হারেম। হারেমের গেটে শোভা পাচ্ছে লাল-নীল কাগজের নান্দনিক সজ্জা। প্রাসাদের বাহিরের আঙ্গিনা বাইরুন বা মেয়বেন-ই-হুমায়ুনের ফুলগাছগুলোও যেন সব উৎসবে নাম লেখানোর জন্য নিজেদের উজার করে দিচ্ছে। প্রায় সব গাছেই রঙিন সব ফুল। বাইরে দাঁড়ানোর পর অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে কোলাহলপূর্ণ মনে হবে হারেমের আঙিনা। ভিতর থেকে কঙ্কুবাইনদের হাসি-ঠাট্টা আর গল্প-গুজবের আওয়াজ শোনা যায় নিমিষেই। ফাঁকে ফাঁকে দানা হালিল বাহিনী বা পাহারাদার খোজাদের গর্জনও শোনা যায়। সব আয়োজন সুলতানের নির্দেশেই। উপলক্ষটা খুব বড় না হলেও সুলতানের নির্দেশ অমান্য করার লোক এখানে নেই।

ফ্রান্স থেকে প্রথম ফ্রান্সিস অ্যান্টনিও রিকনসহ একদল শুভেচ্ছা দূত পাঠিয়েছেন। তাদের সামনে অটোমানদের শৌর্যবীর্য আর আভিজাত্য দেখানোর নির্দেশ দিয়েছেন সুলতান সুলেমান খান। সেইসঙ্গে রয়েছে তাদের আদর-আপ্যায়নের সুব্যবস্থাও। ব্যস্ততা অটোমানদের রান্নাঘরেও। সাধারণ অতিথি হলে মাতবাহ-ই-আমিরে রান্নার ব্যবস্থা হতো। কিন্তু বিশেষ এই অতিথির জন্য রান্না হচ্ছে কুসেন বা মাতবাহ্-ই-হুমায়ুনে। এটি রাজকীয় রান্নাঘর হলেও এখানে কেবলমাত্র সুলতানের জন্যই রান্না করা হয়। সুলতানের রান্নাঘরের বাবুর্চিরা সব বিশেষ বিশেষ ধরনের খাবারে পারদর্শী। সুলতান নিজে মিষ্টি খেতে খুব পছন্দ করেন। অতিথি আপ্যায়নেও মিষ্টিজাতীয় খাবারের জুড়ি নেই। তাই এখানকার তাতলাসি বা মিষ্টান্ন জাতীয় খাবার তৈরিতে পারদর্শীদের ব্যস্ততা সবচেয়ে বেশি। মাছ জাতীয় খাবারের বাবুর্চি বালিক্সিদের ব্যস্ততাও চোখে পড়ার মতো। আরও আছে হামুরসু বা রুটি ও আনুষঙ্গিক খাবার তৈরির কারিকরদের ব্যস্ততা।

হারেমের ভিতর ব্যস্ত সময় পার করছেন দানা হালিল। সন্ধ্যায় অতিথিদের সম্মানে সংগীত ও নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সে আসরে স্বয়ং সুলতান উপস্থিত থাকবেন। তাই হারেমের মেয়েদের নিয়ে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছেন। সেদিক দিয়েই যাচ্ছিলেন খাস কামরা প্রধান পারগালি ইব্রাহীম। সুলতানের নির্দেশে হেঁশেল থেকে হারেম পর্যন্ত সব জায়গায় তদারকি করছেন ইব্রাহীম। হারেমের অন্দরে অন্যদের প্রবেশে কড়া নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ইব্রাহীমের ব্যাপারে তেমন কোনো নিয়ম নেই। ভিতরে এসেই সব মেয়ের ভিড়ে আলেকজান্দ্রাকে দেখে চমকে উঠলেন ইব্রাহীম। অন্য সব মেয়ের ভিড়ে তাকেও নাচের জন্য প্রস্তুত করছেন দানা হালিল। ইশারায় হারেমের প্রধান কর্মকর্তা ও রক্ষী দানা হালিলকে কাছে ডাকলেন পারগালি। কুর্নিশ করে সামনে দাঁড়াতেই জিজ্ঞাসা করলেন,

‘সব ঠিকঠাক?’

‘জি জনাব। আশা করছি রাতের অনুষ্ঠান খুব জমজমাট হবে।’

‘হুমম।’

আলেকজান্দ্রার দিকে এক পলক তাকালেন পারগালি ইব্রাহীম। তারপর বললেন,

‘সে কী নাচবে?’

‘কার কথা বলছেন ইব্রাহীম? আলেকজান্দ্রা?’

‘হুম।’

‘জি। সে কিন্তু দারুণ নাচে।’

‘না। ওকে অনুষ্ঠানে রাখার দরকার নেই।’

‘কিন্তু...’

মুহূর্তের মধ্যেই চোখ গরম করে ফেললেন পারগালি ইব্রাহীম। খাস কামরা প্রধানের তীব্র চাউনির সামনে আর কিছু বলতে পারলেন না দানা হালিল। অল্পতেই চুপসে গেলেন। তখনই সেদিকে এগিয়ে এলো ইসাবেলা। তাকে দেখে আস্তে করে চোখ নামিয়ে নিলেন ইব্রাহীম। কাছে এসে ইব্রাহীমকে কুর্নিশ করল ইসাবেলা। তারপর ইব্রাহীমের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘হুজুর, আমি ইসাবেলা।’

‘হুম, বল কী সমস্যা?’

ইব্রাহীমের সরাসরি জবাব। অবশ্য এমন কাঠখোট্টা জবাব আসবে আগেই জানত ইসাবেলা। তাই সে এতটুকু বিচলিত হলো না। বরং আলেকজান্দ্রার শিখিয়ে দেওয়া আচরণেই মন দিল সে।

‘না। আমি আপনাকে সব সময় দূর থেকে দেখি। কখনো কথা বলার সুযোগ হয়নি। ভয়ে আপনার সামনে আসিনি।’

এবার একটু গলে এলেন ইব্রাহীম। একজন মানুষ যখন নিজে ভয়ের কথা বলে তখন আর তার সামনে ভয়াল পরিস্থিতি তৈরির কোনো মানে হয় না।

‘আমায় ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আমি অন্য আট-দশজনের মতোই সাধারণ মানুষ।’

‘আপনি সাধারণ হবেন কেন? আপনি মহান সুলতানের খাস কামরা প্রধান।’

‘সেটা আমার পদবি। এর বাইরে আমি কেবলই একজন সাধারণ মানুষ।’

‘আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লেগেছে। তবে একটা কথা বলার জন্য আমি এখানে এসেছি। আপনি অভয় দিলে সেটি বলতে পারি।’

‘বলে ফেল।’

‘আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে জনাব।’

জবাবে মুচকি হাসলেন ইব্রাহীম।

‘ধন্যবাদ।’

হাসি হাসি মুখে একটু পেছনে তাকাতেই দেখলেন সুরুর সায়রা দাঁড়িয়ে। ইব্রাহীমের মনটা বিচলিত হয়ে উঠল। সুলতানের খাস কামরা প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে শুধু কাজ আর কাজ। এর মধ্যে সায়রার কথা এক প্রকার ভুলেই গিয়েছিলেন। আজ দেখা হয়ে গেল। তাও এমন একটা মুহূর্তে যখন ভিন্ন একটা নারী ইব্রাহীমের সামনে দাঁড়িয়ে তার প্রশংসা করছে। নিজেকে সামলে নিলেন ইব্রাহীম। তারপর দানা হালিলের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন,

‘সায়রা মেয়েটাকে আমার কক্ষে পাঠিয়ে দাও। ওর সঙ্গে আমার একটু আলাপ আছে।’

দানা হালিল সায় দিতেই নিজের কক্ষের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন ইব্রাহীম।


বালিদ সুলতান আয়েশা হাফসার সামনে বসে আছেন সুলেমান। মাহিদেভরানের পক্ষ নিয়ে সুলেমানকে কিছু বলার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু সুলেমান কৌশলে এড়িয়ে গেল। নিজের ব্যস্ততা আর রাজ্য নিয়ে তার ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করল। সঙ্গে এও জানাল এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার ব্যাপারে সে আগ্রহী নয়। এরপর কিছু দমে গেলেন আয়েশা। সুলেমান নিজেও বুঝতে পারলেন মায়ের সঙ্গে ব্যবহারটা একটু বেশিই কর্কশ হয়ে গেছে। নীরবতা ভেঙে তাই নরম সুরে মাকে বললেন,

‘আম্মা। তুমি কী আমার কথায় কষ্ট পেলে?’

‘নাহ! কষ্ট কেন পাব?’

সব সামলে সহজ হতে চাইছেন আয়েশা।

‘দেখ আম্মা আমাকে কত ব্যস্ত থাকতে হয়। আমি কতটুকুই বা সময় পাই? আর মাহিদেভরানের এমন সমস্যা নতুন নয়। মানিসায় থাকাকালেও তুমি দেখেছ সে অযথাই মন খারাপ করে বসে থাকে। এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো ফালতু সময় কী আর আমার হাতে আছে?’

‘তা নেই। কিন্তু তাই বলে তোমার ভুলে গেলে চলবে না সে তোমার বিবাহিত স্ত্রী। তারও কিন্তু তোমার কাছে অনেক প্রত্যাশা আছে। স্বামী হিসেবে তুমি কোনোভাবেই সেগুলো অস্বীকার করতে পার না। আর যেহেতু সুলতান হয়েছ, তাই বাড়তি চাপ তোমাকে নিতেই হবে।’

‘ঠিক আছে আম্মা। তুমি যেভাবে বলবে সেভাবেই হবে।’

বলেই সহজাত হাসি হাসল সুলেমান। সুলেমানের সে হাসি ছুঁয়ে গেল মা আয়েশা হাফসাকেও। একটু আগের গম্ভীর পরিস্থিতিটা সহজেই ঠিক হয়ে গেল।

‘শুনলাম ফ্রান্সের রাজকীয় অতিথির জন্য তুমি বিশাল আয়োজন করেছ।’

‘জি আম্মা। আমি চাচ্ছি ওদের অটোমানদের মহানুভবতা ও রাজকীয় আভিজাত্যের একটা ঝলক দেখিয়ে দিতে। সেভাবেই সবাইকে প্রস্তুতি নিতে বলেছি।’

‘ফরাসিদের নিয়ে কী তোমার বিশেষ কোনো পরিকল্পনা আছে?’

‘না। তেমন কিছু নয়। তবে ওদের আচরণ বন্ধুভাবাপন্ন।’

‘ভুলে যেওনা অমুসলিমরা কখনোই মুসলিমদের ভালো বন্ধু হতে পারে না। ওরা তো খ্রিস্টান। তাই ওদের কাছ থেকে সাবধান থাকাই ভালো।’

‘সেটা আমার মাথায় আছে। তবে কৌশলগত কারণেই প্রথম ফ্রান্সিস আমার কাছে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছেন। আমি যদি অটোমানদের পতাকা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চাই, তাহলে আমাকে অনেক বেশি কৌশলী হতে হবে। বলতে পারেন সেই কৌশলের একটা অংশ হিসেবেই ফরাসি দূতদের আলাদা খাতির যত্ন করা হচ্ছে।’

‘হুম। তোমার বাবাও কৌশলের কথা বলতেন। যে কোনো কিছু করার আগে থেকেই তার কোনো না কোনো পরিকল্পনা থাকত। তোমার কথা শুনে আশ্বস্ত হলাম। মনে হচ্ছে তোমার বাবার অভ্যাসটাই যেন তোমার মধ্যে কাজ করছে।’

‘ধন্যবাদ আম্মা। আমার সব সময় চেষ্টা থাকবে আপনার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করার। সেই সঙ্গে বাবার সব স্বপ্নও সফল করতে চাই।’

‘আমি জানি তুমি সেটা পারবে। আমার বিশ্বাস তোমার হাত দিয়েই অটোমানদের পতাকা ছড়িয়ে পড়বে সমগ্র বিশ্বময়।’

‘ইনশাআল্লাহ।’

মায়ের প্রত্যাশার সঙ্গে নিজের সমর্থন প্রকাশ করলেন সুলতান। চোখের সামনে তার স্বপ্ন খেলা করছে। গোটা পৃথিবী এক পতাকাতলে। আর সেই পতাকার ধারক ও বাহক হয়ে সুলেমান সারা বিশ্বে ন্যায় ও আদর্শের শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন। সুলেমান জানেন সেই স্বপ্নটা পূরণ করা অনেক কঠিন। কিন্তু অসম্ভব নয়। একটু চেষ্টা আর উদ্যম থাকলেই হয়তো স্বপ্নটাকে ছোঁয়া যাবে নিমিষেই।


সুরুর সায়রা কক্ষে আসার পর থেকেই তার দিকে এক দৃষ্টে অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকল পারগালি ইব্রাহীম। দুজনের কারও মুখেই কোনো কথা নেই। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সায়রা। ইব্রাহীমই নীরবতা ভাঙলেন।

‘কেমন আছ?’

‘জি ভালো।’

‘আমাকে কী ভুলে গেছ?’

‘জি না। আপনিইতো ভুলে গেছেন।’

মুখ না তুলেই জবাব দিল সায়রা।

‘নিচের দিকে তাকিয়ে কথা বলছ কেন? মুখ তুলে তাকাও।’

‘এখনতো আপনি সুলতানের খাস কামরা প্রধান। এখন আপনার দিকে তাকাতেও ভয় হয়।’

‘আমিই তোমাকে অনুরোধ করছি। তাকাও।’

‘লাজুক দৃষ্টি নিয়ে ইব্রাহীমের দিকে তাকাল সায়রা।’

আরেকবার মুগ্ধতার দৃষ্টি ইব্রাহীমের। ভিতরকার রাজকীয় মনটা কোথায় যেন  উড়ে গেছে। সব ভুলে কেবল সায়রাতে নিমগ্ন হতে চাইছে ইব্রাহীমের নরম মনটা। ইব্রাহীমের এতদিনের জীবনের পুরোটাজুড়েই সুলেমানের বসবাস। সেই শৈশবে পরিচয়ের পর থেকে নিজেকে সুলেমানের সেবায় উৎসর্গ করার কথাই ভেবেছে কেবল। নিজের জীবন-ভবিষ্যৎ-স্বপ্ন কোনো কিছু নিয়েই কখনো ভাবেনি। নিজের বাবা আর ভাইয়ের কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে বটে। কিন্তু সেদিকে যাওয়ার সুযোগ কখনো আসেনি। কিন্তু আজ সায়রার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ইব্রাহীমের ভিতরের প্রেমিক মনটা যেন জেগে ওঠেছে। ওকে নিয়ে ঘর বাঁধার একটা স্বপ্নও মনের ভিতর উঁকি দিচ্ছে। এসব সম্ভব কিনা জানে না ইব্রাহীম। এরপরও মনের ভিতর কেবলই হাজারো ভাবনার ডুবসাঁতার!

‘কী ভাবছেন?’

ইব্রাহীমের মুগ্ধতার দৃষ্টিতে বাদ সাধল সায়রা।

‘না কিছু না। সত্যি তুমি অনেক অপূর্ব।’

‘ইসাবেলা আমার চেয়েও বেশি সুন্দর।’

সায়রার কণ্ঠে কৃত্রিম রাগ। একটু অন্যমনস্ক ছিলেন ইব্রাহীম। তাই ইসাবেলাকে চিনতে পারলেন না।

‘ইসাবেলা যেন কে?’

‘উমা! এখনি ভুলে গেলেন? একটু আগেই না তার সঙ্গে হেসে কথা বলছিলেন!’

এবার ধরতে পারল ইব্রাহীম।

খানিক আগে ইসাবেলার সঙ্গে কথা বলাটা সহজভাবে নিতে পারেনি সায়রা। মেয়েদের এই এক সমস্যা। প্রিয় পুরুষের পাশে আর কাউকেই সহ্য করতে পারেন না। সায়রার কথা শুনে হেসে ফেললেন ইব্রাহীম।

‘তোমার বুঝি খারাপ লেগেছে?’

‘কী?’

‘ইসাবেলার সঙ্গে কথা বলাটা?’

‘নাহ! খারাপ কেন লাগবে। আপনি সুলতানের খাস কামরা প্রধান। আপনি যে কারও সঙ্গেই কথা বলতে পারেন। তাতে আমার কেন খারাপ লাগবে?’

‘কেন? আমি কী তোমার কেউ নয়?’

ইব্রাহীমের এমন প্রশ্নের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সায়রা। কী উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছে না সে। তখনই বাইরে দানা হালিলের গলার শব্দ শোনা গেল। দৃষ্টিসীমার বাইরে থেকেই সে বলল,

‘হুজুর আসতে পারি?’

ইব্রাহীম একটু বিরক্ত হলো। কিন্তু জরুরি না হলে এমন সময় হারেমের প্রধান রক্ষী এখানে আসত না। তাই তাকে ভিতরে আসার অনুমতি দিল।

‘সুলতান সুলেমান খান আপনাকে স্মরণ করেছেন।’

‘তিনি কোথায় আছেন?’

‘খাস কামরায়।’

‘আচ্ছা যাচ্ছি।’

বলেই সায়রার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলেন ইব্রাহীম। সুলতান কী কারণে ডেকেছেন কে জানে?


‘সন্ধ্যায়তো বিশাল অনুষ্ঠান। আপনি যাবেন না মালিকা?’

মাহিদেভরানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল সারা খাতুন।

‘না। বাইরের অতিথিরা থাকবেন। ভিতরের নারীদের সেখানে যাওয়া নিষেধ আছে।’

‘ও।’

একটু হতাশ মনে হলো সারা খাতুনকে। বিষয়টা টের পেলেন মাহিদেভরান।

‘কেন তুমি কী যেতে চাও?’

‘না মালিকা। আপনি না গেলে আমিও যাব না। এমনি শুনেছি পুরো তোপকাপি প্রাসাদই নাকি উৎসবের সাজে সেজেছে। সেজন্য একটু আগ্রহ হয়েছে আর কি।’

‘তুমি চাইলে যেতে পার। তোমার যেতে কোনো বাধা নেই। একটু ঘুরে আসলে ভালো লাগবে।’

‘না মালিকা। আপনিই আমার সব। আপনাকে একা রেখে আমি কোথাও যাব না।’

‘একা আবার কী? অল্প কিছুক্ষণেরই তো বিষয়। একটু ঘুরে আস সমস্যা নেই।’

‘আচ্ছা মালিকা।’

সারা খাতুনকে বেশ খুশি মনে হলো। সারা খাতুনের দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে গেলেন মাহিদেভরান। কী অদ্ভুত এই মানুষগুলোর জীবন। এরা কত অল্পতেই খুশি হয়। অথচ মাহিদেভরানের সব থেকেও যেন কিছু নেই। জানালা দিয়ে দূরের আকাশের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন মাহিদেভরান। পেছনে অটোমানদের ঐশ্বর্য, সুলতান সুলেমানের ব্যস্ততা আর মাহিদেভরানের একরাশ দীর্ঘশ্বাস।

 
চলবে... পরবর্তী পর্ব আগামী শনিবার


বিডি-প্রতিদিন/১৭ আগস্ট, ২০১৬/মাহবুব

সর্বশেষ খবর