অত্যন্ত ক্লান্ত। নিউইয়র্ক থেকে দোহা প্রায় ১২ ঘণ্টার দূরত্ব। কাতার বায়ুযান এর ভ্রমণ। ক্লান্তি এতই বেশি বোধ হচ্ছিল যে, দোহাতে আড়াই ঘণ্টার বিরতিতে কোনো ডিউটি-ফ্রি শপে যাওয়ার আনন্দও পাচ্ছিলাম না। মনটা খুব খারাপ। ছেলেকে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে দিয়ে এসেছি। সব মিলে ষাটোর্ধ্ব একজন বাঙালির যা হওয়ার তাই। দোহা-ঢাকা বিমানে উঠার আগেই আবার একটু ব্যথানাশক ওষুধ খেয়ে নিলাম। বিমানে উঠেই ঘুমাব দৃঢ়সংকল্প। ভ্রমণের সময় রাত ১১টা থেকে ভোর ৪টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত। সুতরাং বাংলাদেশি হিসেবে নিবিড় ঘুমের সময়। বিপত্তি হলো, পাশের সিটের যাত্রী অত্যন্ত ভালোলোক। স্বাধীনতার পক্ষের লোক। নিজেকে একজন দক্ষ কর্মকর্তাই ভাবেন। কোনো দাম্ভিকতা নেই। আসনে বসেই জিজ্ঞেস করলেন, আপনি বাংলাদেশি? জবাবে হ্যাঁ বলতেই জিজ্ঞেস করলেন, নাম কী? নাম বলতেই বললেন, আপনার নাম অনেক শুনেছি। পরের প্রশ্নে ভদ্রলোকের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ আরও বেড়ে গেল। প্রশ্নটা ছিল, আপনার কি স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা মনে আছে? আমি পরিচয় জানতে চাইলে তিনি জানালেন, ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনে (আইএফসি) কাজ করেন। সাত মাসের জন্য মিসরের কায়রোতে একটা অ্যাসাইমেন্টে গিয়েছিলেন। কাজ শেষে বাড়ি ফিরছেন। বাবার চাকরির সুবাদে তার জন্ম ফরিদপুরে এবং সেখানেই বেড়ে ওঠা। আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। তাই স্বাধীনতার প্রতি এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি আগ্রহ। সাধারণত এই প্রজন্ম এ রকম শোনতে চাওয়া দূরের কথা, শুনাতে চাইলেও আগ্রহ নেই।
এখন আমার বলার পালা। বললাম, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অর্থাৎ ১৯৭১ সালে আমি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। যেখানে ছাত্রলীগ ছিল একটি বলিষ্ঠ ও গরিষ্ঠ সংগঠন। তেমনি ইসলামী ছাত্রসংঘও (আইসিএস) মোটামুটি একটি শক্তিশালী সংগঠন ছিল। ছাত্রলীগের পরের অবস্থান ছিল অগ্রগামী নামক একটি সংগঠনের, তারপরেই ছিল আইসিএস-এর অবস্থান। চতুর্থ অবস্থানে ছিল ছাত্র ইউনিয়ন। ছাত্রলীগ শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে, স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী জাতীয় রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন হিসেবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের মধ্যে অনেক বেশি মুক্তিযোদ্ধার জন্ম হয়েছিল। তেমনি তুলনামূলকভাবে বেশ আলবদর সদস্য ও সৃষ্টি হয়েছিল, এই মেডিকেলের ইসলামী ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের মধ্যে থেকে। এমবিএ করা এই ভদ্রলোক তীক্ষ্ন দৃষ্টি নিয়ে, একাগ্রচিত্তে আমার কথাগুলো শুনলেন। আমি যখন বললাম ঢাকা শহর ২৫শে মার্চ শেষ রাতে পাকিস্তানি বর্বরদের নিষ্ঠুর আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে, সান্ধ্যআইনের মাধ্যমে তাদের দখলে চলে যায়। ঠিক তেমনি ৩১শে মার্চ ভোর পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহর (ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া) স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দখলে ছিল। ভদ্রলোকের চেহারা দেখে মনে হলো তিনি তা জানতেন না। পঞ্চাশের কোঠায় যার বয়স তার এ বিষয়টি অজানা। তাও ভালো; বিকৃত ইতিহাস তো শিখেনি।
আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, মুজিববাহিনীর সদস্য বলতেই, উনার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। ভদ্রলোকের জানার আগ্রহ, আমাকে এতই বিমোহিত করল যেন, বহুদিন পরে একজন শ্রোতা এবং সত্যিকার স্বাধীনতাপ্রিয় ব্যক্তিকে পেলাম যে স্বাধীনতার গল্প শুনতে চায়। আমার বলার মধ্যেই ভদ্রলোক তার বড় ভাইয়ের এক ঘটনার কথা বললেন। তার বড় ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আশির দশকে। একবার বাড়িতে এসে, খাবার টেবিলে বসে, তার বাবার সামনে বললেন, আসলে ভারত পাকিস্তানকে যুদ্ধে পরাজিত করে এই ভূখণ্ডটি আলাদা করে দিয়েছে। ওই সময়ে কিছু উচ্ছৃঙ্খল যুবক এবং ভারতীয় এজেন্ট ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করে পাকিস্তান ভেঙে দিয়েছে। এতে শুধু ভারতের লাভ হয়েছে। কথা শেষ না করতেই তার সাব ওভারশিয়ার বাবা, ভাত মাখা হাতে তার গালে সজোরে এক চড় বসিয়ে দেন এবং সভ্য ভাষায় গালিগালাজ করে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, চোঙ্গামার্কা জামা কাপড় পরে এই শিক্ষাই পেয়েছ? একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ওই বাবাকে আমি প্রণাম জানাচ্ছি। হাজার বার সালাম দিচ্ছি। কেননা, এ রকম বাবাই আমাদের প্রয়োজন ছিল। যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে খাবার দিয়েছিলেন। রাতের অন্ধকারে আশ্রয় দিয়েছিলেন। বুদ্ধি এবং শারীরিক, মানসিক সহায়তা দিয়ে নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করে দিয়েছিলেন। এ রকম বাবা-মার ছেলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আশির দশকে স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে এমন ধারণা কেন পোষণ করলেন সেটাই বড় প্রশ্ন? এ জন্য দায়ী লে. জে. জিয়াউর রহমান। যিনি তৎকালীন ইসলামী ছাত্র সংঘ তথা ছাত্র শিবিরকে রাজনীতি করার জন্য সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সশস্ত্রশক্তি সৃষ্টিতে সাহায্য করেছিলেন। তাদেরকে স্বাধীনতাবিরোধী রাজনীতি করার জন্য অভয়ারণ্য সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। তাদের নেতাদের রাজনীতির ক্ষমতায় এনে পেঁৗছিয়ে দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা সামরিক এবং বেসামরিক লোককে হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতির বাধা দেওয়ার শক্তিকেও অপসারণ করে দিয়েছিলেন। যার ফলাফল তাকেও ভোগ করতে হয়েছে। পরে সহযাত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, এখন আপনার ভাই কী করে? বাংলাদেশের প্রথম জেনারেশন ব্যাংক সিটি ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে ব্যাংকিং ক্যারিয়ার করেছেন। বর্তমানে পরবর্তী জেনারেশনের একটা ব্যাংকে উচ্চ পদস্থ পদে কর্মরত আছেন।
জিজ্ঞেস করলাম, এখন কি আপনার ভাই স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে এরকম ধারণা পোষণ করেন? উনি কি স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত? তিনি জানালেন, আমরা সবাই আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বাপের এক থাপ্পড় এত সহজে একজনের ধোলাই মগজ পুনর্বিন্যস্ত করে দিতে পারে এ চিকিৎসা সম্পর্কে, চিকিৎসক হিসেবে আমার কোনো ধারণা ছিল না। তবে চিরন্তন বাক্য 'মাইরের উপর কোনো দাওয়াই নেই। আবারও সত্য প্রমাণিত হলো। একই রকম একটা ঘটনা আমার চোখের সামনে ঘটেছে। ওইখানে থাপ্পড় প্রয়োজন হয়নি, ধমকই যথেষ্ট ছিল। আমার এক সিনিয়ার ভাই, মুক্তিযোদ্ধা, এমবিবিএস ৩য় বর্ষের ছাত্র। একটি রাজনৈতিক আলোচনা সভায় বসে বলতে শুরু করেছিলেন, গণ্ডগোলের সময়...। এ পর্যন্ত বলতেই আমাদের প্রিয় নেতা শহীদ শেখ ফজলুল হক মণি ভাই বললেন, 'গণ্ডগোল নয়, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়।' 'স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়' এ কথাটা এত চিৎকারের সঙ্গে বলেছিলেন, জীবনে এ ভুল উনি আর কোনোদিন করেননি। সত্যিকার অর্থে আদর্শ পিতা বা নেতার আদর্শ, মগজের ভিতরে ঢুকতে বেশি সময় লাগে না। শুধু দরকার সময়োপযোগী সত্যিকার ইতিহাস শিক্ষা দেওয়া। ভুল ইতিহাস সংশোধন করা। বাঙালির ত্যাগের ইতিহাস তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস জানতে হলে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বাঙালির ভূমিকা এবং ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১-এর বিজয় পর্যন্ত আমাদের সংগ্রামী ইতিহাস, পাঠ্যপুস্তকে সন্নিবেশিত করাই বোধ হয় অপরিহার্য। এই বঙ্গভূমির, বঙ্গ সন্তানরা যে কত ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তা প্রতিটি বাঙালির জানা উচিত, হৃদয়ে ধারণ করে লালন করা, মানুষ হিসেবে মনুষ্যত্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।