স্থানীয় নেতৃত্ব সৃষ্টি এবং অংশীদারিত্ব ও জবাবদিহিতামূলক প্রশাসনের ধারণা থেকেই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার উৎপত্তি। বাংলাদেশে শহর বা নগরকেন্দ্রিক এক ধরনের স্থানীয় সরকার এবং গ্রামকেন্দ্রিক আরেক ধরনের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান। পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশনগুলো প্রথম ধরনের অন্তর্ভুক্ত এবং জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদগুলো দ্বিতীয় ধরনের অন্তর্ভুর্ক্ত। ঢাকা দক্ষিণ এবং উত্তর সিটি করপোরেশন দুটি দীর্ঘদিন ধরে সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত হওয়ার পর গত ২৮ এপ্রিল ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং সেই সঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন যেনতেনভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে। বেলা ১০টার মধ্যে বিপুলসংখ্যক কেন্দ্র দখল হয়ে যাওয়ায় বিএনপি নির্বাচনকে প্রহসনমূলক আখ্যায়িত করে তা বর্জন করে। অন্যান্য সিটি করপোরেশনের মেয়রদের মধ্যে সিলেট ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়রদ্বয় বর্তমানে জেলহাজতে আছেন। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র মামলায় জড়িয়ে পলাতক আছেন। তাদের সাময়িক বরখাস্ত করে সরকারদলীয় প্যানেল মেয়র দ্বারা উক্ত সিটি করপোরেশনগুলো পরিচালিত হচ্ছে। কোথাও কোথাও কাউন্সিলররাও সরকারের রোষানলে পড়ে নানা যাতনা ভোগ করছেন। প্রথম আলো পত্রিকার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মামলার জালে জড়িয়ে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের অন্তত ২৫ জন বিএনপি ও জামায়াত সমর্থক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে গত এক বছরে সাময়িক বরখাস্ত কিংবা দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং গ্রেফতারের ভয়ে সমসংখ্যক জনপ্রতিনিধি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ তথ্য অস্বাভাবিক ও উদ্বেগজনক বলে ২৮ মার্চ, ২০১৫ তারিখে প্রকাশিত দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামে মন্তব্য করা হয়েছে। কিন্তু একই অভিযোগে অভিযুক্ত ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ উচ্চ আদালতে আপিল করে কিংবা স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে ছুটি নিয়ে স্বপদে বহাল রয়েছেন বলে উক্ত সম্পাদকীয় কলামে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু জনমনে যদি ধারণা জন্মে যে এরা বিএনপি কিংবা জামায়াতপন্থি হওয়ায় এদের হয়রানি করা হচ্ছে তখন উক্ত আপ্তবাক্যে বিশ্বাস রাখা দায়। যখন মানুষ দেখে যে, একজন নির্বাচিত মেয়র বা কাউন্সিলরকে যে কোনো মামলায় জড়িয়ে গ্রেফতার করা যায় তখন তাদের প্রতি মানুষের উঁচু ধারণা পোষণ করা আশা করা যায় না। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না হলে এ অবস্থার পরিবর্তন আশা করা বাতুলতা। যেসব পৌরসভায় বিএনপি-জামায়াতপন্থি মেয়র ও কাউন্সিলর রয়েছেন তাদেরও একই অবস্থা। এভাবে নির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলরদের অকার্যকর করে ফেলা হচ্ছে যা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে দুর্বল করছে বলে বিজ্ঞজনদের অভিমত। সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক একাংশে জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা শাসিত হওয়ার বিধান আছে। এই বিধানানুসারে ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা পরিষদ এবং জেলা পর্যায়ে জেলা পরিষদ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসিত হওয়ার কথা থাকলেও একাধিক কারণে এগুলো জনপ্রত্যাশা পূরণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। ইউনিয়ন পরিষদ এবং উপজেলা পরিষদ আইনে বর্ণিত উৎসসমূহ থেকে পরিষদগুলো পর্যাপ্ত কর আহরণ করছে না। অন্যদিকে সরকারও পর্যাপ্ত অনুদান বরাদ্দ দিচ্ছে না। আর উপজেলা পরিষদসমূহে এমপিদের উপদেষ্টা করায় পরিষদগুলোকে তাদের অযাচিত হস্তক্ষেপের বিড়ম্বনা সইতে হচ্ছে যা কার্যকর স্থানীয় সরকার বিকাশের পথে এক অন্তরায়। আর জেলা পরিষদে কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই, বরং তিন বছরেরও অধিককাল ধরে সরকার মনোনীত প্রশাসক দ্বারা শাসিত হচ্ছে। আর মনোনীত প্রশাসকদের সবাই দলীয় লোক। এটা দলীয়করণের আর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। জেলা পরিষদ আইন ২০০০ এর ৮২ ধারার (১) উপধারায় জেলা পরিষদ গঠন না হওয়া পর্যন্ত সরকার কর্তৃক প্রশাসক নিয়োগ করার বিধান আছে। উক্ত ধারানুসারে ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর তিনটি পার্বত্য জেলা ব্যতীত দেশের ৬১টি জেলায় সরকার প্রশাসক নিয়োগ করে। প্রশ্ন হলো- জেলা পরিষদ আইন পাস হওয়ার পর এ যাবৎ যারা ক্ষমতাসীন হয়েছেন বা আছেন তারা এতদিন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা কেন পরিষদ গঠন করলেন না? আরও প্রশ্ন হলো- অনির্বাচিত প্রশাসকদের দ্বারা কতকাল জেলা পরিষদ শাসিত হবে? স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান তো দলীয় লোকদের সুবিধা বিতরণের আখড়া হতে পারে না।
উল্লেখ্য, জেলা পরিষদ আইনের ৮২(১) ধারা সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আর সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের ২ উপানুচ্ছেদে বিধৃত আছে জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্য হয়, তাহলে সে আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হবে। সুতরাং জেলা পরিষদ আইনের ৮২(১) ধারা সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় উক্ত ধারাটি শুরু থেকেই বাতিলযোগ্য (Void ab initio)। উল্লেখ্য, প্রশাসক নিয়োগ না করেও নির্বাচনের মাধ্যমে পরিষদ গঠন করা যেত। প্রশাসক নিয়োগের তিন বছরের মধ্যেও নির্বাচনের ব্যবস্থা না করায় প্রতীয়মাণ হয় যে, সরকারের নির্বাচন দেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। প্রশাসক পদটি স্থানীয় সরকার ধারণার সঙ্গে যায় না। সংবিধানের ৭ ধারায় বলা হয়েছে- এই প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। সুতরাং জনগণের প্রতিনিধিদের পরিবর্তে প্রশাসকদের দ্বারা জেলা পরিষদগুলো পরিচালিত হওয়া সংবিধান এবং গণতন্ত্র তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। জেলা পরিষদগুলোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের মনন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিয়েছে।
জেলা পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় প্রশাসকদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। তারা সরকারের অনুগ্রহভাজন ব্যক্তি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন এ কথা তারা ভালোভাবেই জানেন। সুতরাং তারা জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে এই ধারণার বশবর্তী হয়ে প্রকল্প প্রণয়ন এবং যত্রতত্র অনুদান প্রদানে চরম স্বেচ্ছাচারিতা প্রদর্শন করছেন। এসব ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাতিত্ব প্রাধান্য পাচ্ছে। প্রশাসকদের প্রায় সবাই ঢাকায় বসবাস করেন বিধায় প্রায় প্রতি সপ্তাহান্তে পরিষদের গাড়িতে ঢাকায় চলে আসেন এবং সপ্তাহের শুরুতে কর্মস্থলে যান বলে শোনা যায়। ফলে জ্বালানির অপচয় হয়। মনে হচ্ছে এসব দেখার কেউ নেই। কাউকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী করা সুশাসনের পরিপন্থী এবং স্থানীয় সরকার ধারণার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। কথায় আছে- Absolute power corrupts absolutely.
সর্বশেষ জেলা প্রশাসক সম্মেলনে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, সরকার জেলা পরিষদগুলো বিলুপ্ত করার চিন্তাভাবনা করছে। তারপর প্রায় এক বছরের অধিককাল অতিক্রান্ত হতে চলল। নির্বাচন কিংবা বিলুপ্তি কোনোটিরই নামগন্ধ নেই। কাজেই এ ব্যাপারে সরকারের আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। অথচ সরকার বিভিন্ন উপলক্ষে স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করার কথা জোর গলায় বলে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের রাজনীতিবিদদের কথা ও কাজে মিল পাওয়া ভার।
স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে এবং এ ব্যাপারে বহু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কোনো সরকারই এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। কেননা, এ ব্যাপারে সরকারকে কোনো জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। সংসদে প্রকৃতপক্ষে কোনো বিরোধী দল না থাকায় এ নিয়ে সংসদে কোনো আলোচনা-সমালোচনা হয় না। কাগজ-কলমে থাকা সংসদে বিরোধী দল সরকারকে সব ব্যাপারে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। আর অন্যান্য বিরোধী দল এবং সুশীল সমাজের দৃষ্টিনিবদ্ধ এমন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য আন্দোলনের দিকে। উলি্লখিত কারণে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী না হয়ে বরং দুর্বল হচ্ছে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য যা যা করতে হবে- অবিলম্বে জেলা পরিষদগুলোর নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং এ জন্য সংশ্লিষ্ট সব মহলকে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
উপজেলা পরিষদে এমপিদের উপদেষ্টা হিসেবে রাখার বিধান বাতিল করতে হবে এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের করণীয় কাজসমূহ (যেমন- ত্রাণ বিতরণ/বরাদ্দ, নলকূপ বরাদ্দ প্রভৃতি) থেকে এমপিদের বিরত রেখে এমপিতন্ত্রের অবসান ঘটাতে হবে। উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদগুলো যাতে তাদের জন্য নির্দিষ্ট করা খাতগুলো থেকে পর্যাপ্ত কর আহরণ করে তা বিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষ (prescribed Authority) এবং সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে এবং এ জন্য নজরদারি ও তত্ত্বাবধান বাড়াতে হবে।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর জনপ্রতিনিধিরা যাতে কর আহরণে মনোযোগী হয় সে জন্য তাদের বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর জনপ্রতিনিধিরা যাতে সম্পদ আহরণ ও ব্যয়ে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয় সে জন্য তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সংসদ সচিবালয় এবং দলীয় প্রধানদের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট এমপিদের নির্দেশ দিতে হবে যাতে তারা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে অযাচিত হস্তক্ষেপ না করে। আর করলে যেন সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
স্থানীয় সরকারগুলোর জনপ্রতিনিধি এবং এগুলোতে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে যাতে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক এবং অনুকূল কর্মপরিবেশ বিরাজ করে সেজন্য জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বিভিন্ন ব্যাচে যৌথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির নূ্যনতম ৫০% অর্থ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ব্যয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। আশা করি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে কার্যকর ও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সরকার ও বিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষসমূহ সুপারিশমালা বাস্তবায়নে ব্রতী হবেন।
লেখক : সাবেক সচিব।