বুঝতে পারছি না, হঠাৎ করে কি আওয়ামী লীগের রূপ খুলেছে না গুণ বেড়েছে? না আদর্শ পাল্টে গেছে? হঠাৎ করে কী এমন হলো দলে দলে লোক আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছে কেন? বাংলাদেশে দলবদল নতুন নয়। বাংলাদেশের কিছু নেতাই আছেন, যারা আসলে নির্দিষ্ট কোনো দল করেন না, তারা করেন সরকারি দল। '৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে নৈতিক অবক্ষয়ের যে যাত্রা শুরু তা দিনে দিনে বেড়েছেই শুধু। জিয়াউর রহমান যখন উর্দি ছেড়ে রাজনীতিতে আসেন, তখন তিনি বিভিন্ন মত-পথের মানুষকে একত্রিত করে একটি জগাখিচুড়ি দল গঠন করেন। সেই জগাখিচুড়ি দলে সব আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্তি তো একত্রিত হয়েছিলেনই, যোগ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অনেকেই। সেই জগাখিচুড়ি দলটি এখনো বাংলাদেশে আওয়ামী লীগবিরোধী, সাম্প্রদায়িক শক্তির মূল প্লাটফর্ম এবং এ দলটিই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময়, সবচেয়ে বেশিবারই ক্ষমতায় ছিল। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তার দেখানো পথ ধরেই ক্ষমতায় আসেন এরশাদ। একই কায়দায় দলে দলে লোক জাতীয় পার্টিতে যোগ দেয়। কিন্তু এরশাদ পতনের পর জাতীয় পার্টিতে যোগ দেওয়া সেই শত শত নেতা-কর্মী হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। এরশাদ পতনের পর বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যে নবযাত্রা, তাতে রাজনীতিতে শুদ্ধিকরণের যে সুযোগ ছিল, তা আমরা নিতে পারিনি। দলবদল বা জোটবদলে রাজনীতিকে শুদ্ধ করার সুযোগ হারিয়ে যায় সুবিধাবাদের চোরাবালিতে।
জিয়াউর রহমানের বিএনপি বা এরশাদের জাতীয় পার্টিতে দলে দলে যোগ দেওয়ার কারণ তবু বোঝা যায়। কারণ তাদের কোনো আদর্শের বালাই নেই। তারা শুরু করে শূন্য থেকে। দল ভারী করার জন্য লোক হলেই হয়। ক্যান্টনমেন্ট থেকে এলেও তারা নিজেদের পরিচয় দেন 'উদার গণতন্ত্রী' হিসেবে। তারা সত্যি সত্যি উদার। সবার দুয়ার তাদের জন্য খোলা। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো তাদের মতো নয়। আপনার আমার পছন্দ হোক আর না হোক সুনির্দিষ্ট আদর্শের ভিত্তিতে যে দলের জন্ম, ৬৬ বছর ধরে যে দলটি এই অঞ্চলের তৃণমূল মানুষের সব আন্দোলনে আছে, সে দলটির দরজা কেন সবার জন্য খোলা থাকবে?
বাংলাদেশ প্রতিদিনে ছাপা হয়েছে, গত সাত মাসে বিএনপি-জামায়াতের ১০ হাজার নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে। কদিন আগে প্রথম আলো লিখেছে গত দেড় বছরে বিএনপি-জামায়াতের ১৯ হাজার নেতা-কর্মী সরকারি দলে যোগ দিয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের লোকজন হঠাৎ করে আওয়ামী লীগের আদর্শে মুগ্ধ হয়ে যোগ দিচ্ছে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। এই যোগদানের সঙ্গে আদর্শের কোনো সম্পর্ক নেই, সেটা বুঝতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হতে হয় না। বাংলাদেশের অজপাড়াগাঁয়ের অক্ষরজ্ঞানহীন যে কোনো মানুষও জানে দলে দলে যোগ দেওয়ার এই হিড়িক স্রেফ চামড়া বাঁচানোর জন্য। কেউ মামলা থেকে বাঁচতে, কেউ ব্যবসা-বাণিজ্যের লোভে, কেউ নির্বাচনের মনোনয়নের টোপে, কেউ ক্ষমতার কাছে থাকতে আওয়ামী লীগে আসছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা দলবদলের ব্যাপারে কঠোর ছিলেন। তিনি জানতেন এই দুধের মাছিরা সময় মতো সরে যাবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগে জামায়াত-শিবিরের অনুপ্রবেশের কথা বলেছিলেন এবং এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু গত বছরের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন, প্রার্থীবিহীন বিতর্কিত নির্বাচনের পর সেই সতর্কতার বাঁধ ভেঙে গেছে। বানের জলের লাহান মানুষ আওয়ামী লীগে ঝাঁপ দিচ্ছে। এ ব্যাপারে কোনো দলীয় নির্দেশনা আছে কিনা জানি না। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ ওবায়দুল কাদেরের অবশ্য কারণটা ধরতে একটুও ভুল হয়নি 'উত্তর ও দক্ষিণ মেরু এক হতে পারে না। আদর্শের জন্য নয়, মামলা থেকে রক্ষা বা অন্য কোনো কারণে এই দলবদল হচ্ছে বলে মনে হয়।' ওবায়দুল কাদের জানেন, উত্তর মেরু-দক্ষিণ মেরু এক হবে না। তৃণমূল পর্যায়ে কিন্তু হয়ে যাচ্ছে। দলের সিনিয়র নেতা, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের হাতে ফুলের মালা দিয়ে ভোটকেন্দ্র পোড়ানো মামলার আসামিরাও আওয়ামী লীগ বনে যাচ্ছে। এমনকি যুবলীগ নেতা হত্যা মামলার আসামিও গ্রেফতারের পরদিন আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। যেন আওয়ামী লীগে যোগ দিলেই সাত খুন মাফ। নইলে খুনের মামলার আসামি কোন ভরসায় আওয়ামী লীগে যোগ দেয়। আওয়ামী লীগে যারা যোগ দিচ্ছেন, তারা ভালো মানুষ নয়, বিপদে পড়েই আশ্রয় চাইতে আসছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ কেন নিজেদের সব খারাপ লোকের আশ্রয়স্থল করে তুলছে?
ওবায়দুল কাদের সমস্যাটা বুঝলেও দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বুঝেছেন উল্টোটা। তিনি বলছেন, 'কোনো সমাজসচেতন নাগরিক ভুল বুঝে ও সরকারের উন্নয়ন কাজে আকৃষ্ট হয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে চাইলে না বলা উচিত হবে না।' হা হা হা। ভুল বুঝে আর উন্নয়ন কাজে আকৃষ্ট হয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান। হা হা হা। আমার ধারণা মাহবুব-উল আলম হানিফ এটা বলার জন্য বলেছেন, বিশ্বাস থেকে নয়। আমি নিশ্চিত শেখ হাসিনা, সৈয়দ আশরাফ, ওবায়দুল কাদের যেমন বোঝেন; হানিফও জানেন, এই দলবদল ক্ষমতায় থাকার সময় নিছক কিছু বুদবুদ সৃষ্টি করবে, যা ক্ষমতা হারানোর সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যাবে। তবে আশঙ্কা হলো, সব বুদবুদ হয়তো মিলিয়ে যাবে না। দুয়েকটা ক্যান্সার হয়ে ভোগাবে আওয়ামী লীগকে।
এটা ঠিক ক্ষমতায় যেতে ঐকমত্যের রাজনীতির নামে আওয়ামী লীগ অনেক আগেই তাদের আদর্শিক অবস্থানে অনেকটা ছাড় দিয়েছে। এক সময়ের কট্টর আওয়ামীবিরোধী অনেকেই এখন দলে, জোটে, মহাজোটে বা সরকারে আছেন। কিন্তু তাই বলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেশজুড়ে এভাবে ফ্লাডগেইট খুলে দিতে হলো কেন? এটা আমার মাথায় ঢুকছে না। আওয়ামী লীগ কি দলের তৃণমূলের পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলছে? কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, তৃণমূল পর্যায়ে বিশাল কর্মী বাহিনীই আওয়ামী লীগের মূল শক্তি। '৭৫-এর ১৫ আগস্ট যে দলটিকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা হয়েছে, সে দলটি এই কর্মী বাহিনীর শক্তিতে ভর করেই ২১ বছর টিকে ছিল। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী বেশি বলে, দেশের প্রায় সব জায়গায় উপদলীয় কোন্দল আছে। সেই কোন্দল মেটাতেই হিমশিম খেতে হয় নেতাদের। এখন জেলায় জেলায় আওয়ামী লীগে নতুন উপদল সৃষ্টি হবে- বিএনপিপন্থি আওয়ামী লীগ, জামায়াতপন্থি আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ কেন সেধে সেধে এই ঝামেলায় জড়াচ্ছে, আমার মাথায় ঢোকে না।
দিনবদলের স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। গণতন্ত্রের ঘাটতি পোষাতে চাইছে উন্নয়ন দিয়ে। কিন্তু দিনবদলের সরকার যে দলবদলের সরকারে বদলে যাচ্ছে, তা কি টের পাচ্ছেন না তারা।
লেখক : সাংবাদিক।