১৫ জানুয়ারি, ২০১৬ ১২:৪০
অন্য চোখে

প্রার্থনার স্বাদ

মুস্তাফা জামান আব্বাসী

প্রার্থনার স্বাদ

‘ক্ষেতের স্বাদ’ নামে একটি প্রবন্ধ ছাপা হলে একজন ফোন করে জানতে চাইলেন ‘প্রার্থনার স্বাদ’ সম্পর্কে। লিখতে বসলাম। এক ব্যক্তি কোরআনে হাফেজ। কবরে বসে তার একটি মাত্র আরজি আল্লাহর কাছে পেশ করলেন। তা হলো : জীবনে যেমন ছিলেন দিন-রাত কোরআন তেলাওয়াতে মশগুল, কবরের জিন্দেগিতেও যেন তাকে তেলাওয়াত করার নিয়ামত দান করা হয়। প্রার্থনা মঞ্জুর হলো। কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন একজন তরকারিওয়ালা। হাফেজের কাছে তিনি জানতে পারলেন যে, পাঁচ হাজার বার কোরআন তেলাওয়াত করার পর যে স্বাদ পাওয়া যায়, জীবিতাবস্থায় একবার ‘সুবহানাল্লাহ্’ বললে তার মর্যাদা ও স্বাদ তার চেয়ে বেশি। ভেবে দেখুন। সকাল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে ভোর রাত পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত আসছে অফুরন্ত সম্ভাবনা নিয়ে। আমরা সময় ব্যয় করি দুই ভাবে— এই পৃথিবীর জন্য অথবা পরজীবনের কারণে। যিনি এই জীবনের জন্য গায়ের ঘাম ছোটাবেন তিনি তার ফলাফল পাবেন বইকি। সেটি এই পৃথিবীর স্বাদ। যিনি সময় কাটাবেন পরজীবনের কারণে, তিনি স্বাদ পাবেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। প্রয়োজন পূর্ণ নিয়তের।

যা বলব কোনো দিন শোনেননি। পেয়েছি মুহা হুব্বির কাছ থেকে, লিখেছেন কুয়েত থেকে আজ থেকে সাত বছর আগে। প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গি বদলে নেওয়ার। নিজকে জিজ্ঞাসা করুন, কেন নামাজ পড়বেন, পড়তেই হবে সেই জন্য, এ জন্য যে এটা না পড়লে সারা দিনের রুটিন সম্পন্ন হবে না, নাকি যেহেতু সবাই পড়ে, আমাকেও পড়তে হবে?

একটু বিরতি নিন। চিন্তার পরিবর্তনের প্রয়োজনে। এখনই সেই সময়। যার সঙ্গে দেখা হয়নি, তার সঙ্গে দেখা করব। কয়েক মিনিটের জন্য তার সঙ্গে হবে সাক্ষাৎ। তিনি আমার জীবন ভরিয়ে দেবেন। পরিপূর্ণ ভালোবাসা দিয়ে আমি তাকে আমার প্রণতি দেব। আমার হৃদয়ের নির্জনতম প্রকোষ্ঠ থেকে সেই ভালোবাসা আহরণ করব। তিনটি কারণে :

১. হয়তো তিনি সবচেয়ে সুন্দর ২. যিনি সবচেয়ে সুন্দরভাবে আমার সঙ্গে ব্যবহার করেন ৩. যিনি আমাকে অনেক কিছু দিয়েছেন। সবচেয়ে সুন্দর কে? নিশ্চয়ই আল্লাহ। তার চেয়ে সুন্দর আর কেউ হতে পারে না। তার সৌন্দর্য পৃথিবী ছাড়িয়ে। পৃথিবীর সৌন্দর্য যেখানে শেষ, তার শুরু সেখানে, যেমনটি মুসাকে তিনি বলেছিলেন : ‘আমাকে দেখতে পাবে না। তুমি বরং পাহাড়ের দিকে লক্ষ্য কর, যদি পাহাড়কে দেখ অচঞ্চল ও স্থির, আমাকে দেখবে। যখন রব পাহাড়ে জ্যোতি প্রকাশ করলেন, তখন তা পাহাড়কে চূর্ণবিচূর্ণ করল। মুসা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লেন।’ [সুরা ৭, আয়াত ১৪৩, স্পষ্ট জ্যোতি আল কোরআন, পৃষ্ঠা-১৪৯]।

আল্লাহর দয়া-দাক্ষিণ্য নিয়ে চিন্তা করুন নিজের জীবনকে দিয়ে। একটা একটা করে গুনতে থাকুন। শেষ করতে পারবেন কি? আপনার জন্মমুহূর্ত থেকে আকাশ-বাতাস-স্বর্গ-মর্ত থেকে চয়ন করা যা কিছু সুন্দর, যা কিছু মঙ্গলময়, তা দিয়েছেন অকাতরে। আবার গুনতে থাকুন। আজ সকাল থেকে তিনি আপনাকে কীভাবে সঙ্গ দিয়েছেন, দয়া দেখিয়েছেন।

এবার ভাবুন, কী কী ভুল করেছেন সকাল থেকে। গুনে শেষ করা যাবে কি? তিনি সব ক্ষমা করে দিয়েছেন, ক্ষমা চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। যদি বলে থাকেন, হে প্রভু, ক্ষমা করুন। কোনো মসজিদে বা ইজতেমায়ও যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এবার এ কথাগুলো মনে গেঁথে নিন, তাহলেই হবে। জীবনের মধুরতম দিক সেই মধুরকে স্মরণ করুন। সেই মধুর আপনার জীবনকে মধুর করে দেবে। তার নাম সুন্দর, তার নাম মধুর। পরের বার যখন প্রার্থনায় বসবেন, তখন মনে রাখুন : তিনি মধুর চেয়ে মধুর। তিনি সবচেয়ে সুন্দর। তিনি আপনার দিকে হাত বাড়িয়ে আছেন। একটি পরিপূর্ণ সিজদা পূর্ণমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করবে। আপনি মানুষ। আপনাকে তিনি সবচেয়ে ভালোবাসেন সৃষ্টির মধ্যে। আপনার ভালোবাসা, আপনার শ্রদ্ধা, আপনার বিনয়, আপনার মধুর ছবি, তার কাছে প্রিয়। অন্তর থেকে তাকে ভালোবাসা দিন। ভালোবাসায় আপনার জীবন হবে পরিপূর্ণ। ইজতেমায় গিয়ে মুসাহিবা, কুশল জিজ্ঞাসা, হাসিমুখে সবাইকে ভালোবাসা জানান, একসঙ্গে সিজদা দিন। যারা উপস্থিত সবাই মিলে একটি মানুষ, একটি সিজদা। যা বলা হয়েছে তার প্রতিটি কথা অন্তরে গেঁথেছি। কীভাবে নামাজকে উন্নত করা যায়, তার জন্য ভাবতে হবে, সময় দিতে হবে। অমনি অমনি কিছু হবে না। আল্লাহকে সময় দিতে হবে। তার সঙ্গে দেখা করতে হলে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হবে। পাহাড়ের দিকে তাকাতে হবে, নদীর দিকে তাকাতে হবে। মলয় সমীরণ কী বলে যায়, তা বুঝতে হবে। মানুষকে ভালোবাসতে হবে। প্রতিটি মানুষকে। তাদের মুখে অন্ন জোগাতে হবে, কাপড় দিতে হবে। আল্লাহ খুশি হবেন। ইজতেমা মানে হলো মিলন। কার সঙ্গে মিলন? প্রথমে মানুষের সঙ্গে। তার পেছনেই আল্লাহ। একমাত্র ভালোবাসাতেই তাকে পাওয়া যাবে। মনে রাখুন, এই পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি কাজ : তাকে মনে করা। পৃথিবীর পরে সবচেয়ে মিষ্টি কাজ হলো : তার সঙ্গে দেখা হওয়া। এর পরের বার যখন প্রার্থনায় বসবেন তখন এমনভাবে বসবেন যেন আপনি সবচেয়ে যাকে ভালোবাসেন তার সামনে দাঁড়িয়েছেন, তাকে আপনি এযাবৎ না দেখে অস্থির, এক্ষুনি তার সঙ্গে দেখা হবে। আপনার হৃদয় ধীরে ধীরে উদ্বেলিত হবে। প্রবন্ধটি হবে বেশ বড়। হবে ধীরে ধীরে উন্মোচিত। একবার পড়েই আত্মস্থ করার চেয়ে এর জন্য অপেক্ষা করা ভালো।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী : সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর