১৮ মার্চ, ২০১৬ ১৪:১০

রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প ও পরিবেশ ভাবনা

হায়দার আকবর খান রনো

রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প ও পরিবেশ ভাবনা

তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ মজুদ রক্ষা জাতীয় কমিটি ঢাকা থেকে রামপাল অভিমুখে দীর্ঘ পাঁচ দিনের লংমার্চ করেছে। ১০ মার্চ এ লংমার্চ শুরু  ও  ১৪ মার্চ শেষ হয়। দীর্ঘ পথযাত্রা আসলে প্রতিবাদের একটি ফর্ম। কয়েকশ মানুষের এ দীর্ঘ মিছিল পথে পথে থেমেছে এবং পথসভা-জনসভা করেছে। কোনো কোনো স্থানে স্থানীয় প্রশাসন সভা করতে দেয়নি। ছোট-বড় নানা ধরনের সভার মধ্য দিয়ে জাতীয় কমিটি রামপালের বিদ্যুৎ প্রকল্পের অপকারিতা ও ভয়ঙ্কর ক্ষতির দিকটি তুলে ধরেছে।  রামপাল অভিমুখী লংমার্চ নতুন নয়। আগেও হয়েছে কয়েকবার। ‘সুন্দরবন বাঁচাও’ নামেও কমিটি গঠিত হয়েছিল। তারাও প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন। কিন্তু সরকার অটল। কোনো প্রতিবাদ, কোনো সমালোচনা তাদের কর্ণকুহরে পৌঁছবে না। তারা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প করবেই এবং তা সুন্দরবনের গা-ঘেঁষে রামপালেই।

এ পর্যন্ত অনেক বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী প্রতিবাদ জানিয়েছেন। পরিবেশবাদীরা তো সোচ্চার আছেনই। ১০ মার্চ কালের কণ্ঠের পাতায় বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ডা. আহমদ রফিক লিখেছেন একটি নিবন্ধ যার শিরোনাম হচ্ছে ‘রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প ও বিকল্প ভাবনা’। সেই নিবন্ধের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘পরিবেশ দূষণ রোধে সুস্থ পরিবেশ রক্ষার তাগিদে বাংলাদেশেও তত্পর পরিবেশবান্ধব সংগঠন। নদীদূষণ, বায়ুদূষণ, গাছপালা নিধনের মতো নানা প্রকৃতিবিরোধী, জনস্বাস্থ্যবিরোধী উপদ্রব ও উৎপাতের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার। কখনো কখনো বিষয় বিচারে তা জনস্বার্থের দেশস্বার্থের আন্দোলনে পর্যবসিত। তেমন একটি বিষয় সুন্দরবনের সান্নিধ্যে রামপাল তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ। এর মূল কথা যেমন জাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা, তেমন বাংলাদেশ উপকূলের মহামূল্যবান প্রকৃতি সুন্দরবন রক্ষা। মুক্তপ্রাণ সুন্দরবনের স্বাস্থ্য হুমকির মুখে বলেই এ আন্দোলন।’ সরকার বলছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এ প্রকল্প দরকার। পরিবেশবাদীরা যখন সুন্দরবনের গা-ঘেঁষে তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরোধিতা করছিলেন তখন গত বছর প্রধানমন্ত্রী তার স্বভাবসুলভ কৌতুকের ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘আন্দোলনকারীরা মানুষ রক্ষা না করে কেবল পশুপাখি রক্ষার আন্দোলনে নেমেছে।’ আসলে মানুষ রক্ষা করার জন্যই প্রকৃতিকে রক্ষা করা দরকার। প্রকৃতির মধ্যে পশুপাখিও অন্তর্ভুক্ত। প্রধানমন্ত্রী মস্কোয় অনুষ্ঠিত ‘বাঘ রক্ষা’র আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গিয়েছিলেন। বাঘের সংখ্যা ক্রমাগত কমে আসছে। শোনা যায়, এখন সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা মাত্র একশর মতো।

জীববৈচিত্র্যকে ধরে রাখা দরকার। এমনকি বাঘের মতো প্রাণীকেও। সেই প্রসঙ্গ বাদ দিলেও সুন্দরবন হচ্ছে ইউনেস্কো ঘোষিত প্রাকৃতিক ঐতিহ্যসমৃদ্ধ এলাকা। তা ছাড়াও সুন্দরবন সিডর ও আইলার মতো বড় ঝড়-তুফান থেকেও জনপদকে রক্ষা করে। সুন্দরবনের বনজ সম্পদ, সুন্দরবনের মত্স্য সম্পদ সরাসরি আমাদের কাজে লাগে। মোট কথা সুন্দরবন ধ্বংস হোক তা আমরা কোনোক্রমেই চাইতে পারি না। সুন্দরবনের গা-ঘেঁষে রামপালে ভারতের একটি কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশ সরকার কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজে হাত দিয়েছে। ভারতীয় কোম্পানিটির নাম ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানি। কয়লা আসবে ভারত থেকে অথবা অন্য কোনো জায়গা থেকে। আসবে সুন্দরবনের ভিতরের নদী দিয়ে জাহাজে করে। এ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উত্পন্ন হবে বলে জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে সুন্দরবনের আরও কাছে মংলা বন্দরের পাশেই ওরিয়ন নামে আরেকটি বাংলাদেশি কোম্পানিকেও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তারা উৎপাদন করবে ৬২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।

বিদ্যুৎ আমাদের দরকার। বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে আমরা নই। কিন্তু প্রশ্ন এখানে দুটি। প্রথমত, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের বিকল্প আছে কি? কারণ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় দারুণভাবে। দ্বিতীয়ত, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সুন্দরবন ছাড়া আর কি কোনো জায়গা নেই? এ ছাড়াও ভারতের কোম্পানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের লাভ-লোকসানের বিষয়টিও ভেবে দেখা দরকার। যেসব উপাত্ত দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, তার মধ্যে কয়লা সবচেয়ে বেশি বাতাসকে দূষিত করে এবং সবচেয়ে বেশি বিষাক্ত বর্জ্য কয়লা থেকেই উদ্গীরিত হয়। সে জন্য এখন উন্নত দেশগুলো ক্রমাগত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বাতিল করে দিচ্ছে। অবশ্য এখনো ২৬.৮০ শতাংশ বিদ্যুৎ কয়লা থেকেই উৎপাদন হয় সারা বিশ্বে। মোট উৎপাদনের পরিমাণ ৩৮,৪৯৭–১০৩ গিগাওয়াট ঘণ্টা। সে তুলনায় ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের ব্যবহার অনেক বেশি। শতকরা ৩৩.৫০ শতাংশ। প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার হয় ২০.৯০ শতাংশ। নিউক্লিয়ার পাওয়ার ব্যবহার হয় অনেক কম এবং তা বিপজ্জনকও বটে। উন্নত দেশে সমুদ্র, পাহাড়ি নদী, বাতাস ইত্যাদিকে অধিক পরিমাণে ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে জার্মানিতে বাতাসকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রচলন সম্প্রতি খুব বেশি হয়েছে। এমনকি বিশেষজ্ঞ বিডি রহমত উল্লাহ এক লেখায় জোরের সঙ্গে জানিয়েছেন যে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার বিকল্প আছে। তিনি বলেছেন, ‘... আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে গেলে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ দরকার তা কি কয়লা বাদে অন্যান্য জ্বালানি দিয়ে সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব এবং অনেক সাশ্রয়ী ও টেকসইভাবে সম্ভব।’ তিনি অভিযোগ করেন, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো নিজস্ব মুনাফার স্বার্থে তা করতে দিচ্ছে না এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল সরকারগুলোর মাধ্যমে ‘আমাদের টেকসই পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাধা দিয়ে পরিবেশ ধ্বংসকারী জ্বালানি প্রকল্প গ্রহণ করাচ্ছে। ফলে আমরা যেমন ব্যয় করছি, তেমন আবহাওয়ারও বিপর্যয় ঘটাচ্ছি।’ দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি আসছে খুবই গুরুতরভাবে তা হলো এত জায়গা থাকতে সুন্দরবনের ভিতরে অথবা পাশে কেন বিদ্যুৎ প্রকল্প? তাও আবার কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ? এর একটা কারণ এই যে, কয়লা আসবে বাইরে থেকে। নদীপথে কম খরচে কয়লা আনার জন্য সুন্দরবনের উপকূল ও নদী ব্যবহার করতে হবে। মুনাফার লালসা এতই বেশি যে, এর জন্য সুন্দরবনের যে ক্ষতি হবে তা কোনো বিবেচ্য বিষয়ই নয়। আর্থিক লাভ-লোকসানের দিকটা প্রথমে দেখা যাক। তারপর আমরা পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ করব, যদিও সেটাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। রামপালের প্রকল্পটি যৌথভাবে ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানি (এনটিপিটি) ১৫ শতাংশ এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পিডিবি ১৫ শতাংশ খরচ বহন করবে। বাকিটা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সংগ্রহ করা হবে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ভারতই ১৪ শতাংশ চড়া সুদে টাকা ঋণ দেবে এবং অবকাঠামো ইত্যাদি নির্মাণের কাজে ঠিকাদারি ও সরবরাহকারীর কাজ পাবে ভারতের বিভিন্ন কোম্পানি। অর্থনৈতিক বিবেচনায়ও এ প্রকল্প আমাদের জন্য সুবিধাজনক নয়।

এবার আসা যাক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশসংক্রান্ত বিষয়ে। আগেই বলা হয়েছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বিভিন্ন উন্নত দেশে বাদ দেওয়া হয়েছে। উপরন্তু মারাত্মক পরিবেশ দূষণের আশঙ্কায় সংরক্ষিত বনভূমি ও বাসভূমির ১৫ থেকে ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে দেওয়া হয় না। এমনকি ভারতেও তাই। ভারতের ‘তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনসংক্রান্ত গাইডলাইন ১৯৮৭’, ‘ভারতের ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশন অ্যাক্ট ১৯৭২’ এবং ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় প্রণীত ‘পরিবেশ সমীক্ষা গাইডলাইন ম্যানুয়াল ২০১০’ অনুযায়ী বনাঞ্চল, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান জাতীয় উদ্যান ইত্যাদি এলাকার ২০ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করা যাবে না। এ জন্য ভারতেই পরিবেশগত কারণে কর্ণাটক, তামিলনাড়ু ও মধ্যপ্রদেশে তিনটি কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করা হয়েছিল ২০১৪ সালে। একই কোম্পানি এনটিপিটি পশ্চিমবঙ্গে সুন্দরবনের কাছে প্রকল্প নির্মাণের অনুমতি পায়নি। তারপর তারা চলে এসেছে বাংলাদেশে, যেখানে খুব সহজেই সুন্দরবনের গা-ঘেঁষে (১ থেকে ১৫ কিলোমিটারের মধ্যেই) কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের অনুমতি পেয়ে গেছে। বাফার জোন হিসেবে নিলে দূরত্ব আরও কম। এ একই কারণে পরিবেশসচেতন নরওয়ে এই ভারতীয় কোম্পানি থেকে ৪৩০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

আমাদের বলা হচ্ছে যে, এখানে এমন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে যাতে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না। কথাটা সত্য নয়। বড়জোর ১০ শতাংশ ক্ষতি কমানো সম্ভব। এ প্রকল্প থেকে যে বিষাক্ত ছাই ছড়িয়ে পড়বে, তাতেও তো বনাঞ্চল দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এই যে, সিলেটের সিমেন্ট ফ্যাক্টরিগুলো বলছে, ওই ফ্ল্যাইং অ্যাশ তাদের সিমেন্ট উৎপাদনে কাজে লাগবে। হয়তো লাগবে।  কিন্তু তার আগে যে বনের গাছপালা, পশুপাখির ক্ষতি হবে, সে হিসাব কে দেবে?

উপরন্তু নদী দিয়ে জাহাজ যাতায়াত করবে। ৯ ডিসেম্বর, ২০১৪ সালে সুন্দরবনের ভিতরে জাহাজডুবিতে যে বিরাট পরিবেশগত ক্ষতি হয়েছিল, সে কথাও ভুললে চলবে না। সব শেষে যে কথা বলতে চাই তা হলো, বাংলাদেশে কি আর কোনো জায়গা নেই যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ করা যায় না? সুন্দরবনেই করতে হবে কেন! আর কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের অনেক বিকল্প থাকা সত্ত্বেও সেই পথে আমরা যাচ্ছি না কেন?  এর সদুত্তর এখনো পাওয়া যায়নি। উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ দরকার। কিন্তু পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটিয়ে যে উন্নয়ন তা আদৌ উন্নয়ন কিনা তা ভেবে দেখতে হবে।

     লেখক : রাজনীতিক।

সর্বশেষ খবর