২৩ মার্চ, ২০১৬ ১৫:০৮
কলকাতার চিঠি

মানুষ বলছে সরকার চোর

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

মানুষ বলছে সরকার চোর

ঘুষকাণ্ডের পর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, কলকাতার ৭৫ শতাংশ মানুষ বলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার সরকার চোর। তারা টাকা নিয়েছেন। তাদের আর দরকার নেই। কলকাতার একটি প্রথম সারির টেলিভিশন চ্যানেল এবং একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষা সংস্থার যৌথ সমীক্ষায় দেশজুড়ে চাঞ্চল্য তৈরি হলেও হেলদোল নেই মুখ্যমন্ত্রীর। তিনি আছেন নিজের মতোই। রাজ্যজুড়ে তৈরি হওয়া জনরোষের তোয়াক্কা না করে সম্প্রতি নজিরবিহীন ভাষায় নির্বাচন কমিশনকে আক্রমণ করেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি। শুক্রবার উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জে নির্বাচনী প্রচার সভা থেকে তিনি কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনকে আক্রমণ করেন। তিনি বলেছেন, আর কী হবে বিজেপির? নির্বাচন কমিশন কি তোমাদের ভোটটাও দিয়ে যাবে? কী সিপিএম? ইলেকশন কমিশন কি ভোটটা দিয়ে দেবে ঘরে ঘরে? ভোটারদের ভোটটা দিয়ে দেবে?

ভোট করাতে বঙ্গেশ্বরীর অগাধ আস্থা কেবল রাজ্যের পুলিশ আর প্রশাসনের ওপর। যেভাবে রাজ্যের পুলিশের সাহায্য নিয়ে পঞ্চায়েত, করপোরেশন ও পৌরসভা ভোট হয়েছে, সেভাবেই বিধানসভার ভোটটাও করাতে চান মমতা। কিন্তু নির্বাচন কমিশন যে একটু কড়া মনোভাব নিয়েছে তা বোঝার পরই মেজাজের ওপর যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, নির্বাচন কমিশন সিপিএম আর বিজেপির হয়ে ভোট করাচ্ছে। তাদের লক্ষ্য করে তিনি বলেছেন, তুমি (নির্বাচন কমিশন) আমাকে বল তোমাদের যদি রাজ্য প্রশাসনের ওপর ভরসা না থাকে, একটা কাজ কর। ওবামাকে (মার্কিন-প্রেসিডেন্ট) গিয়ে ধর। ওবামা তোমাদের পুলিশ সাপ্লাই দেবে। আর তাদের নিয়ে এসে তুমি গ্রামে গ্রামে ভরে দাও। তাই করে তুমি দেখ বাংলার মা-বোনেরা তোমাদের ভোট দিচ্ছে না দিচ্ছে না?

কমিশনের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রীর এ মন্তব্য নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন। আর তিনি এ মন্তব্য করেছেন এমন দিনে যেদিন কলকাতায় এসে পৌঁছেছে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন পরিদর্শক দল। রাজ্যের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতেই পাঁচ সদস্যের ওই দলটিকে কলকাতায় পাঠানো হয়েছে। এ রাজ্যে ভোট নিয়ে প্রথম থেকেই সরকারের ওপর চাপ বাড়িয়ে রেখেছে কমিশন। বৃহস্পতিবারই চার পুলিশ সুপার ও এক জেলা প্রশাসককে পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে কমিশন। ২৩টি থানার ওসি এবং আইসিকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। শাসক দলের এক নেতাই বলেছেন, গত বিধানসভা ভোটের পর থেকে রাজ্যে আর কোনো ভোটও যে অবাধ হয়নি, তা আমাদের থেকে ভালো আর কে জানে? তাই নির্বাচন কমিশন যাই করুক, এবারও ভোট নিয়ে আমাদের কোনো চাপ নেই। তাই নিজেদের ওপর থেকে চাপ কাটাতেই মুখ্যমন্ত্রী ওই মন্তব্য করেছেন বলে জানিয়েছেন রাজ্যের রাজনৈতিক মহল।

নারদ নিউজের স্টিং অপারেশনের মাধ্যমে তোলা বিস্ফোরক ভিডিওর ঘুষকাণ্ডের কথা প্রচারিত হওয়ার পর প্রথমদিকে তৃণমূলের একাধিক নেতা-মন্ত্রী-সংসদ সদস্য মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলেন ওই ভিডিও সংস্থা ও তার কর্ণধার ম্যাথু স্যামুয়েলের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করবেন। ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয় রকম মামলাই করা হবে বলে তারা শাসিয়েছিলেন। কিন্তু তত্ক্ষণাৎ মামলা করার সেই হুমকিকে মুক্তকণ্ঠে স্বাগত জানান সত্ত্বেও স্যামুয়েলের বিরুদ্ধে আজও পর্যন্ত মামলা দূরে থাক কোনো আইনি নোটিসও পাঠাতে সাহস করেননি তৃণমূলের অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কেউ। বলাবাহুল্য, এ থেকে সবার কাছেই স্পষ্ট হচ্ছিল অভিযুক্ত তৃণমূল নেতারা আর যাই করুন মামলার পথে যাবেন না। তাই তারা আশ্রয় নিচ্ছিলেন রাস্তায় নেমে পাল্টা মিছিল-মিটিং করে ও সংসদের ভেতর গলা ফাটিয়ে গোটা অভিযোগটিকে ধামাচাপা দেওয়ার কৌশলের। কারণ তারা জানতেন মামলা করলে ফাঁস হয়ে যাবে গোটা সত্যি। ফাঁস হয়ে যাবে ওই ঘুষ-ভিডিওর সম্পূর্ণ সত্যতা। ঘুষকাণ্ডের শুরু থেকেই তাই তারা এ ভিডিওর ছবিগুলোকে ‘মিথ্যা’ প্রমাণ করতে কোনো ফরেনসিক পরীক্ষার আশ্রয় নেওয়ার কথা একবারও মুখে উচ্চারণ করেননি। যদিও স্বয়ং স্যামুয়েল ও সব বিরোধী বারবার দাবি জানিয়েছেন, এ ভিডিও দৃশ্যগুলো যদি মিথ্যাই হবে তবে তৃণমূল ফরেনসিক তদন্তের পথে যাচ্ছে না কেন? কিন্তু সবকিছুকে এড়িয়ে তৃণমূলের বালিতে মুখ গুঁজে থাকার কৌশল শেষ পর্যন্ত টিকল না। কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দিলেন এই মামলায় পক্ষভুক্ত করতে হবে নারদ নিউজ সংস্থা ও তার কর্ণধার স্যামুয়েলকে। হয় তাকে নিজে অথবা তার কোনো প্রতিনিধিকে অথবা নিদেনপক্ষে তার কোনো আইনজীবীকে আদালতে হাজির হয়ে এ ব্যাপারে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। নারদ নিউজের দেশ তোলপাড় করা ভিডিও নিয়ে হাইকোর্টে আনীত তিন তিনটি জনস্বার্থ মামলার প্রাথমিক শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর ও বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চের দেওয়া এ নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে রীতিমতো বজ্রাঘাতের ঘটনা ঘটল তৃণমূলের মাথায়। কারণ এ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে এরপর এমনটিই ঘটতে চলেছে যা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য তারা মরণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তা হলো এরপর এই ভিডিওর সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য ফরেনসিক পরীক্ষার নির্দেশ। বলাবাহুল্য, এখনো পর্যন্ত যা পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলি তাতে ওই ভিডিও-দৃশ্যগুলো যে সম্পূর্ণ সত্যি তা প্রমাণিত হবেই।

উল্লেখ্য, ওই ভিডিও যে ১০০ শতাংশ সত্যি এবং তা প্রমাণের জন্য যে কোনো নির্দেশ পালনে রাজি আছেন বলে ইতিমধ্যে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন ম্যাথু স্যামুয়েল।

এদিকে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, ক্ষমতায় আসার আগে যিনি কথায় কথায় সিবিআই তদন্তের দাবি জানাতেন এত বড় ঘটনা সত্ত্বেও তিনি সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিচ্ছেন না কেন?

তৃণমূল নেতাদের ঘুষকাণ্ডের প্রতিবাদে পথে নেমেছে বামফ্রন্টসহ বিরোধীরা। ধর্মতলা থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত এক বিশাল বিক্ষোভ মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন সিপিআই (এম)’র রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র, বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, হাফিজ আলম সৈরানী, মনোজ ভট্টাচার্য, প্রবীর দেব প্রমুখ। মিছিলে অংশ নেওয়া ছাড়াও লেনিন সরণির দুই ধারে জমায়েত হয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ। জেলায় জেলায় শুরু হয়েছে বিরোধীদের বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ।

মিছিলে হাঁটতে হাঁটতেই সূর্যকান্ত বাবু প্রশ্ন তোলেন, যে ভিডিও ফুটেজকে মুখ্যমন্ত্রী ও তার দল বানানো বলছেন, সেটি পরীক্ষা করাতে অসুবিধে কোথায়? তারা রাজ্য শাসনের সব নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। এ রাজ্যে বিজেপি যে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করছে তা মূল্যহীন। দিল্লিতে ওদের নেতাদের সঙ্গে তৃণমূলের যে সমঝোতা হয়ে গেছে, তা রাজ্যসভায় কেন্দ্রীয় সরকারের আচরণেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। ঘুষকাণ্ডের তদন্তে রাজ্য বা কেন্দ্রীয়— কোনো সরকারেরই কোনো আগ্রহ নেই। নারদ নিউজের স্টিং অপারেশনের ক্যামেরায় স্পষ্ট দেখা গেছে তৃণমূল কংগ্রেসের ১২ জন নেতা-মন্ত্রী-সংসদ সদস্য ঘুষের টাকা নিচ্ছেন। এর প্রতিবাদে বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে রাজ্যব্যাপী বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়েছে।

মিছিল থেকে স্লোগান উঠেছে— লুট হয়েছে হাজার কোটি। কে নিয়েছে, হাওয়াই চটি। চোরদের সরকার আর নেই দরকার। মিছিলে স্লোগান ওঠে— ধরা পড়েছে নারদে, সবাই যাবে গারদে। যানজটে আটকে পড়া ট্রাম বাস থেকেও শাসক দলের বিরুদ্ধে নানারকম মন্তব্য উড়ে আসতে থাকে। মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে বিমান বসু বলেছেন, যারা চুরি করেছে তাদের ওপর আমাদের আর কোনো ভরসা নেই। আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে বলেছি, তদন্ত করে দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। কলকাতা শহরের মেয়রের পদ বহু বিশিষ্ট মানুষ অলঙ্কৃত করেছেন।  সেই পদে বসে কাউকে টাকা নিতে দেখলে মানুষ বরদাশত করবে কেন?

সূর্যকান্ত বাবু বলেছেন, এই রাজ্যের শাসক দলের নেতা-নেত্রীরা এর আগে চিট ফান্ডের লুটের টাকা নিয়েছেন, লোহা চুরি করেছেন, বালি চুরি করেছেন, মাটি চুরি করেছেন, তোলাবাজি করেছেন। এখন ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে বান্ডিল বান্ডিল টাকা পকেটে পুরছেন। নজিরবিহীন ঘটনা। একজন পুলিশ সুপারকে বলতে শোনা গেছে, তিনি নাকি তৃণমূলের হয়ে টাকা তোলার অথরাইজড এজেন্ট।  যে পুলিশ এভাবে টাকা তোলে, তাদের যোগসাজশে পশ্চিমবঙ্গে কীভাবে ভোট লুট হয় তা জানতে কারও বাকি আছে?

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।


বিডি-প্রতিদিন/ ২৩ মার্চ, ২০১৬/ রশিদা

সর্বশেষ খবর