১৫ অক্টোবর, ২০১৯ ২১:০৭

ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ নয়, বরং ঘুণে ধরা কাঠামোর সংশোধন দরকার

নবনীতা চক্রবর্তী

ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ নয়, বরং ঘুণে ধরা কাঠামোর সংশোধন দরকার

জাতিগতভাবে আমরা একটি সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি আর সেটি হল আমরা কোন সমস্যার গভীরে যেতে পারছি না। সমস্যার উৎসমুখ অবধি পৌঁছতে না পারলে শুধু উপরি উপর সমাধান খুঁজতে চাইলে হবে না। এতে হয়তো জোড়াতালি দেওয়া "আপাতত রক্ষা করা গেল" গোছের পরিস্থিতি সামলানোর একটি তরিকা হতে পারে, তাতে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলাও সম্ভব হতে পারে কিন্তু এটি কদাচিৎ টেকসই  সমাধানের পথ হতে পারে না।

সময়ের প্রবাহে প্রতিনিয়তই আমাদের নানা ঘটনা-দুঘটনার সম্মুখীন হতে হচ্ছে এবং হবেই। কারণ সময় বদলে যাচ্ছে। তার সাথে সাথে বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা। তবে উদ্বেগ হওয়ার মতো কথা হল অস্থির জীবনযাত্রায় কেউ স্বস্তিতে নেই। সবাই চটজলদি সমাধানের পথ চাইছি। ফলে সমস্যার যাচাই, বাছাই, সঠিক চিন্তা ও অনুধাবন ছাড়াই সিদ্ধান্তে যেতে হচ্ছে, যার কার্যকারিতা বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য আদৌও যুক্তিযুক্ত কিনা তা খতিয়ে দেখবার সময়ও হয়ে উঠছে না। এমন বাস্তবতায় বর্তমানে ছাত্র রাজনীতি একটি জোরালো আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। এটির পক্ষে-বিপক্ষে রয়েছে নানা তর্ক-বির্তক। নিঃসন্দেহে যে কোন জাতীয় বিষয় আলোচনার সুযোগ রাখে এবং রাখাও উচিত। যে কোন গণতান্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা এটিকে অনুমোদন করে, সমর্থন করে। সেক্ষেত্রে ছাত্র রাজনীতি রাষ্ট্র ও সমাজের যৌক্তিক সমালোচনাসহ, ছাত্রদের স্বাধীন মত প্রকাশ, তাদের দাবি আদায়ের এক নিরঙ্কুশ কণ্ঠস্বর। তাছাড়া দেশের ক্রান্তিলগ্নে তরুণ সমাজের বলিষ্ঠ হাতিয়ার এই ছাত্র রাজনীতি, যার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস থেকে আমরা বিস্মৃত হতে পারি না। উপমহাদেশে এদেশীয় মানুষদের শুধু কেরানি তৈরি করার লক্ষ্য নিয়ে ইংরেজরা যে কেরানিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন করেছিলো তার আগল খুলে ছাত্র সমাজ বেরিয়ে এসেছিলো নতুন এক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে। তারই ধারাবাহিকতায় স্বদেশী আন্দোলন, অসযোগ আন্দোলন সর্বোপরি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সুতীব্র ইতিহাস হয়ে আছে। এ সমস্তই ছাত্র রাজনীতির এক উজ্জ্বল অতীত। সাংগঠনিকভাবে ছাত্র রাজনীতির স্ফুরণ দেখা যায় ১৯৬৮ সালে। দেশ বিভাগোত্তর জাতীয় রাজনীতিতে রাজনৈতিক সংগঠনগুলো তাদের নিজস্ব ছাত্রফ্রন্ট গড়ে তুলতে চাইত। ষাটের দশকের প্রথম দিকে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক  দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। এর ফলে ছাত্র সংগঠনগুলোর নানা দলে উপদলে বিভক্তিকরণ ঘটে, যা তাদের ভাবমূর্তিকে জনসাধারণের সম্মুখে ক্ষুন্ন করে। এরপরই ঘটে সেই অর্ভূতপূর্ব ঘটনা  জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত ছয়দফা দাবির সর্মথন ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাতে কারান্তরীণ শেখ মুজিবের মুক্তিকে কেন্দ্র করে সমগ্র ছাত্রসমাজ ও সংগঠন একত্র হয়ে ওঠে। এক নজিরবিহীন ঐক্য তাদের মধ্যে স্থাপিত হয়, যা ছাত্র রাজনীতির আমূল পরিবর্তন সাধন করে। ছাত্রদের এই ঐক্যস্বরুপ গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ছাত্রদের এই আন্দোলন ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মতো  গণবিস্ফোরণের জন্ম দেয়। ছাত্রদের ব্যাপক আন্দোলন নিশ্চিত করে শেখ মুজিবের মুক্তি। ছাত্রদের এই জমায়েত রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আর্বিভূত হয়। ছাত্র রাজনীতি জনমানুষের দাবি ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি হয়ে উঠে। এভাবেই বাঙালির জাতীয় জীবনে ৫২ ভাষা আন্দোলন, ৫৪ প্রাদেশিক নির্বাচন, ৬২ শিক্ষা  আন্দোলন, ৬৬ এর ছয়দফা, ৬৯ গণঅভ্যুত্থান, ৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামের মতো যত ক্রান্তিলগ্ন এসেছে তার প্রত্যেকটিতে ছাত্র তথা ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও স্পন্দমান। নীতি, আর্দশ, ত্যাগের পরাকাষ্ঠ। 

স্বাধীনতার পর ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও ছাত্রদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সময়োপযোগী। দেশের প্রত্যেকটি সংশয়,  সংকটে ছাত্ররা অগ্রগণ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন ওঠে কবে এবং কিভাবে বদলে যেতে লাগলো এই ছাত্র রাজনীতি! সময়ের সাথে সবকিছুই পরিবর্তন ঘটে। ছাত্র রাজনীতিও এর ব্যতিক্রম নয়। বর্তমান সময়কে বিচার করতে হলে অবশ্যই আমাদের মূলে ফিরে যেতে হবে। ৭৫ এর পর থেকে ছাত্র রাজনীতি এক সহিংস রূপ ধারণ করে। রগকাটা, কুপিয়ে জখম করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় ত্রাস ও জুলুমের রাজনীতি। যেখানে নীতি আর্দশ ভুলে পেশী শক্তির আগ্রাসনমূলক অপরাজনীতির চর্চা চলতে থাকে। ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের স্বকীয়তা হারাতে শুরু করে। মাঠ গরম করা রাজনীতির কৌশলে ক্রমশ অপমৃত্যু ঘটতে থাকে বুদ্ধিভিত্তিক চেতনার। যার পরিণতিতে সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ড মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। কিন্তু এই বদলে যাওয়া অপসংস্কৃতির ধারাবাহিকতার আদল ছাত্র রাজনীতির মাপকাঠি হতে পারে না। ছাত্র রাজনীতি নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার এখনই উপযুক্ত সময়। তাই বলে ছাত্র রাজনীতি বন্ধকরণ কোন যৌক্তিক সমাধান নয়। 

এতে আগ্রাসন বাড়বে বৈ কমবে না। শুধু লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির কাঠামোর পরিবর্তনই নয় ছাত্রদের অর্থলিপ্সা, ভোগবিলাসী মনমানসিকতাও বদলাতে হবে। আরেকটি বিষয় যেটি আমরা বিবেচনায় রাখছি না, সেটি হল ছাত্রী হলগুলোতে রাজনীতির প্রেক্ষাপট ও চর্চা। সেটি ছাত্র হলগুলোর মতো অধিক আলোচিত না হলেও সেখানে বিভিন্ন দলের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। যেমন: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালের ছাত্রী হলগুলোর কথা ধরা যাক। হলগুলোতে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, বাসদ এর সরাসরি কোন কার্যক্রম না থাকলেও ছাত্রী সংস্থার কার্যক্রম বরাবরই নিরবিচ্ছিন্ন ও শক্তিশালী। হলে ছাত্রী সংস্থার মেয়েদের জন্য আলাদা কিছু রুমও বরাদ্দ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সম্পন্ন হওয়ার পর সাধারণ ছাত্রীদের গণরুমে ওঠার সাথে সাথেই মেয়েদের তারা নামাজ, ধর্মীয় বৈঠক ও ধর্মীয় বই পাঠে উদ্বুদ্ধকরণসহ নানামুখি কর্মকাণ্ড চালিয়ে যায়। এটি কোন অরাজনৈতিক কর্মধারা নয়। এই ধর্মীয় শিক্ষার আড়ালে চলে রাজনৈতিক দীক্ষা। পর্যায়ক্রমে এই কর্মধারা গণরুম থেকে প্রত্যেক রুমের শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার একটি চেষ্টা থাকে। 

এই প্রসঙ্গটি উল্লেখ করার অর্থ হল ছাত্র রাজনীতি না থাকলে দল ক্ষমতায় এলে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন তার পেশীশক্তি ও ক্ষমতা প্রদর্শনের চেষ্টা করবেই সেটি প্রত্যক্ষরূপে না করলেও করতে চাইবে। এদিকে, ধর্মীয় দাওয়াতের ব্যাপারটিকে কাজে লাগিয়ে ধর্মের নামে আরেকটি দলও সামনে এগোবে। অন্যদিকে, আমরা বড়ই আবেগপ্রবণ জাতি, এই আবেগ নিয়েও বেসাতির অভাব নেই। নিমিষেই খুব মোটা দাগে দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে যাই। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন বনাম সাধারণ শিক্ষার্থী। এক্ষেত্রে অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর অস্তিত্বের সংকট তৈরি হয়, যা থেকে পরবর্তীতে ঘটনাকে 
ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার সমূহ সম্ভাবনাটি থেকেই যায়। নিশ্চয়ই কোনটিই আমাদের কাম্য নয়।  অপরদিকে, ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকারটুকুও ক্ষুন্ন হবে। তাই ছাত্র রাজনীতির নিষিদ্ধকরণ নয় বরং এর ঘুণে ধরা কাঠামোর সংশোধন দরকার। আর সবচেয়ে বেশি দরকার সুশিক্ষা। কারণ যুক্তি, বুদ্ধি আড়ষ্ট হলেই পেশীশক্তির উত্থানকে প্রশ্রয় দেয়। সারা বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন সময়ে নির্যাযিত অত্যাচারিত শিক্ষার্থীদের যেমন ক্ষোভ, কষ্ট, হতাশা রয়েছে, তেমনি বিভিন্ন যৌক্তিক আন্দোলনে, দাবি আদায়ে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে তাদেরই রক্ত ও শ্রমে। বহু তরুণ শিকার হয়েছেন ভয়াবহ অমানবিকতার। এর পুনরাবৃত্তি বন্ধ হোক। তরুণ ছাত্র সমাজ বরাবরই সময়ের ক্রান্তিকালে দেশ ও মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সেই স্মৃতি বিস্মৃত না হয়েই তারুণ্যের এই অপরাজেয় শক্তি নিমজ্জিত হোক দেশের সার্বিক মঙ্গলে। তারুণ্যের বাংলাদেশে সুস্থধারার ছাত্র রাজনীতির চর্চা শুরু হোক এখন থেকেই।

লেখিকা: আই. সি. সি. আর.  স্কলার, 
এডুকেশন সেক্রেটারি, 
স্টেজ ফর ইয়ুথ।

বিডি-প্রতিদিন/মাহবুব

সর্বশেষ খবর