৪ জুলাই, ২০২০ ১১:৫৯

সময় থাকতে দুঃসময়ের কর্মীদের মূল্যায়ন করুন

রফিকুল ইসলাম রনি

সময় থাকতে দুঃসময়ের কর্মীদের মূল্যায়ন করুন

‘রাজনীতিকে কঠিন বানাবেন না। শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই করবেন না। জমিনে উত্থান দেখেছি, পতনও দেখেছি। পতন হইলে কেউ নাই, বউ ছাড়া কেউ নাই।’ ২০১৯ সালের ১৬ রাজধানীতে ওয়ার্ড যুবলীগের এক সম্মেলনে কথাগুলো বলেছিলেন তৎকালীন চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওমর ফারুক চৌধুরী। এসময় যুবলীগ নেতারা করতালি দিয়ে উঠেন। বিরক্তি প্রকাশ করে ওমর ফারুক চৌধুরী আরও বলেছিলেন, ‘ওই দেখেন তালি পার্টি। এই তালি পার্টিটা কি? আমি একটা কিছু। হনু আসছে, মনে হয় রাজা-বাদশা আসছে। যুবলীগে হনুরে দরকার নেই। পতন হইলে কেউ নাই, বউ ছাড়া কেউ নাই।’

বিদায়ী যুবলীগ চেয়ারম্যানকে নিয়ে শত সমালোচনা থাকলেও গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে বলতে পারি, রাজনৈতিক বা সহযোগী সংগঠনগুলো যে গবেষণা করে, মূল সংগঠনের নেতার কর্মময় জীবন ও সরকারের সাফল্য বই আকারে প্রকাশ করে দেশ-বিদেশে তরুণ প্রজন্মকে পড়তে ও রাজনীতিতে আগ্রহী করে তোলে তা তিনি করেছিলেন। তিনি নিজেও পড়ালেখা করতেন। তার বক্তব্য থাকতো লিখিত। দীর্ঘ সময় ধরে বক্তৃতা করতেন, এতে গণমাধ্যমকর্মীসহ অন্যরাও বিরক্ত হতেন। তবে প্রতিটি কথা ও শব্দ থাকতো সুনিদিষ্ট তথ্যের আলোকে। তিনি গবেষণা করতেন বলেই হয়ত, ঠিকই উপলব্ধি করেছিলেন ‘পতন হলে বউ ছাড়া কেউ থাকে না।’ দাপুটে এই নেতার ধানমন্ডির বাসায় কিংবা অফিসের সামনে ভিড় লেগেই থাকতো। এখন কেউ নেই। ভিড় অন্যত্র।

‘উই আর লুকিং ফর শত্রুজ’ এই কথাটি বলার পর কী পরিষ্কার করার দরকার আছে, এটা কার কথা? তারপরও মনে দিচ্ছি, এটা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রভাবশালী স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের কথা। দেশের যতজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিনোদিত, আলোচিত ও সমালোচিত ছিলেন এই ব্যক্তিটি। সরাসরি হাওয়া ভবনের সঙ্গে কানেকশন। কে ঠেকায় তাকে! আধো বাংলা, আধো ইংরেজিতে কথা বলতেন তিনি। কি দাপুটে লোক ছিলেন! ২০০৪ সালের একুশে গ্রেনেড হামলা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কেরানীগঞ্জের কারাগারে কনডেম সেলে নিঃসঙ্গ সময় কাটছে। গত ২৮ জুন একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যম অনুসন্ধানী সংবাদে লিখেছে, ‘২০ মাস ধরে বাবরের খোঁজ নেয়নি পরিবার’। এতে বলা হয়, ২০১৮ সালের নভেম্বরের পর থেকে এখন পর্যন্ত তার পরিবারের সদস্য বা আইনজীবীরা কেউ কারাগারে দেখতে যাননি তাকে। তাহলে কি ওমর ফারুক চৌধুরীর কথা মিথ্যা প্রমাণ হলো পতন হলে বউ ছাড়া কেউ থাকে না! বাবরের সন্তান আছে, স্ত্রীও আছেন। তার স্ত্রী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নেত্রকোনা-৪ আসন থেকে ধানের শীষ নিয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন। প্রার্থী হওয়ার আগেই স্বামীর সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ করেছিলেন বলেও ওই সংবাদে বলা হয়েছে।

প্রতিষ্ঠার পর ছাত্রলীগকে সবচেয়ে বেশি কলঙ্কিত করা-‘চাঁদাবাজির দায়ে পদচ্যুত গোলাম রাব্বানীর কথা মনে আছে? বাসার সামনে কত হোন্ডা, কত ছাত্রনেতা! পদ-প্রত্যাশী!  শত শত হাত বাড়িয়ে দিতো শুধু ‘ভাইয়ের’ হাতটি ছোঁয়ার জন্য? এখন তার বাসার সামনে হোন্ডার শোডাউন দেখা যায়? ফেসবুকময় ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’ তেমন চোখে পড়ে না। সেই গাড়ি, সেই ভাই ঠিকই ভিড় করে, তবে অন্যখানে। অথচ কি ক্ষমতাধরই না ছিল এই ছাত্রনেতা! একদিনের মধ্যে যার তার চাকরি খাওয়ার মতোও ক্ষমতা তার ছিল!

কিছুদিন আগে সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতা একজন মন্ত্রীর নাম উল্লেখ করে আক্ষেপ করেই বললেন, বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় তাকে কত সাপোর্ট দিয়েছি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তার সঙ্গে দলীয় কর্মসূচি পালন করেছি। কত রাত জেগে, না খেয়ে থেকেছি। বাইকের পেছনে গ্রামের পর গ্রাম নিয়ে ঘুরেছি। এখন মন্ত্রী হওয়ার পর আর আমরা তার দফতরে ঢুকতে পারি না। সেই সময়ে যেসব ছাত্রদল-শিবির ক্যাডাররা আমাদের পিটাতেন, আমাদের নামে একাধিক মামলা দিতেন, মন্ত্রী মহোদয় তাদেরকে নিয়েই এখন একান্তে বৈঠক করেন। যত কাজ তাদেরকেই দেন। মনে হয়, আমরাই এখন বিরোধী দলে। কথায় কথায় বললেন, এর চেয়ে বিরোধী দলেই ভাল ছিলাম। এই দৃশ্য দেখতো হতো না।  দীর্ঘ আড্ডা শেষে বললেন, এত কিছু পরও শান্তি, বঙ্গবন্ধুকন্যা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছেন। দেশ আজকে এগিয়ে যাচ্ছে। সন্ত্রাসের জনপদ এখন শান্তিতে আছে।

করোনার কারণে আর আগের মতো আড্ডা দেই না। তবে সেদিন এক বড় ভাইয়ের বিশেষ অনুরোধ রক্ষা করতে হয়েছে। এই বড় ভাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডা হলো। জিজ্ঞেস করলাম ব্যবসা কেমন চলছে? জবাবে বললেন, আমাদের ব্যবসা নাম মাত্র চলছে। সব সেক্টরে বিএনপি-জামায়াতিদের দাপট। আমরা কাজ পাই না। আমার হাতে গড়া কর্মীর গাড়িতেও পতাকা আছে। কেউ কেউ কেন্দ্রীয় নেতাও হয়েছেন। অনেকেই ফোন ধরেন না। নিরুপায় কখনো কারো কারো দরজায় কড়া নাড়লেও নানা ব্যস্ততা দেখায়। তাই আর কোথাও যাই না। বাবার রেখে যাওয়া ব্যবসা দেখভাল করে কোনমতে টিকে থাকার চেষ্টা করছি।

আমারও উপলদ্ধি: ক্ষমতা আর যৌবন চিরদিন থাকে না। সময় থাকতে দুঃসময়ের কর্মীদের যথাযথ মূল্যায়ন করুন। তেলবাজ, সেলফিবাজদের এড়িয়ে চলুন। অনেকেই জনপ্রতিনিধিসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছেন, কখনো জয় বাংলা বলেননি। মাঠে স্লোগান কিংবা মিছিল করেনি। এমনকি দলের গঠনতন্ত্র সর্ম্পকেও ধারণা নেই। এমন জনপ্রতিনিধি কিংবা ক্ষমতাধরকে ঘিরে এক শ্রেণীর সুবিধাবাদী গড়ে উঠেছে। তারাই সর্বাগ্রে থাকেন। নিজ এলাকার দীর্ঘদিনের ত্যাগী পরীক্ষিত নেতাকর্মী উপেক্ষিত। উপেক্ষিত ও পরীক্ষিত নেতারা কেউ কেউ প্রকাশ্যে এ নিয়ে ক্ষোভও ছাড়ছেন। কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বেছে নিচ্ছেন। যারাই ক্ষমতাবান আছেন, তারা সত্যকে স্বীকার করেন। ক্ষমতায় থাকলে ভুলত্রুটি চোখে পড়ে না। চারদিকে চাটুকার দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকেন। বলি কী, সময় থাকতে সতর্ক হোন। তেলের সাগরে গা ভাসাবেন না। মনে রাখবেন দুঃসয়ের পাশে থাকারা কখনো আপনাকে তেল মাররে না। মিথ্যা প্রশংসায় আপনাকে সাগরে ভাসিয়ে দেবে না। মানবতার ফেরিওয়ালা বানাবে না। আপনার শ্যালিকা, শ্যালকের বান্ধবীকে নিয়ে তেল মার্কা স্ট্যাটাস দেবে না। সময় থাকতে তাদের মূল্যায়ন করুন। দুঃসময়ের পাশে থাকাদের সত্য কথা তিতা হলেও কানে নিন। দুঃসময়ের কর্মীরা কখনো নেতার অমঙ্গল চান না। কারণ তাদের ত্যাগ ও ঘামের বিনিময়েই আজকে দায়িত্বশীল পদে কিংবা পতাকা নিয়ে ঘুরছেন। একটা কথা মনে রাখবেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুই নেত্রী যাদের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছেন, তারা কেউ দাঁড়াতে পারেননি। আপনি আজ পদে বা দায়িত্বে আছেন, কাল থাকবেন এর কোন গ্যারান্টি আছে? কিন্তু আপনি রাজনীতি করতে চাইলে কর্মীদের প্রয়োজন হবে। খোঁজ নিন, যখন আপনি যখন ক্ষমতাবান ছিলেন না, তখন কারা পাশে ছিল? কারা আপনার জন্য কাজ করেছেন? তাদেরকে মূল্যায়ন করুন। আজকে তেলবাজদের মূল্যায়ন করছেন! কালকে পতাকা নেমে যাক, কিংবা দলীয় পদ চলে যাক কেউ থাকবে না। তখন নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হবে। আর আপসোস করবেন, দুঃসময়ের পাশে থাকা কর্মীদের জন্য। এখন যাদের ভিড়তে দিচ্ছেন না, হয়ত তাদের কাউকে কাউকে পাশে পাবেন, আবার কেউ কেউ অভিমানে দূরেই থাকবে। তাই আবারও বলছি সময় থাকতে দুঃসময়ের কর্মীদের মূল্যায়ন করুন।

লেখক: সাংবাদিক

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

সর্বশেষ খবর