৮ জুলাই, ২০২০ ১৪:৫৩

ট্রাম্পের অভিবাসন নিষেধাজ্ঞা: অভিবাসীদের কর্মসংস্থানের সুবর্ণ সুযোগ?

প্রকৌশলী আবুবকর হানিপ

ট্রাম্পের অভিবাসন নিষেধাজ্ঞা: অভিবাসীদের কর্মসংস্থানের সুবর্ণ সুযোগ?

করোনাভাইরাসের ধাক্কায় বেসামাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিবাসী ও নন-রেসিডেন্টদের ভিসার উপর নিষেধাজ্ঞা এ বছরের শেষ পর্যন্ত বর্ধিত করছেন। হোয়াইট হাউসের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, এইচ১বি, এইচ২বি'সহ এইচ৪, জে এবং এল ক্যাটাগরির ভিসাও ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর অবধি স্থগিত থাকবে। গত ২২ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ৬০ দিনের জন্য নন-রেসিডেন্ট ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে আসা কর্মীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করার একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছিলেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই আদেশের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে এইচ১বি ভিসা প্রত্যাশীদের উপর। ইতিমধ্যে এই আদেশকে বিপথগামী ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকারক উল্লেখ করে গুগল, টেসলার মতো টেক জায়ান্টগুলো বিবৃতি দিয়েছে। মার্কিন শ্রম বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ সালে টেক জায়ান্ট গুগল, ফেসবুক এবং অ্যাপল ১৩,০০০ এরও বেশি উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন আইটি কর্মচারী এইচ১বি (H1B) ওয়ার্ক ভিসাসহ নিয়োগ করেছে।

যদিও হোয়াইট হাউস বলছে, করোনার কারণে অনেক মার্কিন নাগরিক অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে বেকার আমেরিকানদের পাশ কাটিয়ে বিদেশি কর্মীদের কাজের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি দেয়া উচিত নয়। 

মূলত ট্রাম্প এইচ১বি ভিসা নিয়ে নিষেধাজ্ঞার আদেশটি দিয়েছেন সামনে নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে। তার এই আদেশের মানে এই নয় যে, ২০২০-২১ সালের এইচ১বি ভিসা প্রত্যাশীদের আবেদন পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে। ইউএস সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশ সার্ভিস এ বছর এপ্রিলের ১ তারিখ পর্যন্ত ২০২০-২১ সেশনে প্রায় ২.৫ লাখ এইচ১বি ভিসা প্রত্যাশীদের আবেদন পেয়েছে। এসব আবেদন থেকে লটােরির মাধ্যমে ৮৫ হাজার প্রার্থী বাছাই সম্পন্ন হয়েছে। বাছাইকৃত ভিসা প্রার্থীদের সামনের অক্টোবরের ১ তারিখ থেকে কাজে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে।  

এবার যারা এইচ১বি ভিসার জন্য সিকেক্টেড হবেন তারা মূলত ট্রাম্পের দেয়া এই আদেশের ফলে অক্টোবরের ১ তারিখ থেকে কাজে যোগ দিতে পারবেন না। যেহেতু নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত, সেক্ষেত্রে সিলেক্টেড প্রার্থীরা হয়তো জানুয়ারি থেকে কাজে যোগ দিতে পারবেন। এক্ষেত্রে আবেদনপ্রার্থীসহ তাদের নিয়োগকৃত কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হবেন তিন মাস- অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর। যদি ২০২০-২১ সেশনের পুরো আবেদন প্রক্রিয়াটি বাতিল করা হতো তাহলে সেটি সকল আবেদনপ্রার্থীকে জানিয়ে দেয়া হতো।

অবস্থা যদি এমন হতো, এপ্রিলে ভিসা আবেদন করার পরে কেউ সিলেক্টেড হয়েছে বলে চিঠি পেয়েছে এবং পরবর্তীতে ভিসা কর্তৃপক্ষ থেকে তাকে জানানো হয়েছে, এইচ১বি বন্ধের কারণে ভিসা বাতিল করা হলো, তখন এ ব্যাপারটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেত। সিলেক্টেড প্রার্থী তখন বলতে পারতেন আমি চিঠি পেয়েছি, সিলেক্টেড হয়েছি, লটারিতে জিতেছি, আমার ল’ইয়ার খরচ হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এমন প্রশ্ন তোলার কোন অবকাশ নেই।

প্রকৃতপক্ষে ট্রাম্প প্রশাসন তিন মাসের জন্য একটি গ্যাপ দিল। এইচ১বি ভিসা যদি সত্যি সত্যিই বন্ধ করে দেয়া হয় তাহলে এখন যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী বাসিন্দা অথবা  নাগরিকদের মধ্যে যারা ব্যাচেলর বা মাস্টার্স করছে তারা এর একটি সুবিধা পাবে। এইচ১বি ভিসার দক্ষ কর্মীদের অভাব পুষিয়ে নিতে এই সব ছাত্র-ছাত্রীদের একাডেমিক পড়াশোনা শেষ করার আগেই চাকরি করার মতো দক্ষতা অর্জন করতে হবে। কোন কোম্পানিই চাইবে না এন্ট্রি লেভেলের কর্মী নিয়ে হাতে-কলমে কাজ শিখিয়ে নিজেদের সময়-অর্থ নষ্ট করতে। তাই এই সব ছাত্র-ছাত্রী যেন মিড লেভেল কর্মীর দক্ষতা নিয়ে চাকরিতে যোগ দিতে পারেন সেজন্য তাদের ফাইনাল ইয়ারে তিন-ছয় মাসের বিশেষ কোর্সের ব্যবস্থা করা উচিত। এই বাড়তি অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান চুড়ান্ত ইন্টারভিউতে তাদের পক্ষে বাড়তি পয়েন্ট যোগ করতে পারে। যেমন আইটি চাকরির জন্য কেউ যদি নেটওয়ার্কিং, বা সাইবার সিকিউরিটি, বা ডেটাবেইজ এ্যাডমিনেস্ট্রেটর হতে চায়, তবে তার আগ্রহ অনুসারে ঐ বিষয়ের উপর ভেন্ডর সার্টিফিকেট নেয়া দরকার। ভেন্ডর প্রতিষ্ঠান যেমন মাইক্রোসফট, ওরাকল নানা খাতে পরীক্ষা নিয়ে সার্টিফিকেট প্রদান করে। 

পিপল এন্ড টেক গত ১৫ বছরে ৬ হাজারের বেশি জনকে  সফটওয়ার টেস্টিং, এসকিউএল সার্ভার ডেটাবেজ এডমিনেস্ট্রেশন সাইবার সিকিউরিটি, ডেভ অপস, এ ডব্লিউ এস, স্ক্রামমাস্টার, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট প্রফেশনাল হাতে কলমে কাজ শিখিয়ে উচ্চ বেতনের চাকরি পেতে সহায়তা করেছে, যাদের সবাই যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী বাসিন্দা অথবা  নাগরিক।

ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বড় কর্পোরেশনগুলো ট্রাম্পের এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে। বড় কোম্পানিগুলোর চায় মুনাফা, আর মুনাফার জন্য চাই দক্ষ কর্মী। তারা যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষ কর্মী না পেলে তাদের প্রজেক্টগুলো আউটসোর্স করবে। এতে ক্ষতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিরই হবে। এইচওয়ানবি ভিসা বন্ধ করলেও এর সুফল পাওয়া যাবে না। যদি এইচওয়ানবি বন্ধ করে এর সুফল নিতে হয় তখন আউট সোর্সিং বন্ধের জন্য বিধিনিষেধ আরোপ করার প্রয়োজন। আবার যারা আউটসোর্সিং করবে না, তাদের ট্যাক্স কমিয়ে দিয়ে উৎসাহ দেয়া প্রয়োজন। সব মিলিয়ে পুরো ব্যাপারটি অসম্ভব জটিল হয়ে দাঁড়াবে।

গত ২৩ জুন সিএনএন এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, সিলিকন ভ্যালির উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন প্রায় ১০০ জনের একটি প্রতিনিধি দল এরইমধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই ঘোষণার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বলেছে, এই আদেশ সিলিকন ভ্যালির সার্বিক অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করবে। গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই বিবৃতিপ্রদানকারীদের  মধ্যে অন্যতম। 

প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র মোট ৮৫ হাজার এইচ১বি ভিসা অনুমোদন দেয়। এর মধ্যে ৬৫ হাজার ভিসা পৃথিবীর যেকোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রিধারী খুবই দক্ষ কর্মীদের জন্য আর বাকি ২০ হাজার আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে, মাস্টার্স সম্পন্ন করা দক্ষ কর্মীদের জন্য বরাদ্দ থাকে।

এইচ১বি ভিসা পুরোপুরি বাতিল করে দিলে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। ছাত্র-ছাত্রীরা কোন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে সেদেশের অভিবাসননীতি সম্পর্কেও খোঁজ-খবর নেন। পড়াশোনা শেষ করে আমেরিকাতে কাজ করা কঠিন হয়ে গেলে তারা স্বাভাবিকভাবেই পড়াশোনার জন্য কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানির মতো দেশগুলোর দিকে পা বাড়াবেন। একথা কে না জানে আমেরিকা পুরো পৃথিবীর মধ্যে আরেকটি পৃথিবী। আমেরিকার সকল বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাগার সহ বড় বড় কোম্পানিগুলোতে খোঁজ নিলে দেখা যাবে বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে আসা শ্রেষ্ঠ মেধাবীরা সেখানে কাজ করছে। এসব মেধাবীদের মেধা কাজে লাগিয়েই আমেরিকা আজ এই পর্যায়ে এসেছে। 

আমেরিকার সেই সব অর্জনগুলি বলা চলে পথে বসতে পারে একের পর এক এসব অভিবাসন বিরোধী কর্মকাণ্ডে। এরই মধ্যে চলতি শিক্ষার্থীদের নিয়ে আরেক খেলা শুরু হয়েছে। 

আসন্ন ফল সেমিস্টার থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যদি  সরাসরি ক্লাস না নিয়ে পুরোপুরি অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু করে তাহলে বিদেশি শিক্ষার্থীদের যুক্তরাষ্ট্র ছাড়তে হবে। এ ছাড়া সেখানে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের ভিসাও দেওয়া হবে না। ৬ জুলাই সোমবার ইউএস ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস) এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে।

এমন সিদ্ধান্তে ব্যাপক বিপদে পড়তে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা। ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের হিসাবমতে, দেশটিতে বর্তমানে ১০ লাখের বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। এখন করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বের অন্যসব দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও অনলাইন ক্লাসকে বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করছে। এ অবস্থায় বিদেশি শিক্ষার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে বলছে আইস। করোনা ভাইরাসের কারণে পৃথিবী বেশ খানিকটা উল্টাপাল্টা হয়ে গেলেও, যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ব্যবস্থা থেকে, এইচ১বি পুরোপুরি বাতিল করে দেয়া এত সহজ নয়। এত দিনের চলে আসা শৃঙ্খল হুট করে ভেঙ্গে দিলে সেটি যে হিতে বিপরিত ডেকে আনবে সেটা বুঝতে ট্রাম্প প্রশাসনের কষ্ট হওয়ার কথা নয়। 

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও, পিপল এন টেক, যুক্তরাষ্ট্র

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

সর্বশেষ খবর