১২ জুলাই, ২০২০ ১২:৩৩

মুজিববর্ষে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নতুন উচ্চতার জন্য প্রস্তুত

গৌতম লাহিড়ি

মুজিববর্ষে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নতুন উচ্চতার জন্য প্রস্তুত

গৌতম লাহিড়ি

করোনাভাইরাস সৃষ্ট মহামারির ভীতিকর হুমকি সত্ত্বেও ‘মুজিববর্ষ’ উদ্যাপনকালে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অন্য উচ্চতায় উন্নীত করার লক্ষণ এখন স্পষ্টভাবে প্রমাণিত। উভয় দেশ কভিড-১৯-পরবর্তী একটি ধারাবাহিক চুক্তির পরিকল্পনা করেছে, যা দুই দেশের জনগণের জন্য একটি ফলপ্রসূ পরিস্থিতি তৈরি করবে এবং অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্নপূরণে কৌশলগত বাস্তবতার বাইরেও বাস্তব সম্পর্ক প্রদর্শন করবে। বাংলাদেশের প্রয়োজনের সময়টিতে তাঁর স্বপ্ন পূরণ করতে একজন বন্ধু এবং প্রভাবক হিসেবে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

সড়ক-রেল-নৌপথ যোগাযোগের মতো চিরাচরিত কাজের পাশাপাশি ভারত-বাংলাদেশ উচ্চ প্রযুক্তিগত সহযোগিতার নতুন দৃষ্টান্ত তৈরির জন্য প্রস্তুত। গত ছয় বছরে উভয় দেশের উচ্চ পর্যায়ের সফরকালে কমপক্ষে ৯০টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এখন আগামী বছরগুলোতে মহাকাশ, তথ্য-প্রযুক্তি, বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা, শিপিং, ইলেকট্রনিকস এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত অত্যাধুনিক উচ্চ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা সমঝোতাগুলো কার্যকর হবে। এই প্রেক্ষাপট জানার পরও এই দুই দেশের বন্ধুত্ববিরোধী শক্তিগুলো যুদ্ধের দিকে তাদের কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারা অশুভ পরিকল্পনার মাধ্যমে কিছু সংবেদনশীল অমীমাংসিত বিষয়কে ব্যবহার করে উভয় দেশের জনগণের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ভুল-বোঝাবুঝি তৈরি করতে চলেছে।

ন্যায়সংগতভাবে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বৈধ দাবি সম্পর্কে নয়াদিল্লি সচেতন এবং এটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাধান করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রতিবন্ধকতার পেছনের কারণটি সবার জানা। তিস্তার সমাধান স্থগিত থাকার কারণে ভারত এরই মধ্যে অন্য ছয়টি সাধারণ নদীর পানি ভাগ করে নিতে সম্মত হয়েছে; একটি প্রাথমিক সমাধান এই বছর আশা করা হচ্ছে। তবু একটি মহল এ বিষয়ে ঘোলা পানিতে মাছ ধরার চেষ্টা করছে।

তারা জনগণের মন থেকে স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করে যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমলে দীর্ঘকাল ঝুলে থাকা ভারত-বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছিল। এবং দীর্ঘ ৪৫ বছরের বিরোধের পরে ইন্দিরা-মুজিব স্থলসীমান্ত চুক্তি এবং ছিটমহলগুলোর সফল বিনিময় ঘটেছিল। ভারত সরকার এই আবেগমূলক বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য তৈরির জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল। কোনো রাজনৈতিক দল এই চুক্তিগুলোর বিষয়ে আপত্তি জানায়নি, যদিও চূড়ান্ত আলোচনায় ভারত কিছু স্থলভূমি ও জলসীমা হারিয়েছিল।

নেতিবাচক শক্তি জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেয় না যে ঐতিহাসিক স্থলসীমান্ত চুক্তি ১১১টি ছিটমহল ভারত থেকে বাংলাদেশে স্থানান্তর করতে সহায়তা করেছিল, যা বাংলাদেশে ১৭১৬০.৬৩ একর পর্যন্ত স্থলভূমি যুক্ত করে। এর পরিবর্তে ভারত ৫১টি ছিটমহল পেয়েছিল এবং বাংলাদেশের কাছে প্রায় ১০ হাজার একর লোকসান দিয়ে মাত্র ৭১১১.০২ একর স্থলভূমি পায়। পৃথিবীতে এমন কোনো উদাহরণ রয়েছে যে দীর্ঘকালীন সীমান্ত বিবাদ মীমাংসার জন্য তথাকথিত ‘বড় দেশ’ একটি তথাকথিত ‘ছোট্ট দেশ’কে জমি দিতে স্বীকার করে? দুই দেশের মধ্যে সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তি করতেও একই রকম ঘটনা ঘটেছে। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে হেগভিত্তিক আন্তর্জাতিক আদালত বঙ্গোপসাগরের ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে বাংলাদেশকে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার দেওয়ার মাধ্যমে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার দীর্ঘদিনের সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি করেছেন। এই রায়ের পর ভারত কখনোই রায়টি নিষ্পত্তি করতে যায়নি। যদি কেউ তখনকার সংবাদ প্রতিবেদনগুলোর কথা স্মরণ করে, তবে দেখতে পাবে যে কিভাবে বাংলাদেশ ভারত থেকে তাদের প্রাপ্য পাওয়ার জয় উদ্যাপন করেছে। মূলত বর্তমানে সহযোগিতার একটি নতুন ক্ষেত্র হচ্ছে সামুদ্রিক অর্থনীতি, যা নিয়ে উভয় দেশই তাদের পারস্পরিক সুবিধার জন্য আলোচনা করছে।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বীরত্বপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধ স্মরণ করার একটি আদর্শ সময় হচ্ছে মুজিববর্ষ উদ্যাপন, যেখানে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এবং অত্যাচারী পাকিস্তানি শাসকদের খপ্পর থেকে প্রতিবেশী দেশের স্বাধীনতার জন্য ভারত তার সেনাদের শহীদ হওয়ার অনুমতি দিয়েছিল। হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত কোনো দেশ কিভাবে একই আন্তরিকতা দাবি করতে পারে, যখন তাদের পাকিস্তান এবং শক্তিধর পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে মিলিত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নাশকতার প্রমাণ ইতিহাসে নথিভুক্ত রয়েছে। নতুন প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর বার্তা প্রচারের সময় এখন এসেছে। উভয় দেশের তরুণদের সঙ্গে সেই ইতিহাস উদ্যাপন করার জন্য ভারত ও বাংলাদেশের মহাপরিকল্পনা রয়েছে।

বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার জন্য চীন সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভারতের প্রতি ঢাকার মনোভাবের এক নতুন পরিবর্তন হিসেবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে—যার কোনো ভিত্তি নেই। যেকোনো দেশের সঙ্গে ব্যবসা করা বাংলাদেশ সরকারের সার্বভৌম অধিকার, তা যদি লাভজনক হয়। তদুপরি ভারত এই বিষয়ে সচেতন যে ভারত ও চীন উভয় দেশ যখন বিতর্কিত লাদাখ অঞ্চলে গুরুতর সামরিক বিবাদে জড়িত তখন চীন বন্ধুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বাড়ানোর সব উপায় খুঁজবে। এই সময়ে কোনো ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তা চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে সাম্প্রতিক বাণিজ্য সম্পর্কের বিষয়ে কোনো আপত্তি উত্থাপন করেননি। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো এখানে কী ঘটছে তা তাদের মতো করে ব্যাখ্যা করতে পারে (কোনো আঞ্চলিক গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক মন্তব্যের পরিপূরক নয়)। চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কে বাংলাদেশ সংবাদমাধ্যমগুলোর একটি অংশের ভিন্ন আঙ্গিকের প্রতিবেদনও ভারত সরকার গ্রহণ করেনি।

ভারত ২০১১ সালে বাংলাদেশে সব পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা বাড়িয়েছে। প্যারা শুল্ক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কিছু নির্দিষ্ট সমস্যা রয়েছে, যা পর্যায়ক্রমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পর্যায়ে সমাধান করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট পণ্যের ওপর ডাম্পিং শুল্ক নিরসনের ব্যাপারে উপযুক্ত আপিল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি স্থগিত করে দিয়েছে। দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের জনসমক্ষে মন্তব্য করে কোনো অশান্তি তৈরি না করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে, যা অপ্রয়োজনীয় সমস্যা সৃষ্টি করে। ভারতেরও নির্দিষ্ট জাতীয় বাধ্যবাধকতা রয়েছে এবং উভয় দেশের স্বার্থ ও পারস্পরিক সুবিধার জন্য একত্র হওয়া উচিত।

নেতিবাচক শক্তিদের মনে রাখতে হবে, ভারতের এলওসিতে সুদের হার মাত্র ১.২ শতাংশ, যখন চীন প্রকল্পের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে ২-৩ শতাংশ বা তার বেশি হার আরোপ করে। এটিও সত্য যে ভারত চীনের চেয়ে দরিদ্র দেশ। ভারত ৬৪টি দেশে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এলওসি বাড়িয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ আট বিলিয়ন মার্কিন ডলার গ্রহীতা, যা মোট বরাদ্দের ২৬ শতাংশ। বাংলাদেশের রপ্তানি ভারতে এক বিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে, যা এশিয়ায় জাপানের পরে দ্বিতীয় এবং দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার।

সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযানের বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং ক্রমবর্ধমান উগ্রবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের চারদিকে ঘুরপাক খায় এবং উভয় দেশের চমৎকার সহযোগিতা প্রক্রিয়া রয়েছে, যেখানে নিয়মিত তথ্য বিনিময় হয়। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একাংশের মৌলবাদ সম্পর্কে গোয়েন্দা শাখার সাম্প্রতিক তথ্য উভয় দেশের জন্যই উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশকে এই দিকগুলো সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। কারণ সহিংসতার কিছু ঘটনা গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে দুই দেশের মধ্যে আরো দ্রুত নিবিড় সহযোগিতা হওয়া প্রয়োজন। পক্ষান্তরে দুই দেশের মধ্যে কিছু বিরক্তিকর তুচ্ছ সমস্যা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে না।

মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত, ভারত বাংলাদেশিদের জন্য ১.৭ মিলিয়ন ভিসা দিয়েছে, যা বিশ্বের বৃহত্তম ভিসা অপারেশন। ভারতীয় নেতৃত্ব ও জনগণ সর্বদা বাংলাদেশকে বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করেছে এবং সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতিকে সমর্থন করেছে। সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মধ্যে বোঝাপড়া ও সম্পর্ক একটি নতুন দিক ও ভিত্তি তৈরি করেছে। দুই দেশের মধ্যে একটি আবেগপ্রবণ যোগসূত্র রয়েছে, যা ১৯৭১ সাল থেকে মানুষের মনে বিদ্যমান। এই সম্পর্কের মধ্যকার নেতিবাচকতা শুধু একটি কায়েমি স্বার্থের অস্তিত্ব দ্বারা চালিত হয়।

লেখক : ভারতীয় জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর