১৩ মে, ২০২১ ০২:৩৬

নীতিভ্রষ্ট পণ্ডিতের চেয়ে গ্রামের অশিক্ষিত ভালো

সোহেল সানি

নীতিভ্রষ্ট পণ্ডিতের চেয়ে গ্রামের অশিক্ষিত ভালো

সোহেল সানি

"আমাদের দেশের শিক্ষিত লোকের নব্বই ভাগই নীতিজ্ঞ নয়, নীতিভ্রষ্ট। বিবেকহীন-নির্লজ্জ। এদের চেয়ে গ্রামের অশিক্ষিতরা অনেক ভাল।" মহান মুক্তিযুদ্ধের স্থপতি ও সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধুকে এই কথাটি বলেছিলেন মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি বঙ্গবীর ওসমানী।

আমাদের সংবিধানকে স্কুলের সিলেবাসে সন্নিবেশিত করার দাবি জানিয়ে বঙ্গবীর আরও বলেছিলেন, "লিডার সংবিধানকে স্কুলের সিলেবাসে এমনভাবে অন্তর্ভূক্ত করে দেন, যাতে ছাত্রছাত্রীরা মেট্রিক পাস করার সময় থেকেই একশত পাতার সংবিধান সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা করায়ত্ত করতে পারে।"

বঙ্গবন্ধু জবাবে হেসে বলেছিলেন, সেনাপতি এটা করলে সব শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্রসমাজ আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপে যাবে।

আমরা জানি শতকরা ৯৯ ভাগ শিক্ষিত ভদ্রবেশীরা সর্বোচ্চ আইন সম্পর্কিত সংবিধানটি চোখেই দেখেননি। যে ছাত্র মেট্রিক, ইন্টারমিডিয়েট এমনকি এম এ তে ফার্ষ্ট হয়েছে সেও সংবিধান সম্পর্কে অন্ধ। প্রশ্ন করে দেখ, অনেকেই প্রভুভক্ত কুকুরের মতো লেজ মুড়ে দাঁত বের করে হেসে বলবে, ওটা হাতে পাইনি, কিনতে পারিনি, কারণ লাইব্রেরীতেও পাওয়া যায় না।  

অথচ সংবিধানের ৭ (১) অনুচ্ছেদ বলছে, প্রজাতন্ত্রের সকল মালিক জনগণ অর্থাৎ "জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। "ছাত্রছাত্রী নয়, একজন ইতিহাসের শিক্ষককে প্রশ্ন কর- মুক্তিযুদ্ধকালে পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর কে ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কয়টি বা কমান্ডারদের নাম কি এবং কে কোন অঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন? অনেকেই জবাব দেবেন, ওসব জেনে এখন লাভ কি?

শুধু তাই নয়, একজন বিদগ্ধ আইনজীবীকে প্রশ্ন কর - মুক্তিযুদ্ধকালীন ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি বা পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের বাঙালীদের মধ্যে কে কে ছিলেন, এবং তাদের ভুমিকা কি ছিল? দেখা যাবে, তারা দলিলপত্র খোঁজাখুঁজি করে কেবলই সময় ক্ষেপন করবেন।

এসব কারণেই বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপরই পাকিস্তানী নাগরিকের পাসপোর্টে বাংলাদেশে অসুস্থ শয্যাশায়ী বৃদ্ধা মায়ের দেখার বায়না ধরে স্বাধীনতা বিরোধী নরঘাতক গোলাম আজম বাংলাদেশে ফেরার সুযোগ হাতিয়ে নিয়েছিলেন। নির্দিষ্ট সময় ফুরালেও গোলাম আযমের প্রীতিমুগ্ধ আচার-আচরণে খুশী হয়ে যায় শাসকগোষ্ঠী। ফলে তিনি মগবাজারের বাড়িতে বসেই কলকাঠি নাড়ার সুযোগ পান।

গণধিকৃত ইয়াহিয়া সমর্থিত  মুক্তিযুদ্ধকালীন পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর ডাঃ মোত্তালিব মালেকের শিক্ষামন্ত্রী আব্বাস আলী খানকে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির পদে আসীন করা হয়েছিল। ভারপ্রাপ্ত কেন এমন প্রশ্নের উদ্রেক রাষ্ট্র করেনি, কেননা কার্যত আমির ছিলেন গোলাম আজম। কি অদ্ভূত, বাংলাদেশের নাগরিক না হয়েও বাংলাদেশের সংবিধানের অধীনস্ত সকল মৌলিক সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন গোলাম আজম।

অচিরেই স্বাধীনতা বিরোধী সকল দলের সমন্বয়ে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আই ডি এল) নামে একটা প্লাটফর্ম দাঁড় করিয়ে ফেলেন গোলাম আজম। দ্বিতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে তাদের অংশ নেবার পথ তৈরি হয়ে যায় এভাবেই। সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে তারা ২০ আসনও পেয়ে যায়। যার মধ্যে অদৃশ্য জামায়াতেরই ছিল ১০টি। মুসলিম লীগ (কনভেনশন), মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) ও মুসলিম লীগ (কাইয়ুম) এবং নেজামে ইসলাম পার্টিসহ আরও কটি দল গণরোষের ভয়ে আইডিএল এর ব্যানারে প্রার্থী দেয়। 

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা ঠিকই  নিজ নিজ নামে আবার আত্মপ্রকাশও করে। এটা ছিল তাদের ছদ্মবেশ। যা প্রকারান্তরে "জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ।"  দলবিধি আইনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে সরকারি অনুমোদন পেতে বেগ পেতে হলেও জামায়াতে ইসলামকে আইডিএল নামে অনুমোদন পেতে কষ্ট হয়নি। পরে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ নামে আত্মপ্রকাশ করে। 

কেন বাংলাদেশ নামক দেশবাচক শব্দটি সংগঠনের নামের আগে না বসে পরে বসানো হয়েছিলো? এ সম্পর্কে রাষ্ট্র অবগত থেকেও কেন সেদিন গোলাম আজমের দলকে অনুমোদন দেয়া হয় সে প্রশ্ন করা হয়নি। যদিও জবাব দেরিতে হলেও জামায়াতকেই দিতে হয়েছে। আজ জামায়াতীদের 'বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী'নামে নিবন্ধিত হতে হয়েছে।

ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে খাঁড়া করার সুযোগ এসেছিলো সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ বাতিল দ্বারা। 
৭৯ সালে জাতীয় সংসদে ৫ম সংশোধনী পাস করার মাধ্যমে এর সাংবিধানিক বৈধতাও দেয়া হয়েছিলো। প্রবর্তন থেকেই সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের ফলে সকল, সাম্প্রদায়িক দল নিষিদ্ধঘোষিত হয়েছিলো। 

অবশ্য রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানও একটা পর্যায়ে স্বাধীনতা বিরোধীদের অপতৎপরতায় অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। এদের পাকরাও করার জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিলো। কিন্তু '৮১ সালের ৩০ মে জিয়া নিহত হলে ওই রিপোর্ট আর আলোর মুখ দেখেনি। জামায়াত এটা ভুলতে পারেনি।

যে জিয়ার সুবাদে তারা একচ্ছত্র আধিপাত্য বিস্তারের পথ প্রশস্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন, সেই জিয়ার প্রতিও জামায়াত অমর্যাদা করতে কুন্ঠাবোধ করেনি। তাই জিয়ার মাজারেও তাদের আনাগোনা কখন কারো চোখে পড়েনি। 

"বিসমিল্লাহির রহমানের রাহিম" কথাটি সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতে শিরোনামরূপে ব্যবহার করেন জিয়াউর রহমান। তবে এ শব্দটির প্রথম ব্যবহার করেন সর্বদা টুপি পরিহিত খন্দকার মোশতাক আহমেদ। রাষ্ট্রপতির প্রথম বেতার ভাষণে মোশতাক 'বিসমিল্লাহির রহমানের রাহিম' কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন এবং জয়বাংলার স্থলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ কঘা দিয়ে ভাষণ শেষ করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকে " স্বৈরাচারী শেখ মুজিবের হত্যা" বলে সামরিক বাহিনীর কাঁধে চাপিয়ে ছিলেন মোশতাক। 

সামরিক শাসন জারির কথা ঘোষণা করলেও মোশতাক প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদের কোন অস্তিত্বের কথাও অনুভব করেনি। খালেদ মোশাররফের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে ৮১ দিনের ব্যবধানে মোশতাকের পতন ঘটে। উত্থান ঘটে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নিযুক্ত সুপ্রিমকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েমের। অভ্যুত্থানকারীরা সায়েমকে রাষ্ট্রপতি করলে তার প্রথম বেতার ভাষণে মোশতাকের ন্যায় "বিসমিল্লাহির রহমানের রাহিম" কথাটাই উচ্চারণ করেন।
 
রাষ্ট্রপতি সায়েম জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া তার ভাষণে বলেছিলেন। "শেখ মুজিব ও তার পরিজন স্বজন হত্যার দায় সামরিক বাহিনীর ওপর বর্তায় না।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ সিফাত

সর্বশেষ খবর