যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে হিউস্টন সিটি এবং এর আশপাশের বাংলাদেশিসহ মুসলিম সম্প্রদায়ের ঈদ উদযাপনের সকল প্রস্তুতি তছনছ করে দিয়েছে হারিকেন হার্ভে। যেসব মসজিদে পানি উঠেনি, সেগুলোকে বন্যার্তদের আশ্রয় কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে। হিউস্টন এবং আশপাশে প্রলংয়করী হারিকেন এবং পরবর্তীতে ঝড়ো হাওয়ায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ২০ হাজারের অধিক বাংলাদেশিও রয়েছেন। প্রায় প্রত্যেকের বাড়িতেই ৮/৯ ফুট করে পানি উঠেছে। যারা দু’তলায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, তারা এখন সব ভরসা হারিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে দূরবর্তী শুকনো স্থানে পরিচিতজনদের বাসায় গেছেন।
হিউস্টন সিটির ক্ষুদ্র একটি অংশে বন্যা কিংবা জলোচ্ছ্বাসের পানি উঠেনি এবং সেখানেই বাস করছেন ফোবানা’র নির্বাহী কমিটির চেয়ারপার্সন আজাদুল হক। বুধবার রাতে তিনি এই সংবাদদাতাকে জানান, ‘৩৫ বছর যাবৎ বাস করছি এ সিটিতে। কখনো এমন ভয়ংকর জলোচ্ছাস বা বন্যা কিংবা ঝড়ো হাওয়া দেখিনি। টানা ৬ দিন যাবৎ ঝড়ো হাওয়ার সাথে প্রবল বর্ষণের ঘটনাও দেখিনি। অর্থাৎ সবকিছু কেমন যেন পাল্টে গেছে।’
টানা ভারী বর্ষণে তলিয়ে যাওয়া বাড়ি-ঘরে মূল্যবান দ্রব্য-সামগ্রী রেখেই সকলকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। সেগুলো অক্ষত নেই। এমনকি, পানি নেমে গেলেও সে সব বাড়ি পুনরায় নির্মাণের প্রয়োজন হবে। অর্থাৎ বিশাল একটি ক্ষতির শিকার হয়েছেন সকলেই। যাদের দুর্যোগের ইন্স্যুরেন্স নেই, তারা ফেমা তথা ফেডারেল ইমার্জেন্সী ম্যানেজমেন্ট এডমিনিস্ট্রেশন (The Federal Emergency Management Administration)’র দ্বারস্ত হবেন উল্লেখ করেন আজাদ।
সর্বপ্রথম হারিকেন হার্ভে আঘাত করে কর্পাস কৃষ্টিতে। সেই সিটির অধিবাসী ও হোটেল ব্যবসায়ী রহিম র্যা নিহাল বুধবার রাতে এ সংবাদদাতাকে জানান, ‘আমার ১৫/১৬টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একটি সুপার মার্কেটও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলোর জন্য আমি ‘স্টর্ম ইন্স্যুরেন্স করিনি। এখন আমাকে দৌড়াতে হবে ফেমার দপ্তরে। জানি না কতটা সহায়তা পাবো।’
যুক্তরাষ্ট্র যুবলীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক রহিম আরও জানান, ‘ঝড়ের তাণ্ডব অব্যাহত রয়েছে। সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত। কারোরই খাবার নেই। পানি নেই। বাসা কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ নেই। এ অবস্থায় আজ (বুধবার) সারাদিন দেখলাম শত শত স্বেচ্ছাসেবী এসেছেন পানি ও শুকনা খাবার নিয়ে। রেডক্রসের লোকজন পানিবন্দী মানুষদের খোঁজ নিচ্ছেন। ন্যাশনাল গার্ড এবং অঙ্গরাজ্য পুলিশ টহল দিচ্ছে দুর্গত এলাকায়। আমাকে সবচেয়ে বেশী অভিভূত এবং আশান্বিত করেছে ক্ষতিগ্রস্ত তথা ভিকটিমদের জন্য শত শত আমেরিকানকে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসতে দেখে।’
যদিও সন্ধ্যার পরই বিদ্যুৎহীন এলাকাসমূহে কার্ফিউ (সান্ধ্য আইন) জারি করা হচ্ছে লুটতরাজ ঠেকাতে। রহিম জানান, ‘সকলেই কোরবানির পশু ক্রয়ের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। মসজিদ, কম্যুনিটি সেন্টারে নামাজের প্রস্তুতি ছিল। এখন আর কোনটাই সম্ভব হবে না। কোন কোন এলাকা পানি মুক্ত থাকলেও অন্যদের দুর্দশার কারণে ঈদ উদযাপন কীভাবে সম্ভব?’
প্রসঙ্গত, আগামী ১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র ঈদুল আজহা পালিত হবে।
এদিকে, বুধবার সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে হিউস্টন সিটি কর্তৃপক্ষ জানায় যে, এই দুর্যোগে একই পরিবারের ৬ জনসহ শুধুমাত্র হিউস্টন সিটিতেই মোট ৩০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। দুর্গত এলাকা পরিদর্শনের পর ক্ষতিগ্রস্তদের ঘুরে দাঁড়াতে দ্রুততম সময়ে সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তার অঙ্গীকার করেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ সময় ট্রাম্পের সাথে মঙ্গলবার রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন টেক্সাস অঙ্গরাজ্য গভর্নর গ্রেগ এ্যাবট। এর কয়েক ঘণ্টা পর অর্থাৎ বুধবার এক প্রেস কনফারেন্সে গ্রেগ বলেন, ‘২০০৫ সালে হারিকেন ক্যাটরিনার ভয়াবহতাও ছাড়িয়ে গেছে এবারের হার্ভের তাণ্ডব। এমনকি নিউইয়র্ক-নিউজার্সির কয়েকটি এলাকায় ২০১২ সালে হারিকেন স্যান্ডির আঘাতকেও ম্লান করেছে এই হার্ভে। ক্যাটরিনায় ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১২০ বিলিয়ন ডলার। হিউস্টন এলাকায় ক্ষতির পরিমাণ এখনও বলা না গেলেও তা যে ১৬০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এ অর্থ সংস্থানের জন্যে কংগ্রেসের অনুমোদনের বিকল্প নেই।
টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ উল্লেখ করেছেন, ন্যাশনাল গার্ডের ১২ হাজার সদস্য ছাড়াও ৬৯০ মেরিন-সেনাকেও উদ্ধার তৎপরতায় নিয়োগ করা হয়েছে। অঙ্গরাজ্যের পুলিশও সক্রিয় রয়েছেন। বুধবার পর্যন্ত ১৮ হাজার পানিবন্দী মানুষকে উদ্ধারের তথ্য জানায় রাজ্য প্রশাসন। ফেমার পক্ষ থেকে জানানো হয়, বুধবার পর্যন্ত ১০ লাখ মানুষ আবেদন করেছেন অর্থ ও খাদ্য সহায়তার জন্য। অপরদিকে টেক্সাস ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক সেইফটি বলেছে যে, ঝড়ের তাণ্ডবে ৪৮ হাজার ৭০০ বাড়ি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিডি-প্রতিদিন/৩১ আগস্ট, ২০১৭/মাহবুব