শুক্রবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

মনোলিখন যন্ত্র

বাবলু ভঞ্জ চৌধুরী

মনোলিখন যন্ত্র

প্যাকেটটা খুললেই কাঙ্কিত বস্তু!

‘কী মুশকিল! কি করে জড়ানো-প্যাঁচানো প্যাকেটটা! খুলতেই তো বারো বেজে যাবে!’ নখ  দিয়ে স্কচ টেপের স্তর ছেঁড়ার চেষ্টা করতে করতে বলল রাহাত সাহেব!

‘তুমি একটা আস্ত পাগল! দাঁড়াও!,’ বলতে বলতে মিসেস রাহাত চলে গেল ছুরি আনতে।

‘পাগল কি আর অমনি হয়েছি! এত একটা রোমাঞ্চের বস্তু...’

‘কি বললে?’ ফিরে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করল মিসেস রাহাত।

‘না, বলছি কাঁটা ভেঙেই তো ফল ছোঁয়া!’

‘হেহেহে!’ মিসেস রাহাত হেসে ছুরি বাড়িয়ে দিল, ‘এই নাও! এবার দেখো!’

প্যাকেট খুলে কয়েক পর্দার আবরণ উন্মোচন করতেই রাহাত সাহেবের হাতের চামড়ায় পরশ ঘটল বস্তুটির। হেডফোনের মতো দেখতে, কালো কুচকুচে রং। মেটাল না প্লাস্টিক বোঝা দায়।

‘বাআআআ...! এরই এত গুণ!’ চোখ চওড়া করে চোখের সামনে ধরে বলল রাহাত সাহেব, শরতের আকাশের মতো সরল হয়ে গেল তার মুখ। বিশ বছর আগে রাহাত সাহেবের মুখ এমন সরল ছিল, এক সেকেন্ডের এক লক্ষ ভাগের এক ভাগ সময়ের জন্য সেই মুখ-স্মৃতি মনে পড়ল মিসেস রাহাতের। কিন্তু তার তো রাহাত সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় নেই। তার মুখটা সন্দেসের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে, দুচোখে ছুঁচোর মতো ব্যস্ত দৃষ্টি দিয়ে রাহাত সাহেবের হাতে থাকা বস্তুটি পরখ করছে।

বস্তুর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আনন্দে রাহাত সাহেবের মুখ দিয়ে হাই ফ্রিকোয়েন্সিতে বেরিয়ে গেল, ‘আরে এতেই হয়ে যাবে সব কাজ!’

মিসেস রাহাত ঠোঁটে আঙুল চেপে বলল, ‘আস্তে!’ তারপর ডানদিকে চোখ ঘুরিয়ে ইশারা করল। খোলা দরজা দিয়ে রাকাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখা গেল, ‘ঘুমুচ্ছে! উঠে গেলে এ যন্ত্র এক্ষুণি হাতিয়ে নেবে!’

তাদের সতের বছরের ছেলে রাকা। বেলা এগারটা পর্যন্ত ঘুমায়। দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে বলে রাহাত সাহেব খুব জ্ঞান-ট্যান দেয়। আজ মনে মনে বলল, ‘দেরি করে উঠলে সুবিধেও আছে, ঘুমুক! দুপুর পর্যন্ত ঘুমুক!’

দুজনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে চলে গেল অন্যঘরে। ল্যাপটপে বস্তুটির লেজের একটা জ্যাক গেঁথে রাহাত সাহেব হেডফোনের মতো অংশটি মিসেস রাহাতের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আগে তোমার লেখাটা দেখি!’

‘আমার!’ দ্বিধা মেশানো কণ্ঠে বলল মিসেস রাহাত, ‘আচ্ছা ঠিক আছে দাঁড়াও!’ বলে চোখ বুজে প্রস্তুতি নিল, এই মুহূর্তে সে বুঝল যে, মনের ওপর তার বিশ্বাস নেই।

রাহাত সাহেব মিসেস রাহাতের মাথায় যন্ত্রটির হেডফোনের মতো অংশ পরাতে লাগল।

‘ইউজার গাইড ভাল করে দেখেছ তো?’

‘হ্যাঁ, ওরা রিভিউও পাঠিয়েছে মেইলে,’ পরাতে পরাতে বলল রাহাত সাহেব।

‘পরলেই যা ভাবব, তার সবই লেখা হয়ে উঠবে নাকি!’

‘যা ভাববে সবই উঠবে, কিন্তু সেটা কিবোর্ডের স্পেসবার ছেড়ে দিলে, ভাবনার লেখ্যরূপ না চাইলে স্পেসবার চেপে ধরে রাখ!’ মিসেস রাহাতের মাথায় চমৎকার সেট হয়েছে যন্ত্র।

মিসেস রাহাতের মুখ থেকে খ্যাক করে হাসি বেরিয়ে  গেল, ‘তার আর দরকার কি? আমার চিন্তা তো পরিষ্কার!’ তবু সে বাম হাতের আঙুল দিয়ে কিবোর্ডের স্পেসবার চেপে ধরল, ডানহাত মাথায় তুলে যন্ত্রটির ঠিকঠাক অবস্থা পরখ করে নিল।

মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের একটি ব্লাঙ্ক ফাইল ওপেন করে রাহাত সাহেব বলল, ‘এবার দেখি তুমি কি ভাবছ?’

মিসেস রাহাত সৌজন্যের হাসি ছড়িয়ে স্পেসবার ছেড়ে দিল, ল্যাপটপের স্ক্রিনে পরিষ্কার বাংলা অক্ষর উঠে একটা অর্থবোধক লাইন হল, ‘রাকা এখন যেন না ওঠে...’ স্পেসবার চেপে ধরল মিসেস রাহাত, মুখে বাঁধভাঙা হাসি, ‘সত্যিই আমি এটিই ভেবেছিলাম, আশ্চর্য যন্ত্র হাঃহঃাহাঃ!’ মিসেস রাহাত হাঁপ ছাড়ল, মিস্টারের সামনে স্ক্র্রিনে মন পাতিয়ে দেওয়া বড় রিস্কি। স্পেসবারের কাজটি সত্যিই চমৎকার, কৃতজ্ঞ সে। এ অবস্থায় তার এখন একটা ছবি তুলতে ইচ্ছে হচ্ছে।

যন্ত্রের আশ্চর্য ক্ষমতা স্বচক্ষে দেখে আনন্দে গদগদ হয়ে পড়েছিল রাহাত সাহেব। অভিনেতার মতো সেটা চেপে রাখল, আনন্দবোধের জলে কর্তৃত্বের একটা নৌকা ভাসিয়ে ভারিক্কি মুখে বলল, ‘এত বেলা হয়েছে-তবু তুমি চাওনা যে রাকা উঠুক! আশ্চর্য!’

মিসেস রাহাত নুইয়ে পড়ল, ‘আরে না! কিছু তো একটা ভাবতে হবে, তাই অমন ভাবছিলাম, টেস্ট করলাম টেস্ট হেহেহে!’

রাহাত সাহেব বুঝে চুপ মেরে গিয়ে এতক্ষণের রাশ টেনে ধরা আনন্দের বান খুলে দিয়ে হো-হো করে হেসে উঠল, ‘যাই বল, যন্ত্রটা কিন্তু খুব উপকারী, টাইপ করা যে কি ঝামেলা, এখন আমি শুয়ে থেকেও লিখতে পারব হেহেহে!’

‘আচ্ছা ওতে কি ঘুমিয়ে থেকেও লেখা যাবে?’

‘দূর! তাই হয় নাকি! ঘুমের সময় তো তুমি তোমার চিন্তাকে চালাতেই পারবে না, তখন তোমার চিন্তার চালক অবচেতন মন, অবশ্য সে যেভাবে চালাবে, সেভাবে লেখা উঠবে!’

দুজনেই কিছুক্ষণ থেমে গেল। রাহাত সাহেব হালে লম্বা হওয়া গোঁফের টিকি মোড়াচ্ছে, আর মিসেস রাহাত নাকের আগা মেসেজ করছে।

‘এবার তুমি পরীক্ষা করে দেখো তো ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা!’

রাহাত সাহেব বলল, ‘বসব, অফিসের কাজ আছে টাইপ করার, মনে মনে পড়ব, দিব্যি লেখা হয়ে যাবে, সময়টা বাঁচবে!’

‘কি মা?’ দরজায় চোখ কচলাতে কচলাতে হাজির রাকা। আঙুলের ফাঁক দিয়ে সে আগেই দেখেছে, এখন মুখ ফুটে বলবে, কিন্তু যন্ত্রটার নাম মনে করতে পারছে না বলে হয়ে উঠল না, ঘরের মধ্যে খানিকটা ছুটে গিয়ে রাগ আর আদিখ্যেতা মেশানো কণ্ঠে বলল, ‘এটা এসেছে, আমাকে ডেকে তুলবে না!’ হাই তোলা ঠেকাতে পারল না বলে অন্যদিকে মুখ ঘোরাল রাকা।

‘ডেলিভারি ম্যান সবে দিয়ে গেল, ঠিকঠাক আছে কিনা পরীক্ষা করছিলাম,’ মিসেস রাহাত হেসে ছেলের হাত ধরে যন্ত্রের টেবিলের কাছে নিয়ে এল।

রাহাত সাহেব বলল, ‘এটা কিভাবে কাজ করে জানো তো?’

‘জানি জানি, ভিডিও দেখে কাল রাতেই শিখেছি।’ রাকা চেয়ারে বসে গেল, হেডফোনের মতো অংশটা মাথায় পরল, স্পেসবার ছেড়ে দিল।

‘কি ব্যাপার! কোনো লেখা উঠছে না, শুধু লাইন উঠছে! খারাপ হয়ে গেল নাকি!’ তেতো মুখে বলল রাহাত সাহেব।

‘আমি তো এখনও চিন্তাই করিনি, সব গুলিয়ে দিয়েছ তোমরা!’ স্পেসবার এবং দাঁত, দুটোই চেপে বলল রাকা।

ছেলের মধ্যে কৃতজ্ঞতাবোধ তৈরি হচ্ছে না, মানসিক রোগ, ডাক্তার দেখানো দরকার-হাঁ হয়ে ভাবল মিসেস রাহাত।

‘আচ্ছা ঠিক আছে! এবার দেখ তো! ’ রাকার মাথায় যন্ত্রটা ঠিকভাবে সেট হয়েছে কিনা পরীক্ষা করতে করতে বলল রাহাত সাহেব।

রাকা একটু রাগতভাবে রাহাত সাহেবের হাতটা ঝাড়া মেরে সরিয়ে বলল, ‘ওটার কোনো দোষ নেই!’ রাকা ঠিকঠাকভাবে বসে স্পেসবার ছেড়ে দিল। অক্ষর বসে বসে লাইন তৈরি হলো- ‘বাবা-মা আর তেমন নেই।’ স্পেসবার চেপে ধরল রাকা।

‘ঠিক আছে? তুমি কি এটাই ভেবেছ?’ যন্ত্র ঠিকভাবে কাজ করেছে কিনা জানতে বেশি আগ্রহী রাহাত সাহেব।

‘হ্যাঁ, সম্ভবত আমি এটাই ভেবেছি।’ যন্ত্রের আশ্চর্য কারিশমায় না হেসে পারল না রাকা, ‘আশ্চর্য যন্ত্র!’

আহ্ ! অফিসের কাজ এবার তরতরিয়ে হবে-মনে মনে ভেবে আনন্দ উপভোগ করে রাহাত সাহেব।

যন্ত্রের ক্ষমতা টের পেয়ে মিসেস রাহাতও আনন্দে উদ্বেলিত, তার একবার মনে হয়েছিল রাকার চিন্তাটা নিয়ে কথা বলা দরকার, কিন্তু তা হারিয়ে গেল।

রাকা স্পেসবার ছেড়ে দিল, লাইন তৈরি হলো-‘যন্ত্রটা আমায় দিয়ে দেওয়া উচিত।’

স্ক্রিনে এই লেখা দেখে মিস্টার ও মিসেস দুজনে মিলে ছেলের উপর হুমড়ি খেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ঠিক আছে? তুমি কি এটাই ভেবেছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘বাহ্! চমৎকার পারফরমেন্স!’ একসাথে বলল দুজন। রাকা আবার স্পেসবার ছেড়ে দিল, লাইন উঠল-‘যদি এটা আমাকে দেওয়া না হয়, আমি নিরুদ্দেশে যাব!’

‘ঠিক আছে তো? তুমি কি এটাই ভেবেছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘বাহ্ ! গর্বিত ! আমরা গর্বিত!’ মিস্টার ও মিসেস এ ওর হাতে হাত ঠোক্কর দিয়ে ধেই ধেই করে নাচতে লাগল।

রাকা স্পেসবার ছেড়ে দিল, লাইন তৈরি হলো-‘এটা আমাকে না দিলে বাবা-মাকে খুন করব...’

দুজনে আবার হুমড়ি খেয়ে পড়ল রাকার ওপর, ‘তুমি কি এটাই ভেবেছ?’ সকৌতুকে দুজনেই একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল।

‘আমি নিশ্চিত এটাই ভেবেছি!’

‘বাহ্বা বারে বাহ্! কী দারুণ সার্ভিস! বাহ্বা বারে বাহ্, ’ ধেই ধেই নৃত্য আরও বেড়েছে, মিসেস রাহাত ভাবছে, রাতে ঘুমন্ত রাহাতের মাথায় যন্ত্রটি বেধে তার মনের ছল-চাতুরি জেনে নেবে, এ আনন্দে সে আরও জোরে জোরে বেখাপ্পা নাচ নাচছে, কিন্তু হঠাৎ এত জোরে জোরে নাচের কারণে রাহাত সাহেবের মনে সন্দেহ জাগতে পারে, তাই মিসেস রাহাত গদগদ ভাব করে বলল, ‘কত দাম গো কত দাম এর!’

‘অমূল্য!’ নাচের দাপটে পড়ে যেতে যেতে বলল রাহাত সাহেব।

‘অ্যাই পোড়ো না!’ জামা খামচি কেটে ধরে মিস্টারকে সামলালো মিসেস, ‘অমূল্য তো জানি, তবু এর দাম?’

‘এ কি দাম দিয়ে কেনা যায়! মিস্টার কুঁই এবং মিসেস কুহু দুজনে মিলে এটা আমাদের গিফট করেছে।’

ধেই ধেই নৃত্য হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্য বরফ হয়ে গেল।

‘মিসেস কুহু আমাকে বলেছে-এটা তোমার মাথায় দিলে আমার অশান্তির কারণগুলো দেখতে পাব! বাহ্বা বারে বাহ্,’ একাই নাচতে যাচ্ছিল রাহাত সাহেব।

‘থাম!,’ বেলুন ফাটার মতো করে বলল মিসেস রাহাত, ‘ওই রাক্ষুসির কথা একবারও বলবে না আমার সামনে!’

‘তাতে কি হয়েছে! এই যন্ত্রের অর্ধেক দাম তো সে-ই দিয়েছে! যা পারে বলুক!,’ হাসতে হাসতে বলল রাহাত সাহেব, ‘কি অপূর্ব এর কাজ, না?’

‘তা অবশ্য তা অবশ্য,’ বলতে বলতে হাসতে লাগল মিসেস রাহাত, ‘মিস্টার কুঁইও আমাকে বলেছে যে..., ’ এ পর্যন্ত বলে মিসেস রাহাত নাচবে বলে হাত বাড়িয়ে দিল। রাহাত সাহেব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে স্থির থেকে পরক্ষণেই হেসে অস্থির হল। দুজনের হাসির আগুনে বরফ হয়ে যাওয়া ধেই ধেই নৃত্য এবার রীতিমত ফুটতে লাগল। রাকার কাছে তা অগ্নিকান্ড, এখন তা রাকার দিকেই এগোচ্ছে, সে মুখ শক্ত করে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর