শুক্রবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা
শুভ জন্মদিন

কবি দিলারা হাফিজ

শামীম আজাদ

কবি দিলারা হাফিজ

লন্ডনে হালকা শীত পড়েছে। এখন আর আগের মতো ঝুল বারান্দায় যাই না। কিন্তু আজ গেলাম। আজকের দিনটাকে দেখা দরকার। আজ যে বাংলাদেশের প্রথিতযশা কবি দিলারা হাফিজের জন্মদিন। বিলেতের এই যে ধূসর আকাশ, আকাশের এই প্রকা- ছাদ, এই একই ছাদের নিচে ভিনদেশে সেও শুয়ে আছে। টরেন্টোতে রাত আর আমার এখানে প্রভাত। আমার প্রভাতের কোনা থেকে ভেসে আসে সুদূর বাংলাদেশের গঙ্গাবুড়ির পাল। আর তখনই শহরের ঘুম ফুঁড়ে এপিং ফরেস্টের দিকে চলে যায় ট্রেন। আমি ট্রেনের শব্দে আনমনা হয়ে যাই। মনে পড়ে যায় আমাদের যৌথযাত্রার কথা। দিলারা আর আমি দৈবের বশে একদিন এক স্টেশনে নেমেছিলাম। কথাটা মনে হতেই আকাশের দিকে তাকাই! যক্ষের কথাও মনে পড়ে। ওই যে একখন্ড মমতার মতো মেঘ তা ভেসে ভেসে টরেন্টোর ওপর গিয়ে বরফবৃষ্টি হয়ে তাঁর আইসবোট টেরাস কি ঢেকে দেবে? আমার বার্তা পৌঁছে দেবে?

মনটা আর্দ্র হয়ে ওঠে। ওঁর ওই বিধাতার কাজল দেওয়া চোখ জোড়ার কথা মনে হলে আনন্দে আমার মনটা ভরে যায়। ওই সরল কেশগুচ্ছের ওড়াউড়ির কথা মনে হলে আমার বাংলাদেশের বইমেলার কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় বাংলা একাডেমিতে রফিক ভাইয়ের কক্ষে হাসতে হাসতে হাত থেকে চা ছলকে পড়ার কথাও। “কত কথা পুষ্প প্রায় বিকশি তুলিতে চায় কত অনুরাগে”।

আমি ভাগ্য মানি, এই সেই পুরাতন একই আকাশ যেখানে বাংলাদেশে আশির দশকে দুই কাব্য সহচরীর কবি হয়ে ওঠার কাহিনি গেঁথে আছে। দিলারার ভালোবাসার মানুষটিই আমার অগ্রজসম, আমার কবিতার গুরু। দিলারা নিজেই লিখেছেন, “আমাদের দু’জনেরই কবিতা-অস্ত্রবিদ্যার গুরু ছিলেন একজনই। তিনি কবিতার সেনাপতি, দ্রোণাচার্যের মতোই গুরু অবশ্য। মুক্তিযাদ্ধা-কবি রফিক আজাদ”। কথা সেটাই- দিলারা আর আমার আকাশটা এক। আমার গুরুকে নিয়ে দিলারা আরও লিখেছেন, “সংসারে সন্ন্যাসী একজন কবিকে হৃদয়ে লালন করেছি নীলাচল জ্ঞানে, রাধিকা স্বপ্ন-প্রেমের গৌরাঙ্গ স্বরূপে। তুমি তখন অনেক দূরে, তবু দু’জন দু’জনার হৃদস্পন্দন স্পর্শ করতে পেরেছি, অনুভব করেছি তুমি আছ আমাদের পাশেই। আত্মার গভীর তলদেশ থেকে তার ডাক শুনেছি”।

আর আমি রফিক আজাদ নামের সে আকাশটা না হলে গল্প লেখা ছেড়ে এই কবিতার ভুবনে হয়তো আসতামই না। আমাদের আচার্য তখন প্রায় হাতে ধরে কবিতা-ধনুকের জ্যা কীভাবে ও কতটুকু টেনে ধরে তারপর শব্দ-তীর ছুড়তে হয় তা শিখিয়েছিলেন। তাঁর মন্দাক্রান্তা লয় ধরে যখনই কবিতার পথ পেলাম তখনই দিলারা আর আমার বন্ধুত্বের শুরু। বয়সে সে আমার ছোট তা আর মনেই থাকল না। দু’জনেই সরকারি কলেজে বাংলা পড়াই। এদিকে তখনই রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, রুবি রহমান, বেলাল চৌধুরী, অসীম সাহা, শাহজাদী আঞ্জুমান আরা, দিলারা হাফিজ ও  আর আমি- এই আট কবি- চার গ্রন্থের যুগলন্দীতে ১৯৮২-তে এক মলাটের নিচে যুথবদ্ধ হয়ে দাঁড়াই। সে ‘প্রেমের কবিতা’ সে সময় বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে হইচই ফেলে দেয়। টক অব দ্য কবিতা টাউন হয়ে ওঠে। কবিতা ও কবিগণের জন্য তো বটেই। সামনের মলাটজুড়ে নাসির আলী মামুনের তোলা আমাদের প্রোট্রেট, প্রকাশনার অভিনবত্বও হয়ে ওঠে আলোচনার বিষয়। আমি আমার মাত্র পনেরখানা কবিতা নিয়ে জুটি হয়েছিলাম বেলাল চৌধুরীর আর দিলারা হয়েছিলেন রফিক আজাদের। জীবনের পাথর কোথায় বসে আছে কেউ জানে না। সেখান থেকেই তাঁরা জীবনজুটি হলেন। আর কবিতা আন্দোলন ‘পদাবলী’ থেকে, জাতীয় কবিতা পরিষদের জন্মলগ্ন থেকে আমাদের যৌথ কাব্যযাত্রা।

দিলারা হাফিজ একজন কবি, প্রাবন্ধিক, অসাধারণ বক্তা। সব ছাড়িয়ে তার কবিসত্তাই আমাদের সামনে প্রখর। জীবনকে কবিতার তাড়নায় এনে তিনি হেঁটে চলেন সমান্তরাল। মাতৃত্ব মায়া, সন্তানের কায়া, দেশ এবং বিদেশের আঙিনা সেখানে আকুলতায় একাকার। দিলারার শব্দগুলো বাণী হয়ে যায় অথবা বাণী হয়ে যায় তার কাব্যের কূজন। প্রবন্ধ, ভ্রমণগদ্য সবই হয়ে ওঠে কবিতা। বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, গবেষণা, শিশুতোষ ও সম্পাদনাসহ প্রায় পনেরোর অধিক।  তিনি লাভ করেছেন নানান সম্মাননা।

দিলারা হাফিজ শক্তিমান কবি। তাঁর কাব্যের বোধ, চিত্রকল্প, শব্দশৈলী অসাধারণ। তাঁর কবিতা পাঠককে উপলব্ধির গভীরে নিয়ে যায়। সব মিলিয়ে দিলারা আনখশির শুধুই কবি।  যদি আমাদের দেশে নারী-পুরুষ বিভাজন যদি হতো গৌণ, অপ্রাসঙ্গিক এবং অনভিপ্রেত তবে বহু আগেই তাঁর কাব্যগুণ হতো নায্যতায় বিবেচিত স্বীকৃত।  

শুভ জন্মদিন কবি। আপনার মঙ্গল হোক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর