শুক্রবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

সাহিত্যিকদের প্রেমপত্র

সাহিত্যিকদের প্রেমপত্র

পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম সব প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে। তবুও এসব প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে হৃদয়ে বাসা বাঁধে প্রেম-ভালোবাসা। শক্তিশালী মহাবীরও প্রেমের চরণে কাবু হয়েছেন। সেই তালিকা থেকে বাদ যাননি তাবৎ কবি-সাহিত্যিকও। কবিহৃদয় প্রেমের সর্বোচ্চ আশ্রয়। কবি হৃদয় প্রেমকে  কল্পনা করেন নানান সৌকর্যে, নানান গুণে এবং নানান মহিমায়। তাদের মধ্যে কিছু সাহিত্যিক আছেন যারা প্রেমপত্রের প্রেমিক হিসেবে পরিচিত। প্রেয়সী কাছে না থাকায় পাঠিয়েছেন প্রেমের চিঠি। বিশেষ করে ইতিহাসের সেরা ভালোবাসার প্রমাণস্বরূপ লিখে গেছেন প্রেমপত্র। সেসব কালজয়ী চিঠি নিয়ে আজকের আয়োজন। লিখেছেন- আবদুল কাদের

 

 

প্রেমিক কবির প্রেম রচনা

প্রেম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের রচনা সবার কাছে পরিষ্কার। বাস্তব প্রেমের চেয়ে তিনি কাল্পনিক প্রেমই দেখেছেন অনেক বেশি। কবির রচনায় কাদম্বরী দেবী, মৃণালিনী দেবীকে হারানোর বেদনা ও ভালোবাসার আকুলতা ঠাঁই পায় এবং প্রেয়সীর চিঠির ব্যাকুলতার তীব্রতা দেখা যায়, ‘পত্রের প্রত্যাশা’ কবিতায়। মৃণালিনী দেবী তাকে লেখা চিঠিগুলো আগলে রেখেছিলেন সযতেœ। তার মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিঠিগুলো আবিষ্কার করেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- ‘দেখিলাম খানকায় পুরাতন চিঠি, স্নেহমুগ্ধ জীবনের চিহ্ন দু’চারটি, স্মৃতির খেলনা-কটি বহু যত্ন করে, গোপনে সঞ্চয় করি রেখেছিলেন যারে।’ এ ছাড়া অনেকেই ভাবেন আর্জেন্টাইন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ১৯২৪ সালে কবির সঙ্গে ভিক্টোরিয়ার পরিচয়। কবি লিখেছেন- ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী।’

 

নজরুলের বিরহগাথা পত্র

নজরুলকে কবি নজরুল হিসেবে গড়ে তুলতে নারীর প্রেম, বিরহ যে বিশেষ উপাদান হিসেবে কাজ করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নার্গিস ছিলেন নজরুলের জীবনের প্রথম নারী। নার্গিস নজরুলের বাগদত্তা ছিলেন। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বিয়ে ভেঙে যায়। তবু কবি নার্গিসকে কোনো দিন ভুলতে পারেননি। নার্গিস পরবর্তীতে তাদের ভুলগুলো বুঝতে পেরে প্রায় ১৫ বছর পর নজরুলকে একটি চিঠি  লেখেন। চিঠির উত্তরে নজরুল একটি চিঠি ও গান পাঠিয়েছিলেন, যাতে চিঠির উত্তরটি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছিল। কবি লিখেছেন, ‘তোমাকে লেখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক। যেখানেই থাকি, বিশ্বাস করো, আমার অক্ষয় আশীর্বাদ কবচ তোমায় ঘিরে থাকবে। তুমি সুখী হও, শান্তি পাও এই প্রার্থনা। আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস করো, আমি তত মন্দ নই এই আমার শেষ কৈফিয়ত।’

 

বন্ধুকে অ্যালেনের চিঠি

তারা দুজনই বেস্ট ফ্রেন্ড। একে অপরের খুব ভালো বন্ধু। একজন লেখক অ্যালেন গিন্সবার্গ অন্যজন কবি পিটার ওরলভস্কি। পিটারের অনুপ্রেরণাতেই অ্যালেন গিন্সবার্গ আজ পৃথিবীর বুকে একজন সাহিত্যিক। তাদের বন্ধুত্বের জুটি ছিল কয়েক দশকের সমালোচকদের শরীরে জ্বালা ধরানোর অন্যতম কারণ। গিন্সবার্গ তার বন্ধুকে ভীষণ ভালোবাসতেন। তাই তো চিঠিতে লেখেন-

‘প্রিয় পিটে, আমার ভালোবাসা, কীভাবে যেন সব বদলে যাচ্ছে! আপনি ভয় পাবেন না, কোনো ভয়ঙ্কর সুন্দর কিছু ঘটেনি। ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না। এতটুকু বলতে পারি, আপনাকে ছাড়া আমার জীবন খালি খালি মনে হয়। আত্মার কাছাকাছি হয় না।’ চিঠির উত্তরে পিটার  লেখেন, ‘অ্যালেন চিন্তা করবেন না। আমরা আমাদের বিশ্বকে বদলাব। এমনকি আমরা মরে গেলে পরকালে রঙধনু হব।’

 

দ্বন্দ্বমুখর প্রেমের চিঠি

মেক্সিকোর জনপ্রিয় চিত্রশিল্পী ফ্রিদা কাহলো। সৃজনশীল জগতের এক বিস্ময়। জীবন ও সৃষ্টিকর্মকে এনেছেন অনন্য যোগসূত্রে। রঙতুলির এই কারিগর জীবনে নানা সমস্যায় পড়েন। ছেলেবেলার দুঃসহ দুর্ঘটনার স্মৃতি, মা হতে না-পারার অতৃপ্তি, জন্ম-মৃত্যুর ভাবনা এবং প্রিয়তম দিয়েগোর সঙ্গে ব্যক্তি জীবনের নানা দ্বন্দ্বমুখর সম্পর্কের বেড়াজালে কাটিয়েছেন। অসাধারণ এই চিত্রকর দিয়েগোকে চিঠিতে লিখেন- ‘দিয়েগো, সত্য এত মহান যে, আমি কথা বলতে, শুনতে এবং ঘুমোতে তোমায় ভালোবাসতে চাই না। না পাওয়ার যন্ত্রণা আমার হƒদয়ের মারাত্মক ফাঁদ মনে হয়। হয়তো তুমি বলবে এসব নিছক পাগলামি। তবে আমি জানি, তোমার নীরবতা আমার জন্য কেবল বিভ্রান্তিই হবে।

 

ব্যর্থ প্রেমে আত্মহত্যা

রুশ কবি মায়াকোভস্কি। এক পাগল প্রেমিকও। মঞ্চ ও চলচ্চিত্রও কাঁপান মায়া। জীবনের নানা অধ্যায় নিয়ে লিখেছেন কবিতা ও গল্প। লিলিয়া ব্রিককে মায়া প্রচ- ভালোবাসতেন। অধ্যায়টা শুরু হয়েছিল কিশোরকাল থেকেই। কিন্তু লিলিয়া আরেক কবি ওসিপ ব্রিককে বিয়ে করেন। পরবর্তীকালে মায়া লিলিয়ার ছোট বোন এলসাকে বিয়ে করেন ঠিকই; কিন্তু লিলিয়াকে ভুলতে পারেননি। বিখ্যাত কবিতা ‘ব্যাকবোন ফ্লুট’ (শিরদাঁড়া বাঁশি), কবি মায়া তার প্রেমিকা লিলিয়াকে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন। কবিতাটিতে প্রেম বেদনার কোনো সীমা নেই। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কবি মায়া নিজেকে অত্যন্ত অসহায় বোধ করতেন এবং এক সময় আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

 

ইলিয়ানা-হিকক গসিপ

খুবই গভীর বন্ধুত্ব তাদের। পরিচয় কোনো এক সাক্ষাৎকারে। একজন ফার্স্ট লেডি ইলিয়ানা রুজভেল্ট এবং অন্যজন সাংবাদিক লরেনা হিকক। ইলিয়ানা-লরেনা সম্পর্কের গসিপ ছিল তৎকালীন হট টপিক। ‘অ্যাম্পটি উইথআউট ইউ’ বইয়ের লেখক রজার স্ট্রেটমেটার তুলে ধরেন তাদের ভালোবাসার গল্প। বইটি ইলিয়ানা-লরেনের প্রেমের অন্যতম সাক্ষী। বইটিতে রয়েছে কিছু চিঠি, অন্তরঙ্গ মুহূর্ত এবং ভ্রমণের গল্পকথা। এমনকি স্বামী প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টও বলেছেন তাদের মধুর সম্পর্কের কথা। ইলিয়ানা হিকককে চিঠি লিখেন- ‘প্রিয় হিক, তোমার কণ্ঠ কত ভালো লাগছিল! সত্যি বলতে সেই অনুভূতি বোঝানো সম্ভব নয়। তবে, মজার ব্যাপারটি হলো, আমি ট্রেইম ও টিডোরকে কখনই বলতে পারিনি তোমার-আমার সম্পর্কের কথা। তবে, মনে রেখ, তোমার কথা ভাবতে ভাবতে আমি প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়ি।’

 

ওয়াইল্ডের সমকামী চিঠি

শুদ্ধতার বাই তোলা ওয়াইল্ড ছিলেন সমকামী। নীতি-চাদরের আড়ালে একাধিক পুরুষের সঙ্গে শরীর-মনের চাহিদা মেটাতেন তিনি। সমকামিতার অভিযোগে জেলও খাটেন এই সাহিত্যিক। ওয়াইল্ডের এই ঘটনা এত দূর গড়িয়েছিল যে, দীর্ঘদিন পর্যন্ত লোকে তা নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করতেও দ্বিধা বোধ করত। ওয়াইল্ডের পুরুষসঙ্গী অল্পবয়সী আলফ্রেড ডগলাস। ওয়াইল্ডের প্রকাশিত চিঠিতে এই তরুণের প্রতি তার অনুরাগ ফুটে উঠেছিল স্পষ্ট। চিঠিতে লেখা ছিল- ‘আপনার গীতি কবিতা অসম্ভব সুন্দর। দারুণ ছিল সেই বাচনভঙ্গি। আপনার লাল-গোলাপি ঠোঁট চুম্বনের উন্মাদনা জাগায়।’

 

লেখিকার অসম প্রেম

প্রেম মানে না কোনো বয়স। ইংরেজ কবি ভিটা সেকভিলই তার দারুণ দৃষ্টান্ত। সেকভিল লেখক ভার্জিনিয়া উলফকে ভীষণ পছন্দ করতেন। কিন্তু ভার্জিনিয়া ছিলেন তার চেয়ে ১০ বছরের বড়। অসম এই প্রেম ছিল উপন্যাসের চরিত্রের মতোই। আবেগ, অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বের অনন্য নজির ছিলেন এ দুই লেখিকা। একবার সেকভিল ভার্জিনিয়ার উদ্দেশে চিঠি লেখেন। তাতে লেখা ছিল- ‘আমি অন্ধকারের দুঃস্বপ্নে একটি চিঠি লিখলাম। সম্ভবত আপনি আমার অস্পষ্ট অক্ষরগুলো অনুভব করতে পারবেন না। তবে এটা সত্য যে, আপনাকে আমার ভীষণ মনে পড়ে। চিঠিটা তো শুধু বলার মাধ্যম। আপনি বিনয়ী, আপনাকে আমি নিজের মতো ভালোবাসি না।

হে প্রিয়, আমি আপনার সামনে দাঁড়াতে পারি না। সম্ভবত, আমি আপনাকে অনেক বেশি ভালোবাসি। আপনি বাঁধ ভেঙেছেন, তবে আমি প্রতিবাদ করব না।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর