শুক্রবার, ২১ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা
গল্প

বিপন্ন বিস্ময়

মাজহারুল ইসলাম

বিপন্ন বিস্ময়

সামিয়ার জন্মদিন আজ।

এবারেও মামুন দেশের বাইরে। গত তিন বছর ধরে একই ঘটনা ঘটছে। সামিয়ার জন্মদিনের ঠিক কয়েকদিন আগেই মামুনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে যায় বিদেশে।

আগে সামিয়ার খুব মন খারাপ হতো। এখন সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মামুনের অনুপস্থিতিটা সে আলাদাভাবে আর অনুভব করে না। বরং মনে হয় মামুন না থাকলেই ভালো। দেশে যখন থাকে সেই তো একই অবস্থা। অফিস-মিটিং-পার্টি, এগুলো নিয়েই তো ব্যস্ত। বিয়ের পর প্রথম দুই-এক বছর জন্মদিনে রাত বারোটা এক মিনিটে ফুল-কেক নিয়ে হাজির হতো মামুন। বছর দুই যেতে না যেতেই দেখা গেল, এইসব বিষয় নিয়ে মামুনের কোনো আগ্রহ নাই। কখনো কখনো সে ভুলেও যায়। যদিও সে বলে, এই ভুলে যাওয়া ইচ্ছাকৃত নয়। কাজের চাপে অনেক সময় মনে থাকে না। ভুলে যাওয়া মানে ভুলে থাকা না। মামুনের এইসব কথায় একসময় সামিয়া তার কষ্টগুলো ভুলে যেত। তার মনে হতো, কাজের চাপে একটা মানুষ ভুলে যেতেই পারে। পরদিন যখন দামি কোনো গিফট নিয়ে হাজির হতো মামুন, তখন সামিয়া আর কিছুই মনে রাখত না। এখনো যে তার মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়, সেটা মামুনকে সে বুঝতে দেয় না। বিশেষ করে গত কয়েক বছর ধরে তো একেবারেই না।

মামুনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মাহফুজ সামিয়ার জন্মদিন কখনো ভোলে না। আজও সন্ধ্যার পর সামিয়ার প্রিয় ফুল আর পাঁচতারকা হোটেল থেকে চিজ কেক পাঠিয়েছে। সেই সঙ্গে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের একটা নেকলেস। মামুন শুনে বলল, ভালোই তো, মাহফুজ আমার দায়িত্ব পালন করেছে। আর করবেইবা না কেন? মাহফুজ আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমাদের বন্ধুত্ব কতদিনের! বছর পনেরো তো হবেই।

সামিয়া কোনো কথা না বলে চুপ করে আছে। ইদানীং মামুনের কথাগুলো খুব ক্লিশে মনে হয় তার কাছে। মামুন আবার বলল, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দিনগুলোর কথা মনে আছে তোমার?

সামিয়া আস্তে করে বলল, হুম, কেন থাকবে না?

মামুন বলল, শোনো, আমি ফেরার পথে আমস্টারডাম যাব। কেন যাব ওখানে, জানো?

সামিয়া বলল, না।

মামুন বলল, পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো ডায়মন্ড তৈরি হয় আমস্টারডামে। সেখান থেকে তোমার জন্য ডায়মন্ডের পুরো একটা সেট নিয়ে আসব।

সামিয়া এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখিয়ে বলল, এত কষ্ট করে আমস্টারডাম যাওয়ার প্রয়োজন কী? আমার তো জুয়েলারির অভাব নেই। তুমি বরং সরাসরি ঢাকায় চলে আসো।

মামুন কিছু বলার আগেই লাইন ডিসকানেক্ট হয়ে গেল। এরপর মামুন বেশ কয়েকবার ফোন করলেও সামিয়া ফোন ধরল না। কারণ এ মুহূর্তে মামুনের সঙ্গে এক মুহূর্তও কথা বলতে ইচ্ছা করছে না তার। বরং ফোন সাইলেন্ট করে বারান্দায় গিয়ে বসল। মন খারাপ থাকলে সামিয়া বারান্দায় বসে আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। বারান্দা থেকে আকাশটা বেশ দেখা যায়। আশপাশে এরচেয়ে উঁচু কোনো দালান না থাকায় কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। বারান্দায় এলেই আকাশটা যেন সামিয়ার সঙ্গী হয়ে ওঠে। সম্ভবত সামিয়ার অপেক্ষাতেই থাকে অবারিত আকাশ। সামিয়া তারা দেখে, কথা বলে তারাদের সঙ্গে। আজ আকাশে কোনো তারা নেই। কালো মেঘ জমে আছে। ঝিরিঝিরি ঠাণ্ডা বাতাস। যে-কোনো সময় বৃষ্টি নামবে। হঠাৎ সামিয়ার মনে হলো, তার জীবনটাও তো কালো মেঘেই ঢাকা পড়ে আছে। সব রং যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

সামিয়া যখন মামুনের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করত, তখন থেকেই মাহফুজকে চেনে সে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় মাহফুজ বাইরে বসে বন্ধুকে প্রটেকশন দিত। অসীম ধৈর্য মাহফুজের। ছয়-সাত ঘণ্টা সে বাইরে বসে আছে আর ওদিকে রুমের ভিতর মামুন-সামিয়া একান্তে সময় কাটাচ্ছে। মাহফুজের সঙ্গে খুব বেশি কথা হতো না সামিয়ার। 

বিয়ের পর মামুন খুব দ্রুত বদলে যায়। এই বদলে যাওয়া মানে সামিয়ার প্রতি তার আকর্ষণ কমে যাওয়া নয়। আলাদিনের চেরাগের মতো অল্প সময়ে মামুনের ব্যবসায় উন্নতি ঘটতে থাকে। কাজেই ব্যবসায় তাকে অনেক সময় দিতে হয়। দিন-রাত খাটতে থাকে মামুন। রাত ১১টা-১২টার আগে বাসায় ফিরতে পারে না। ক্লান্ত শরীরে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ওই খাবারের টেবিলেই যা দু-একটা কথা হয় তাদের।

তরতর করে মামুন এগিয়ে যেতে থাকে। দুই বছরে গাড়ির মডেল বদলায়, ভাড়া অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে নিজের বাড়িতে উঠে পড়ে। এসবের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে সামিয়া হাঁপিয়ে ওঠে। তার ভয় হয়। প্রচণ্ড ভয় হয় তার। একদিন মামুনকে বলল, আমার ভয় লাগে মামুন। যেভাবে তুমি টাকার পেছনে ছুটছ, তাতে আমার আশঙ্কা হচ্ছে একসময় আমাকেই না ভুলে যাও! এত অর্থ, বিত্তবৈভব তো আমাদের দরকার নেই মামুন।

মামুন সামিয়ার গালে একটা টোকা দিয়ে বলে, কী যে বলো না! টাকার সঙ্গে তোমাকে ভোলার সম্পর্ক কী? বরং টাকাই যে-কোনো সম্পর্ককে আরও মজবুত করে। টাকা ছাড়া জীবনের কোনো মূল্য নেই সামিয়া। টাকা ছাড়া কাউকে তুমি খুশি করতে পারবে না।

সামিয়া চিন্তিত হয়ে বলল, তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু কত টাকা দরকার? আর টাকার পেছনে ছুটতে গিয়ে আমাকেই না ভুলে যাও তুমি!

মামুন বলল, তোমার বোঝার বুল সামিয়া। তোমাকে ভুলে যাব- কথার মানে কী? দীর্ঘদিনের সম্পর্ক, অনুভূতি, ভালোলাগা ইচ্ছা করলেই কি ভুলে যাওয়া যায়? এটা তো পুতুলখেলা নয় সামিয়া।

সামিয়াও জানে এটা পুতুলখেলা নয়। কিন্তু মামুন যেভাবে তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, সেটা মেনে নেওয়া যায় না। দাম্পত্যজীবন মানে শুধু এক ছাদের নিচে বসবাস নয়। মামুন তো মাসের পর মাস এক ছাদের নিচেও থাকে না। রেসের ঘোড়ার মতো টাকার পেছনে অবিরাম ছুটে চলেছে। শুধু ব্যবসা, ব্যবসা আর ব্যবসা। ক্লায়েন্ট মিটিং, সেমিনার, প্রেজেন্টেশন- এসব কথা শুনতে শুনতে সামিয়া ক্লান্ত। সবই নাকি জরুরি। ঘর-সংসারের প্রতি মামুনের যেন কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। সামিয়া এক হাতে সবকিছু টেককেয়ার করে আসছে।

সাত বছর হলো বিয়ে হয়েছে তাদের। সন্তানাদি কিছু হয়নি। একবার সিঙ্গাপুর এবং একবার ব্যাংককে ডাক্তার দেখিয়েই মামুন ক্লান্ত। একদিন খাবার টেবিলে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মামুন বলেছিল, দেখো, আমার পক্ষে এভাবে ডাক্তারের দরজায় দরজায় ঘোরা সম্ভব না। বাচ্চা না হলে কী করার আছে? জোর করে তো আর বাচ্চা পয়দা করা যাবে না। বেশি শখ থাকলে তুমি একটা বাচ্চা অ্যাডপ্ট করো। আমার জিএমকে বলো। সে সব ব্যবস্থা করে দেবে। টাকা কোনো সমস্যা না, সেটা তুমি ভালো করেই জানো।

সামিয়া সেদিন মামুনের কথায় হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। অপলক চোখে মামুনের দিকে চেয়ে থেকেছে। ভেবেছে, মামুন এসব কী বলছে? তার মানে মামুনের কাছে বাচ্চার কোনো মূল্য নেই? টাকা দিয়ে সে সবকিছু কিনতে চায়? সেদিনই সামিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, চিরকাল নিঃসন্তান থাকলেও সে বাচ্চা অ্যাডপ্ট করবে না।

কিছুদিন আগের কথা। সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের গাইনি ডাক্তার জুলিয়ান লি কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বলেছিল। কিন্তু মামুন কোনোভাবেই সেসব পরীক্ষা করতে রাজি হয়নি। তার মানে কী এই যে,   সন্তান না-হওয়ার দায় নিজের কাঁধে নিতে চায় না সে?

মামুনকে অনেক বুঝিয়েছে মাহফুজ। সে বলেছে, তোর যে সমস্যা আছে সেটা আগেই ধরে নিচ্ছিস কেন? আর যদি থাকেও, সেটা চিহ্নিত করে তার চিকিৎসাও তো করা যেতে পারে। মামুনের সাফ জবাব- এসব করার মতো সময় তার নেই।

সে যাত্রায় জরুরি বিজনেস মিটিং পড়ে যাওয়ায় সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকা না এসে প্যারিস চলে যায় মামুন। সামিয়া অবশ্য খুব আপত্তি করেছিল। সে বলেছিল, নিজের স্ত্রীর জন্য একটা বিজনেস মিটিং কি ক্যানসেল করতে পার না? আমাকে এভাবে একা ফেলে চলে যাবে!

মামুন বলেছিল, এক জীবনে অসংখ্যবার সিঙ্গাপুর আসা যাবে কিন্তু আমার বিজনেস মিটিং চেঞ্জ করা যাবে না। অনেক বড় একটা ডিল হবে। তা ছাড়া তুমি একা হবে কেন? মাহফুজ তো সঙ্গে আছেই।

সামিয়া আর কোনো কথা না বলে হোটেলের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার চোখ দুটি অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিল। কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ। নিজেকে অতি কষ্টে সংবরণ করেছিল সামিয়া। তারপর তাকিয়ে ছিল সন্তোশা আইল্যান্ডের বিশালাকারের লায়নটার দিকে। দূর থেকে লায়নটাকে ঝাপসা দেখাচ্ছিল। অনেকটা ক্যামেরায় আউট অব ফোকাসের মতো। সামিয়ার মনে হয়েছিল, মামুনও যেন নীরবে তার ফোকাসের বাইরে চলে যাচ্ছে।

২.

বছর দুই পরের ঘটনা। মামুন দেশের বাইরে। দুবাই। সামিয়া খানিকটা দেরি করে ঘুম থেকে উঠল। তাঁর শরীরটা ভালো লাগছে না। বিছানা থেকে নামতে গিয়ে মাথাটা কেমন যেন চক্কর দিয়ে উঠল। রহিমার মা ঘরের আসবাবপত্র মোছামুছি করছিল। দৌড়ে এসে সামিয়াকে ধরে ফেলল। অল্পের জন্য রক্ষা। ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানকে খবর দেওয়া হলো।

বিকেলে জানা গেল, সামিয়ার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। একজন নারীর জীবনের পূর্ণতা আসে মাতৃত্বের মাধ্যমে। সামিয়া মা হতে চলেছে। সন্ধ্যায় মামুন ফোন করলে খবরটা তাকে জানায় সে। মামুন টেলিফোনের অন্য প্রান্ত থেকে চিৎকার করে ওঠে, আমি বাবা হচ্ছি? কী বলছ সামিয়া! এর থেকে আনন্দের খবর আর কী হতে পারে? আমি বলেছিলাম না ধৈর্য ধরো! আমি কালই চলে আসছি।

মামুন একনাগাড়ে কথাগুলো বলে গেল।

সামিয়া চুপচাপ মামুনের কথা শুনছে। তার ভিতরে কোনো উচ্ছ্বাস নেই। নিস্পৃহ কণ্ঠে সে শুধু বলল, কালই আসতে হবে কেন? তুমি তোমার কাজ শেষ করে আসো। এত তাড়াহুড়োর কী আছে?

মামুন বলল, কী বলছ তুমি! এত বড় একটা আনন্দের খবর, আর আমি এখানে বসে থাকব? তুমি সাবধানে থাকবে। আমি কালই চলে আসছি।

সামিয়া ‘শরীর খারাপ লাগছে’ বলে আর কথা না বাড়িয়ে ফোন রেখে দিল। মামুনের অতিরিক্ত আনন্দ দেখে সামিয়া খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়ল।

৩.

মামুন ঠিকই পরদিন রাতে ফিরে এলো। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের ফ্লাইট। এয়ারপোর্টের ফর্মালিটিজ শেষ করে বাড়ি আসতে রাত প্রায় ১২টা বেজে গেল। গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত গতিতে ভিতরে ঢুকে সামিয়ার নাম ধরে ডাকতে শুরু করল। রহিমার মা এগিয়ে এসে বলল, আপায় তো শুইয়া পড়ছে। শরীলডা বেশি ভালা না।

মামুন এবার বেডরুমে ঢুকে গেল। সামিয়া তাকে দেখে বিছানা থেকে উঠতে গেলে মামুন তাকে উঠতে নিষেধ করল। বলল, না না, ওঠা যাবে না। তোমার এখন অনেক বিশ্রাম দরকার।

এরপর বিছানায় বসে নিচু হয়ে আলতো করে সামিয়াকে আদর করল। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, আমি অসম্ভব খুশি হয়েছি সামিয়া। তুমি মা হচ্ছ- এর থেকে আনন্দের আর কী আছে! বিশ্বাস করো, অনেক বড় একটা বিজনেস মিটিং ক্যানসেল করে চলে এসেছি। কংগ্র্যাচুলেশনস!

সামিয়া আস্তে করে বলল, বিজনেস মিটিং ক্যানসেল করার প্রয়োজন ছিল না। এখন যাও, ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও।

মামুন বলল, আমার খাওয়া নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। আজকে খাওয়া আমার কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না।

সামিয়া অবাক হয়ে মামুনের দিকে তাকিয়ে আছে। অচেনা এক মানুষকে দেখছে সে। এ মামুন এতগুলো বছর কোথায় হারিয়ে ছিল? এ মামুনকে সে চেনে না।

মামুন সবচেয়ে বেশি ঝামেলা করে খাওয়া-দাওয়া নিয়ে। দুপুরের খাবার রাতে খাবে না। যত বড় মাছই হোক না কেন, দুই দিনের বেশি ফ্রিজে থাকলে সেটা খাবে না। প্রতিটা খাবার হতে হবে আগুনগরম। খাবে কম কিন্তু আয়োজন থাকতে হবে টেবিলভর্তি। সামিয়ার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি ঝগড়া হয়েছে মামুনের খাওয়া নিয়ে। অনেক কথা মনে পড়ছে সামিয়ার। একটা সন্তানের জন্য কি না সে করেছে! একবিন্দু সহযোগিতা মামুনের কাছ থেকে পায়নি। ডাক্তারের দেওয়া পরীক্ষাগুলো পর্যন্ত করেনি সে। অথচ আজ বাচ্চার খবর শুনে তার আনন্দের শেষ নেই।

৪.

মামুন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। সব সময় সামিয়ার টেককেয়ার করছে, যদিও সামিয়ার এটা একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না। খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া দেশের বাইরে মিটিংয়ে যাচ্ছে না। অফিস থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোনে খোঁজখবর নিচ্ছে। রাতে ঘুমানোর সময় পেটের মধ্যে হাত দিয়ে বাচ্চার উপস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে।

কয়েকদিন আগে মাহফুজ এসেছিল বাসায়। মামুনের সে কী উচ্ছ্বাস! মাহফুজকে জানাল, সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে কথা বলে রেখেছে। তাদের প্রথম সন্তান সেখানে হবে। অরচার্ড রোডে সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্ট ঠিক করা হয়ে গেছে। সন্তান জন্মের সম্ভাব্য তারিখ হলো ১৬ নভেম্বর।  দুই মাস আগে সামিয়া সেখানে চলে যাবে। সঙ্গে তার মা থাকবে। এ ছাড়া গৃহপরিচারিকা রহিমার মা এবং জোবেদাও সামিয়ার সঙ্গে যাবে। সবার ভিসার জন্য আবেদন করা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে ভিসা পেয়ে যাবে। মামুন যাবে এক সপ্তাহ আগে। মাহফুজকেও তাঁর সঙ্গে যেতে বলেছে। মাহফুজ বলেছে, দেখা যাক।

মামুনের এ অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস সামিয়ার পছন্দ না। অবশ্য সিঙ্গাপুরের বিষয়ে সামিয়াই প্রথম মামুনকে বলে যে, তার ইচ্ছা বেবিটা সিঙ্গাপুরে হোক। মামুন সঙ্গে সঙ্গে বলে, অবশ্যই। তুমি চাইলে আমরা নিউইয়র্ক-লন্ডন যে-কোনো জায়গায় যেতে পারি।

সামিয়া বলেছিল, আমি সিঙ্গাপুরেই যেতে চাই।

মামুন আর কথা বাড়ায়নি। এরমধ্যে পাঁচ মাস হয়ে গেছে। বাচ্চার মুভমেন্ট বোঝা যায়। মামুনের পাগলামি আরও বেড়ে যায়। কিছুদিন আগে সে রোমে গিয়েছিল ক্লায়েন্ট মিটিংয়ে। ফেরার সময় দুই স্যুটকেসভর্তি বাচ্চার জিনিসপত্র কিনে এনেছে। সামিয়া খুব খুশি হয়েছে বলে মনে হলো না। বিষয়টি মামুনের দৃষ্টি এড়ালো না। এ ছাড়া সে লক্ষ করছে, সামিয়া সারাক্ষণ চুপচাপ থাকে। তার স্বভাবসুলভ সেই প্রাণচঞ্চলতা অনেক দিন ধরে অনুপস্থিত। বিশেষ করে প্রেগনেন্সির পর থেকে শারীরিক পরিবর্তনের পাশাপাশি মানসিক পরিবর্তনও চোখে পড়ার মতো। মামুন এ বিষয়ে খুব মাথা ঘামাতে চায় না। মামুন শুনেছে, এ সময়ে মেয়েদের শরীরে নানা ধরনের হরমোনাল পরিবর্তন ঘটে। সেসবের কারণে হয়তো সামিয়া সাময়িক বদলে গেছে।

৫.

সামিয়ার সিঙ্গাপুর যাওয়ার দিন-তারিখ ঠিক হয়ে গেছে। ১৬ সেপ্টেম্বর। তার মা এবং দুজন গৃহপরিচারিকা সঙ্গে যাবে। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি অরচার্ড রোডের সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে উঠবে। মামুন যাবে ডেলিভারি ডেটের সাত দিন আগে।

সামিয়া সিঙ্গাপুর পৌঁছে পরদিনই ডাক্তারের কাছে গেল। ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আগে থেকেই করা ছিল। চায়নিজ ডাক্তার জুলিয়ান লি তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানাল সবকিছু ঠিকঠাক আছে। সাত দিন পর একটা আলট্রাসনোগ্রাম করতে বলল এবং সম্ভাব্য ডেলিভারির তারিখও জানিয়ে দিল। এরপর জিজ্ঞেস করল, তোমার হাসবেন্ড কোথায়?

সামিয়া বলল, ও কাজ নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত। সময়মতো চলে আসবে।

লি বলল, এই সময় হাসবেন্ড পাশে থাকা খুব জরুরি।

সামিয়ার মা আড়চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। তাঁর তাকানোর মধ্যে গভীর মাতৃস্নেহ ও মায়া জড়িয়ে আছে।

সামিয়া বলল, সময়মতো থাকবে।

এরপর মাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো।

হাসপাতালের লম্বা করিডর দিয়ে নিঃশব্দে দুটো মানুষ হাঁটছে। বেশ খানিকটা পথ কারও মুখে কোনো কথা নেই।

মামুন প্রতিদিন কমপক্ষে দুবার ফোন করে খোঁজখবর নেয়। সামিয়া খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করছে কি না? রাতে ঘুমানোর আগে এক গ্লাস দুধ খেতে যেন সে ভুলে না যায়। ডাক্তারের পরবর্তী তারিখ কবে? কোনো সমস্যা হলে তাকে যেন দ্রুত জানানো হয়। মামুনের বন্ধু শহিদ দীর্ঘদিন ধরে সিঙ্গাপুরে আছে। যে-কোনো সহযোগিতা লাগলে তাকে যেন নিঃসংকোচে ফোন করে।

সামিয়ার মাঝে-মধ্যে মনে হয়, মামুন অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছে। একদিন সে বলেই ফেলল, আমি তো বাচ্চা না যে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন করে খোঁজখবর নিতে হবে!

মামুন বলল, দেখো, এ সময়ে আমার উচিত ছিল তোমার সঙ্গে থাকা। বুঝতেই পারছ যে আমার ব্যস্ততার জন্য আসতে পারছি না। ডেলিভারি ডেটের ঠিক সাত দিন আগে আমি চলে আসব।

সামিয়া মামুনের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ‘ঘুম পাচ্ছে’ বলে ফোনটা রেখে দিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। পর্দাটা খানিক সরিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সে। অরচার্ড রোডের আলো ঝলমলে শপিংমল থেকে একগাদা মানুষের কোলাহল যেন সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে।  কেউ কি তাকে ডাকছে? সামিয়া চোখ বন্ধ করে দুহাতে শক্ত করে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। সব রঙিন আলো মুহূর্তেই যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। সেখানটায় নিকষ কালো অন্ধকার নেমে এলো। সব কোলাহল যেন সেই অন্ধকারে গিয়ে নৈঃশব্দ্যে পরিণত হলো।

সামিয়ার দুচোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছে। কখন মা এসে পাশে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রেখেছেন, সে লক্ষ করেনি। এই প্রথম সামিয়ার বড্ড একা লাগে নিজেকে।

৬.

সামিয়াকে ডেলিভারি ডেটের পাঁচ দিন আগেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো। নিয়মিত চেকআপ করতে গিয়ে দেখা গেল বাচ্চার নড়াচড়া কম। অথচ সামিয়া বিষয়টি বুঝতেই পারেনি। এ ছাড়া পানিও কমে গেছে। ডাক্তার জুলিয়ান লি বলল, তোমাকে আজকেই ভর্তি হতে হবে। আমি কোনোরকম ঝুঁঁকি নিতে চাই না।

সামিয়া দুপুরেই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে গেল। মামুনকে জানাল সন্ধ্যায়।

খবরটা শুনে মামুন বিচলিত হয়ে পড়ল। উদ্বেগের সঙ্গে সে বলল, আমি কালই আসছি।...

আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল মামুন। সামিয়া তাকে থামিয়ে দিল- না না, তোমার এত দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তোমাকে আসতেও হবে না। এখানে আসার আগে ডিভোর্স লেটারটা সাইন করে এসেছি। তোমাকে তা পাঠিয়েও দেওয়া হয়েছে। পেয়ে যাবে দু-এক দিনের মধ্যে। আর শোনো, এ সন্তান তোমার নয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর