শুক্রবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

রূপসাগরে ডোবে না কেউ

জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত

রূপসাগরে ডোবে না কেউ

রাত্রিশেষে শালুকঢাকা পদ্মবিলের কিনারা ধরে হাঁটবে সে। থামবে সেইখানে শালুকের আবরণ সরালে যেখানে স্পষ্ট হয় স্বচ্ছতোয়ার শরীর। আর জলে নেমে দু’পা গিয়ে নিচে চাইলেই সে দেখবে তার সম্পূর্ণ অবয়ব, মুখচ্ছবিসহ, যদি সেই প্রভাতের রবিকর তাকে ভাসিয়ে দিয়ে যায়।

আমি-ই তাকে পদ্মবিলের কথা বলেছিলাম। দিগন্তবিস্তৃত সেই জলাধারের রূপ সামান্য বালকের বর্ণনায় কী-ই বা ফোটে-কোনোমতে বোঝানো যায় না শ্বেতরক্তিম সেই আংরাখার যে শেষ নেই! কিন্তু সে বুঝেছিল নিশ্চয়, দেখেছিল সব-ই-দৃশ্যের আড়ালে রয়ে গেলেও।

আমি-ই তাকে শুনিয়েছিলাম ছিন্নবস্ত্র অমলিন কন্যা আর তার হিংসুটে বৈমাত্রেয় ভগিনীর গল্প। অমলিন কন্যা পদ্মবিলে ডুব দিয়ে তীরে উঠে দেখে রাজকন্যার পোশাকে অলঙ্কারে সে ভুবনমোহিনী; দেখাদেখি তার হিংসাগ্রস্ত ভগিনীটিও ডুব দেয় এক-ই পদ্মবিলে। কিন্তু তীরে উঠে দেখে, অলঙ্কার নয়, জলজ কীট জড়িয়ে আছে তার শরীরে, মখমল মসলিন নয়, চিরপরিহিতা কুদর্শনা সে যেন ভিখারিনীই কেবল।

গল্প শুনে সে আমাকে আবার জড়িয়ে ধরেছিল। বলেছিল, তুই যা বলিস, সব-ই সত্যি হয়। এটিও হবে, তাই না? আমি তার দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, এ তো কেবল-ই গল্প। বইয়ে পড়া গল্প। ন-দশ বছর-ই বয়স তো তখন আমার। না হলে বলতাম, গল্প কখনো সত্যি হয় না। আর সে-ও তার সহজ বিশ্বাসে বলত, নিশ্চয়ই হয়।

২.

কোলে তুলে নেওয়ার মতো ছোট তখন আমি ছিলাম না, তবু মাসি আমাকে দেখামাত্র কোলে তুলে নিয়েছিল। স্টেশনে নেমে মামা পালকিতে উঠেছিলেন অন্য কোনো যান না-থাকায়। আর আমি এক পশ্চিমা মাঝির কাঁধে বসে এসেছিলাম পদ্মবিলের পাড় বরাবর ছড়ানো সবুজ পাতার মাঝে ফোটা হাজার শালুকের মেলা দেখতে দেখতে। চার মাইল রাস্তা। প্রভাতসূর্যে তখন তাপ-ও এসেছিল। তাই বুঝি মাসি আমাকে দেখেই কোলে তুলে নিয়েছিল। বয়স্ক মা-বাবা আর বিধবা দিদির সংসারে তখনো কিশোরী একলা মাসি আমাকে তার জীবনের আলো-ই ভেবেছিল বুঝি। হাত-পা ধুইয়ে, মুখ মুছিয়ে খাওয়ায় সে আমাকে আর তেমনি কোলে নিয়েই বেড়িয়ে যায় নিকট প্রতিবেশীদের দেখাতে।

মামাবাড়ির দুইপাশে পুকুর, তার পেছনে আম-কাঁঠালের বাগান, ঘন বাঁশের ঝাড়। পুকুরের পাড়ে পুরনো দিনের দালান, কাচারিবাড়ি। অন্য দু’পাশেও বাড়ির সীমানা অনেক দূর ছড়ানো। বাঁশঝাড়, বাগিচা, জঙ্গল পেরিয়ে মাঝখানে পায়ে হাঁটা রাস্তা ধরেই কেবল যাওয়া যায় সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশীর বাড়িতে। গ্রামের মূল লোকালয়ের শুরুও সেখানেই। গাছপালায় ঘেরা অনেক কটি বাড়ি-ই পরপর সাজানো ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তা বরাবর। রাস্তার পাশে দিয়ে চলে যায় বর্ষার স্রোত নিয়ে পদ্মায় নেমে যাওয়া খালটি। এপাশে আবার জঙ্গল, বাঁশঝাড়, ভিন্ন লোকালয়।

পায়ে হাঁটা রাস্তা ধরে এলে পাড়ার প্রথম বাড়িটিই তাদের-আমার গল্পে মুগ্ধ বিশ্বাসী শ্রোতার। মাসির সখী বলা যায়, যদিও মাসি তখনো হাঁটু পর্যন্ত নামা জামাই পরত আর তার সখীর পরনে শাড়ি। মাসির চেয়ে বড় সে নিশ্চয়-ই তবুও মাসির কোল থেকে আমাকে নেয় সে, বুকে জড়িয়ে ধরে। একটু কাঁদেও বুঝি, মাসিও। মাত্র কিছুকাল আগে মাতৃহীন আমি-আত্মীয়স্বজনের কান্নায় তখনো অভ্যস্ত। নিজে না কাঁদলেও তাদের কান্নার কারণ বুঝি। ততক্ষণে তার ছোট ভাইবোন কটিও চারপাশ ঘিরে দাঁড়ায়। বর্ষার ধারায় কোনো ধুয়ে যাওয়া বারান্দায় উঠে আসে সে। বারান্দায় কাঠের চেয়ারে বসা শীর্ণকায় প্রৌঢ় আমাকে দেখে আমার মৃত মায়ের নাম নিয়ে বলেন, তার-ই ছেলে কিনা আমি। মাসি ও সখী দুজনেই চোখ মুছে মাথা নাড়ে। বারান্দায় বসিয়ে ঘর থেকে নাড়ু, মোয়া ডালায় করে আমার জন্য নিয়ে আসে সে। আমি প্রায় কিছুই খাই না, মাসিও। আমার হাফপ্যান্টের পকেটে সেসব ঢুকিয়ে দেয় সে। ঘরে কি বাইরে আর কাউকে দেখি না। পরে জানি, অনেক আগে মাতৃহীনা সে ছোট কটি ভাইবোন ও রুগ্ন পিতাসহ এই সংসারের মূল।

গ্রামের স্কুল-সকালে শুরু হয়ে দুপুরের পরপর-ই শেষ হয়ে যেত। একলা হেঁটে মামাবাড়িতে ফেরার পথে আমি স্কুলের পেছনে সরষের হলুদ প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, কি দেখতাম ভরা আমনের খেতে ধানের শীষে পাখির ওড়াউড়ি। কখনো দেখতাম অড়হরের ডালে ল্যাজঝোলা পাখি বসে গাছ দুলিয়ে আবার দূরে চলে যায়।  স্কুলের সীমানা ছাড়িয়ে বাজার, বাজারের মুখে পোস্ট অফিস। কখনো ডাকপিয়ন চলে না-গেলে পোস্ট অফিসের বারান্দায় তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতাম

ওই দিন বিকালেই সইয়ের বাড়িতে আসে সে। দিদিমা, বড়মাসিসহ চারজনের মাঝখানে বসি আমি। সবার আদরের দুলাল, নয়নের মণি যেন। আমার নানা গুণের কথা মাসি বলে। এই বয়সেই বড় বড় সব গল্পের বই পড়তে পারি আমি। চাই কি শোনাতেও পারি সেসব গল্প। এই অল্প সময়ের মধ্যে আমার ক্ষমতার কথা মাসি জানলো কী করে ওই বয়সে অমন ভাবা স্বাভাবিক ছিল না। তাই গর্বে বুক ভরেছিল নিশ্চয়। গল্পে গল্পে সন্ধ্যা এসে গেছে প্রায় বুঝলে বড় মাসি বৈকালিক গৃহকর্মের জন্য উঠে যেতে চায়। ছোটমাসির সই তার হাত ধরে টেনে বসিয়ে বলে, আমি-ই করে দিচ্ছি এবং দ্রুত উঠে সে বৈকালিক কর্মে হাত লাগায়। বোঝা যায়, এটি তার জন্য নতুন কিছু নয়।

দু-একদিন পরপর-ই সে বিকালে জঙ্গল বাগিচা পার হয়ে হাঁটা পথ ধরে গল্প শুনতে আসত। কখনো বড়মাসি বই পড়ে শোনাত, কখনো বা আমি আমার পড়া গল্প মুখে মুখে বলতাম। ছোট মাসির লেখাপড়ায় তেমন মন ছিল না। গ্রামের প্রাইমারি স্কুল শেষ করে আর পড়েনি সে। বাড়িতেও না। তবু গল্প শোনায় তারও মন ছিল। সন্ধ্যার আলো জ্বলবার আগেই সবাইকে উঠতে হতো। সখীটিকেও। ঘরে ছোট ছোট ভাইবোন, রুগ্ন পিতা ভুলতে পারে না সে কিছুতেই। কখনো দেরি হলে বেশ কদিন আর আসত না সে। মাসি বলত, ওর বাবাই হয়তো দায়ী এ জন্য।

ওরকম সময়ে বাগিচা, জঙ্গল, বাঁশঝাড় পার হয়ে হাঁটাপথ ধরে মাসিকে নিয়ে, কখনো বা আমি একলাই চলে যেতাম তার বাড়িতে। কখনো ভাইবোনের আবদারে অস্থির, কখনো পিতার সেবায় ব্যস্ত, কখনো রান্নাঘরে আগুনের তাপে স্বেদময়। সে আমাদের দেখলেই হেসে দাঁড়াত সামনে এসে। জড়িয়ে ধরত বুকে আর আমিও তাকে ছাড়তে চাইতাম না। কখনো তাকে ঘরে না-পেলে শুনতাম গ্রামের শেষে পানের বরজে অসুস্থ পিতার বদলি খাটতে গেছে সে। কখনো বা দেখেছি ঘরের চালে উঠে পাতলা হয়ে যাওয়া আস্তরে খড় গুঁজে দিয়ে চালা বাঁধছে। আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম। বড় মাসি, ছোট মাসি বা অমন কাউকে ওই-রকম কিছু করতে দেখিনি বলেই হয়তো।

৩.

আমি মামাবাড়ি যাওয়ার কিছু দিন পরেই ছোট মামা শহর থেকে এসে আমায় স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আমার বয়সে যে ক্লাসে স্বাভাবিক তার চেয়ে দুই ধাপ ওপরেই প্রায়। আসলে এক শ্রেণি ওপরই কিন্তু তখন স্কুলের বছর প্রায় শেষ, ক’ দিন পরেই বার্ষিক পরীক্ষা। পাস করলে তো দুই ক্লাস উপরেই চলে যাব শিক্ষকদের এই কথায় মা রাজি হয়ে যান। আমার নানা গুণের মধ্যে আরও একটি যোগ হয়।

গ্রামের স্কুল-সকালে শুরু হয়ে দুপুরের পরপর-ই শেষ হয়ে যেত। একলা হেঁটে মামাবাড়িতে ফেরার পথে আমি স্কুলের পেছনে সরষের হলুদ প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, কী দেখতাম ভরা আমনের খেতে, ধানের শীষে পাখির ওড়াউড়ি। কখনো দেখতাম অড়হরের ডালে ল্যাজঝোলা পাখি বসে গাছ দুলিয়ে আবার দূরে চলে যায়। স্কুলের সীমানা ছাড়িয়ে বাজার, বাজারের মুখে পোস্টঅফিস। কখনো ডাকপিয়ন চলে না-গেলে পোস্ট অফিসের বারান্দায় তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতাম। পরে পড়তি রোদে বাজারের শেষে পদ্মামুখী স্রোতের খাল পার হয়ে, বাঁশঝাড় জঙ্গলের ছায়ার গ্রামে ঢুকলে বড় মন খারাপ করত। আর তখন দূর গ্রামে ফেলে আসা স্বজনদের চেয়েও আমার গল্পের মুগ্ধ শ্রোতাটির কথাই মনে পড়ত বেশি।

ভরা বর্ষায় রাস্তার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া খালটি দুই কূল ছাপিয়ে ছুটত বড় খালের সঙ্গে মিশে পদ্মায় যাওয়ার জন্য। বড় খালও তখন যেন তীরহীন নদী। বাঁশের সাঁকো পার হয়ে ওপারে গেলে তবেই স্কুল। খালের দুই পাড় থেকে কয়েকটি বাঁশ পাশাপাশি রাখায় সাঁকোর দুই মুখ প্রশস্ত হলেও মাঝখানে পাতা কেবল একটি মোটা বাঁশ। আর বেশ উঁচুতে বাঁধা আর একটি সরু বাঁশ ধরে সেটি পার হতে আমার শরীর কাঁপত। একদিন সাঁকো পার হওয়ার সময়ে এক বাঁশের মাঝখানে এসে এত কাঁপতে থাকি যে চোখ বন্ধ করে ফেলি। তার পর কিছু যেন মনে পড়ে না, মনে পড়ে চোখ খুললে দেখি সাঁকোর প্রশস্ত প্রান্তে দাঁড়ানো আমি। আমার শ্রোতাকুল নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করে যে সেটি আর কিছু নয় কোনো অশরীরী শক্তিই আমাকে একবাঁশের অংশ পার করিয়ে দিয়েছিল। এরকম ঘটনা আরও দু-একটি ছিল।

গরমের সময়ে বড়ঘরের বারান্দায় মাদুর পেতে শুতাম আমি। আর কেউ নয়। মাসিরা, দিদিমা কি দাদু যার যার ঘরে-দরজা দেয়া। ওই বয়সে...তখনো নিতান্ত বালক-ই তো, কেন একলা শোয়ার ব্যবস্থা বুঝিনি। সেটি কি এ জন্য যে, শীতকালে লেপের মধ্যে ছোটমাসি আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমুলেও গরমের সময়ে পারত না-তার শোয়া খুব খারাপ ছিল। এজন্যই কি? অথবা বন্ধ ঘরের গরম আমার সইত না?

অমনি এক রাতে বারান্দায় একলা শোয়া আমার হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। উঠে বসি। মৃদু জ্যোৎস্নার রাত্রী। সদর দরজার দিকে চেয়ে দেখি সাদা কাপড়ে মোড়া এক মূর্তি ধীরে হেঁটে আমার দিকেই এগিয়ে আসে। বিবশ আমি চোখ বন্ধ করি। কতক্ষণ পরে জানি না চোখ খুলে দেখি সদর দরজার পাশে মূর্তিটি তেমনি দাঁড়ানো। আর মেঘ-জ্যোৎস্নার রাতে তখন মেঘ সরে যাওয়ায় সাদা জ্যোৎস্না সদর দরজার পাশে দাঁড়ানো মানকচুর পাতাটিকেই মূর্তি বানিয়েছে। আমার শ্রোতাকুল জ্যোৎস্নার কারুকাজ বিশ্বাস করে না। মাসির সখীটি তো কোনোমতে নয়।

স্কুল থেকে অথবা বাজার থেকে ফেরার সময়ে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকলে রাস্তা কম পড়ত। ঘন বাঁশঝাড়ের নিচে দিয়ে পথ। পাতাঝরার দিনে শুকনো বাঁশপাতা এমন পুরু জাজিম বানাত যে, এক পা তুলে আরেক পা ফেললে পা ডুবে যেত সেই জাজিমে, আর মনে হতো কেউ যেন ঠিক পেছনেই হাঁটছে। পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে সে-ও ফেলে পা, শোনা যায় তার পায়ের আওয়াজ, বাতাসে ভাসে সেই শব্দ। আমি বাঁশপাতায় মোড়া সামান্য পথ দৌড়ে পার হয়ে আসি। এই গল্পেও তারা অশরীরীর চিহ্ন খুঁজে পায়। বাঁশবাগান চিরকাল-ই অজানা শঙ্কায় ভরা, তারা বলে। আর সেই শঙ্কা আদৌ অমূলক নয়। সেটি কাটানোর ক্ষমতা সবার থাকে না।

৪.

ভরা বর্ষার শেষে, শ্বেত শরতের কাল চলে গেলে হালকা কুয়াশার হেমন্তে বৈকালিক গল্পের আসর বসে আবার। অনেক দিন পর সে-ও আসে। বর্ষার ধারায় সিক্ত সজীব সে নয়। শরতের জ্যোৎস্না তার মুখে ছিল না, ম্লানমুখী বিষণ্ন সখীকে মাসি তার বাড়ি গিয়ে ডেকে এনেছিল। কখনো অসুস্থ, কখনো কর্মহীন পিতা তার, নিজে পিতার বদলি খেটে, বনেবাদাড়ে ঘুরে, শাকপাতা এনে, ঘরের পেছনে সবজি ফলিয়ে অর্ধাহারের ব্যবস্থা করে সে, এ সবই জানা। মাসি তার সই-এর দুঃখ কমাতে চেষ্টা করে কিন্তু সখীটি সংকোচে ও লজ্জায় সর্বদা ম্রিয়মাণ। এসব নানা কথাবার্তায় সেদিনের বৈকালিক আসর জমে না। বড়মাসি শেষে জিজ্ঞাসা করে, হ্যাঁ রে, তোর বাবা নাকি বিয়ের চেষ্টা করছে? এমনিতেই ভেজা চোখ তার, এবার জলে ভরে যায়। আমাকে কে বিয়ে করবে দিদি? আস্তেই বলে সে। আর আমি গেলে সংসার-ই বা চলবে কী করে? সে-কথা সবাই জানে, তবুও মাসি বলে, শুনি তোর বাবা নাকি আবার বিয়ে করবে? ম্লান স্বর শোনা যায়, তাকেই বা মেয়ে দেবে কে?

সে দিন আর কোনো গল্প হয় না। যে যার কাজে ফিরে গেলে আমি লণ্ঠন জ্বালিয়ে মাদুর পেতে বারান্দায় বসি স্কুলের বইখাতা নিয়ে। মাসি এসে পাশে বসে। আমার বইপত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করে। নিজেরও কিছু বইপত্র আছে তার। হাইস্কুলে পড়বে বলে মামারা কিনে দিয়েছিল। অনেক পুরনো সে সব বই নিয়েও কখনো সে বসে আমার মাদুরে। কিন্তু আজ নয়। আজ সে এসে মাদুরের এক পাশে শুয়েই পড়ে। অঙ্ক কষতে থাকি আমি। অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে রেখে বলে সে, মেয়েদের বিয়ে না-হওয়া বড় কষ্টের, তাই না? আমি একটু চমকে তার দিকে তাকাই, বিয়ের কথা শুনেই বুঝি। খেয়াল করে দেখি, আজ সে শাড়ি পরা। মনে পড়ে, সেই প্রথম দিন তাকে দেখার কিছু কাল পর থেকেই শাড়ি পরে সে। আর বিয়ে হলেই বা কী? কষ্ট তো তাতেও কমে না! বাল্যবিধবা বড় বোনের কথা ভেবেই বুঝি বলে আবার।

আমার বয়স দশ। প্রাইমারি স্কুল শেষ প্রায়। মামাবাড়ি থেকে লেখাপড়া করি। দাদুর সঙ্গে হাটবাজারে যাই। পোস্টঅফিসে চিঠি আনতে যাই। ছুটিছাটায় ছোটমামা বাড়ি এলে ঝাড় থেকে বাঁশ কেটে সারা দিনের রোদে মামার সঙ্গে বাড়ির চারপাশে বেড়া বাঁধি। আমি কি করব। আমার কোনো-ই ক্ষমতা নেই। মাসিরা যা-ই বলুক না কেন!

৫.

স্কুলের শেষে ফেরার পথে পোস্টঅফিসে যাই। ডাকপিয়ন তখনও ফেরেনি। হাটের দিনে সে বেশি দূরে যায় না। হাটেই চিঠি বিলি করে। যদি মামাদের কোনো চিঠি থাকে এই ভেবে দেরি করি। শেষে বেলা প্রায় পড়ার মুখে ঘরে ফিরি-বাঁশবাগানের শুকনো পাতা মাড়িয়ে, বাড়ির পেছনের সদ্যবাঁধা বাঁশের দরজা খুলে।

রান্নাঘরের বারান্দায় দেখি সবাই বসা। মাসির সইকে নিয়ে আলাপ-কাছে এলেই বুঝি। সারা দিন অন্যের খেতে, মাঠে, ফলবাগানে, ঘোরাঘুরি তার নিত্যকর্ম জানি বলেই রোদে পোড়া ঘামে ভেজা চেহারা দেখে অবাক হই না। তবুও আমি কাছে এলে তাদের কথাবার্তা থেমে যায়। বইখাতা রাখার জন্য ভেতর বাড়িতে যাই। শোবার ঘরের বারান্দার চালে ঝোলানো কাঠের তাকে বইখাতা রেখে ফিরে আসি। রান্নাঘরের দিকে মোড় নেওয়ার মুখে শুনি দিদিমার গলা, বিয়ে হবে তোর, সে তো ভালো কথা, কাঁদিস কেন? কিন্তু বিয়ের পর মাসি, বিয়ের পর-কে রাখবে আমাকে-, কেঁদেই বলে সে, বলে, বুকের কাপড় সরিয়ে দেয়। আর সে মুহূর্তে, রান্নাঘরের বারান্দার দিকে এগোনোর মুখে, আমি দেখি, তার খোলা বুক, মাসিদের কি দিদিমা কারও মতোই নয়। প্রায় আমার-ই মতো।

৬.

বিয়েবাড়ির কোনো চিহ্ন সেখানে ছিল না। তোলা বিয়ে। কনেকে নিয়ে রাখা হবে বিবাহোচ্ছুক পাত্রের গ্রামে-কোনো বাড়িতে। যথাকালে বিবাহস্থলে পৌঁছে দিলে চলবে আনুষ্ঠানিকতা। অসমর্থ পিতার কন্যার জন্য বিবাহরীতিটি নতুন কিছু নয়। তবুও দুপুরের মুখে, ভিন্নগ্রামে কনেকে নিয়ে যাওয়ার আগে, মাসির সঙ্গে তাকে দেখতে যাই আমি। রঙিন তাঁতের শাড়িতে তাকে কনে বউটির মতো-ই দেখায়। মাসি কাছে গিয়ে ক্রন্দমুখী তাকে জড়িয়ে ধরে। আমাকেও হাত বাড়িয়ে ধরে সে। বলে, তুই যা বলিস সব-ই তো সত্যি হয়। তাই না? আমি জবাব দিই, হ্যাঁ।

আশপাশের বাড়ির দু’চারজন পড়শি ছাড়া আর কাউকেই দেখি না। কেবল ভাইবোন কটি তাকে ঘিরে উঠানে দাঁড়ানো। বারান্দায় একটি ফুলপাতা আঁকা টিনের তোরঙ্গ। তার বাবা সেটি হাতে নিয়ে নেমে আসে। তিন-চার ঘণ্টার হাঁটা পথ। এখুনি বেরুতে হবে...বলে তার বাবা ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তার দিকে পা বাড়ায়। সে-ও চলতে শুরু করলে আমরা পেছনে পেছনে যাই। বড় রাস্তার মোড়ে গিয়ে তাকে দেখি। পেছন ফিরে ফিরে তাকায় সে বারবার।

ঘরে ফেরার মুখে আমরা কোনো কথা বলি না। বাড়িতে ফিরেও নয়। অন্তত তার কথা কেউ-ই বলে না।

৭.

অনেক অনেক রাতে ঘুম ভাঙে আমার। স্পষ্ট বুঝি পাশে কেউ বসে আছে। গায়ে তার হাতের স্পর্শ পাই। মুহূর্তে উঠে বসি। সেটিও জ্যোৎস্নার রাত্রি। চাঁদ অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় তার কিছু আলো বারান্দায় আমার মাদুরে পড়েছে। সেই আলোয় দেখি, বিবাহের কন্যা আমার পাশে। আমি কথা বলতে চাইলে সে আমার মুখে হাত চাপা দেয়। কাউকে ডাকিস না। এই আমি চলে যাচ্ছি... বলে ওঠে সে। ওঠার মুখে বলে, ওরা আমাকে নিলো না। সাদা জ্যোৎস্নায় তার চোখে জলের রেখা স্পষ্ট দেখা যায়। তখন প্রায় নিঃশব্দে বলে সে, না থাক আমার কিছু... আমি-ও তো মেয়ে! তার সঙ্গে আমিও উঠে দাঁড়াই। আমাকে আবার, শেষবারের মতোই বুঝি, জড়িয়ে ধরে সে। বলে, তোর কথা সব-ই তো সত্যি হয়, তাই না? আমি কিছু না-ভেবে, কোনো কথা না-ভেবে, সত্য কী অথবা কী মিথ্যা না-ভেবে। চোখ বন্ধ করে বলি, হ্যাঁ।

আমাকে ছাড়ে সে। বারান্দা থেকে নেমে বাইরের দরজার দিকে যায়। জ্যোৎস্নার আলো তখন আবার সেই মানকচুর পাতাটিকে কনেবৌ বানিয়ে দেয়।

৮.

পরদিন সারা গাঁ খুঁজেও তাকে কেউ পাবে না। আমি যদিও জানি সে কোথায়। জানি, সে বড়রাস্তার শেষে পদ্মবিলের কিনারা দিয়ে যাওয়া পায়েহাঁটা পথ ধবে হাঁটবে। জ্যোৎস্নার শেষে না-আলো না-অন্ধকারের প্রভাত তার সামনে পথরেখা স্পষ্ট করে দিলে, সে তার সামনে পাশে পদ্মবিলের শ্বেতরক্তিম শালুক আর সোনালি পদ্মের যোজনবিস্তৃত প্রান্তর দেখবে। আকাশের কোলে লাল মেঘের নিচে তখন আলোর আঁধার। সেই আলোয় চিনে নেবে সে পদ্মবিলের স্বচ্ছতোয়া স্থানটিকে। লাল দিগন্তের দিকে মুখ করে জলে নামবে সে। দুই পা নেমে আরও দুই পা গিয়ে প্রথম ডুবটি দেবে, তারপর উঠে আসবে। রক্তিম দিগন্তের উৎস তখন তার সম্মুখে। জলের কিনারায় দাঁড়াবে সে, মাথা সামান্য নিচু করে দেখবে তার মুখচ্ছবি। দেখবে, জলে কাঁপে নিরাবরণ, নিরাভরণ সৃষ্টির প্রথম নারী। ঈভ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর