মান্না দে’র গান কবে থেকে শুনি, সেটা ঠিক করে বলা যাবে না।
আমি কেন, অনেক বাঙালিই জানেন না!
বিশেষ করে আমাদের বয়সী বাঙালিরা অনেকেই ঠিকঠাক বলতে পারবেন না যে মান্না দে’র গান তাঁরা কবে থেকে শুনছেন।মান্না দে’র এমন কিছু গান রয়েছে, যা শুনলে মনে হয় সব বয়সের শ্রোতার জন্য, কিশোর বয়স পার হওয়ার পর থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত, যেন গানগুলো তাঁর জীবন-আর অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। লেখা আমাদের জন্য!
যেমন অসাধারণ কথা, তেমন সুর, তেমনি গায়নভঙ্গি।
মান্না দে’র গান শোনার সরাসরি প্রথম সুযোগ হয়েছিল আমার নিউইয়র্কে।
জ্যাকসন হাইটসে বিশ্বজিৎ সাহার গ্রন্থ আর গানের দোকান মুক্তধারা।
এক নামে সবাই মুক্তধারাকে চেনে।
নিউইয়র্কে গেলে সময়-সুযোগ হলে মুক্তধারায় আর সবার মতো ঢুঁ দিই। এক দিন সেখানে ঢুকে দেখলাম একটা সুদৃশ্য বড় পোস্টার। পোস্টারে লেখা বিশ্বজিৎ-এর আয়োজনে মুক্তধারা এই কিংবদন্তি গায়কের গানের আসর বসাচ্ছে নিউইয়র্ক শহরে।
পোস্টার দেখে বাঙালি শ্রোতারা টিকিট কিনছে দেদারসে!
বিশ্বজিৎ আমাকে জানাল, শো-এর আগে বা পরে মান্না দে এক দিন দোকানে এক ঝলকের জন্য আসবেন বলে সম্মত হয়েছেন।
সেই সময়ে বিশ্বজিৎ আমাকে ফোন করে দেবে। আমি নীরবে চলে এলে কিছুক্ষণের জন্য এ শিল্পীর সঙ্গে গল্প করার সুযোগ ঘটবে।
আমি চেষ্টা করেছিলাম। এই শিল্পীর লাইভ অনুষ্ঠান দেখার ইচ্ছা ছিল। মুক্তধারার স্টলে সশরীরে হাজির হওয়ারও প্রবল আগ্রহ ছিল।
সেবার দুটির কোনোটাই হলো না।
অন্যান্য কাজের চাপে সৌভাগ্য আমার পক্ষে থাকল না!
কথাও বলতে পারলাম না। গান শুনতে যেতেও পারলাম না। আফসোসটা সঙ্গে নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে ঢাকা ফিরলাম।
তবে দুধের স্বাদ ঘোলে সামান্য মিটল।
মান্না দে যখন মুক্তধারায় এলেন, বিশ্বজিৎ ফোনে একটু ধরিয়ে দিলেন। বিশ্বজিৎ ফোনটা তাকে দেওয়ার আগে বলল, সাগর ভাই- এই যে মান্না দে’র সঙ্গে কথা বলেন!
আমি এত বড় শিল্পীর সঙ্গে ফোনে কথা বলতে চাইনি।
তবু বিশ্বজিৎ যখন ধরিয়ে দিয়েছে, তাঁকে বললাম, আমি আসতে চাই আপনার কাছে। সচক্ষে আপনাকে দেখার সাধ অনেক দিনের। সেই সুযোগটা পরে আমাকে দেবেন।
মান্না দে আমাকে কলকাতার একটা ফোন নম্বর দিলেন।
বললেন, এ নম্বরটা তাঁর ভাইয়ের ছেলের।
ওই নম্বরে যোগাযোগ করতে বলে জানালেন খোঁজ রেখো। আমি মাঝেমধ্যে কলকাতা যাই। ব্যাটে-বলে হয়ে গেলে দেখা করা যাবে।
আমি তো মহা আনন্দিত।
এত বড় শিল্পীর সঙ্গে ফোনে অন্তত কথা বলতে পেরেছি এটাও কম নয়। জানালাম, ঠিক আছে। অবশ্যই আপনার কাছে কখনো আসব। দেশে ফিরে এলাম।
রাধাকান্ত নন্দী একজন গুণী তবলা-শিল্পী। মান্না দে’র গানের সঙ্গে তবলা-সংগত করতেন। একবার কাজে গিয়ে কলকাতায় রাধাকান্ত নন্দীর সঙ্গে কথা হলো।
মান্না দে’র খোঁজখবর পেলাম তাঁর কাছ থেকে। তারপর বেশ কয়েকবারই কলকাতা যাওয়া পড়েছে। তার মধ্যে বার দুই মান্না দে’র ভাইয়ের ছেলের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি দুবারই ফোনে কথা বলিয়ে দিয়েছেন শিল্পীর সঙ্গে। মুখোমুখি হওয়া যাচ্ছিল না আর।
বারবার তাঁকে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণও জানিয়েছি।
কিন্তু তাঁর ব্যস্ততা আর নানা ঝামেলায় আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারেননি তিনি। দেখাও হচ্ছিল না কিছুতেই।
কোনো বাণিজ্যিক শো করা হবে না, শুধু আমাদের নিমন্ত্রণে ঢাকায় এসে একবার ঘুরে যাবেন। এই ছিল আমাদের অ্যাপ্রোচ। ঘটনাটা আর ঘটছিল না।
উনিও তখন বলছিলেন, আমি নিশ্চয়ই ঢাকা আসব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি।
মান্না দে’র সঙ্গে মুখোমুখি যোগাযোগ না হওয়াতে আফসোসটা থেকেই যাচ্ছিল।
শেষ পর্যন্ত ব্যাটে-বলে একবার হলো।
কলকাতায় সেবার গিয়ে পেলাম তাঁকে। কিন্তু ফাইনালি বসাটা আর হলো না। কারণ, সেদিনই তিনি চলে যাচ্ছেন বেঙ্গালুরু। যেখানে তিনি বসবাস করেন স্ত্রীকে নিয়ে। জরুরি কাজ থাকায় সেদিনকার ফ্লাইটে চলে গেলেন।
সেই প্রথম আমি জানলাম, তিনি কলকাতায় থাকেন না। তরুণ বয়সে হিন্দি ছবির গানের ব্যাপক চাহিদাসম্পন্ন গায়ক হিসেবে থাকতেন মুম্বাই। পরবর্তীতে বিয়ে করে বেঙ্গালুরুতে।
সেবার আমি নাছোড়বান্দা।
জানালাম, তবে আমি বেঙ্গালুরু আসছি।
বললেন, আসো। দেখা হবে। প্লেন থেকে নেমে হোটেলে ঢুকে আমায় ফোন দিয়ো। তবে এমন কী কথা বলো তো, যে জন্য তুমি বেঙ্গালুরুতে আসবে? কলকাতায় তো কথা হলোই।
বললাম, কোনোবারেই কিছুতে হচ্ছে না। আমি আসব অন্য কোনো কারণে নয়। শুধুমাত্র আপনার সঙ্গে গল্প করতেই আসতে চাই।
তাঁর কাছে আমার অনেক প্রশ্ন। আমাদের জাদুকর-গায়ক! সেই সময় আনন্দলোক পত্রিকায় তাঁর একটা বড় সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। যেখানে তিনি বলেছিলেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কোনো বড় মাপের শিল্পী নন। মান্নার কাছে আমি সেই মন্তব্য নিয়েও জিজ্ঞেস করতে চাই সরাসরি।
মনে খটকা লেগেছিল। এ কেমন কথা বললেন দে!। মান্না দে যেমন বিশাল মাপের গায়ক, সমসময়ে হেমন্তও তো ছিলেন আরেক বটবৃক্ষ। তবে তাঁর এমন মন্তব্য কী কারণে!
এই প্রজন্মের হেমন্ত মুখার্জি, মানবেন্দ্র, শ্যামল মিত্র, সতীনাথ প্রমুখ একঝাঁক শিল্পী এসে বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছিলেন গ্রামোফোন রেকর্ডে।
অবশ্যই তার মধ্যে মান্না দে ছিলেন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের। জায়গা করে নিয়েছিলেন আলাদা। তাই বলে হেমন্ত সম্পর্কে এহেন মন্তব্য তাঁর মুখে কি মানায়?
আমাকে বেঙ্গালুরুতে আসার অনুমতি দিয়ে জানতে চাইলেন, এই শহরে কোথায় উঠবে?
জানালাম, আমি আসছি। এসে আপনাকে ফোন করে জানাব। তারপর আপনার সময় অনুযায়ী দেখা হবে।
মান্না দে হয়তো মনে মনে ভেবেছিলেন, অত দূরে আমি আসব না।
বেঙ্গালুরুতে গ্র্যান্ড হোটেলে উঠলাম। কলকাতা থেকে যাচ্ছি, চেইন হোটেল। ওটাই চিনি। জানালাম, আমি পৌঁছে ফোন দিয়ে টাইম সেট করলে আপনি চলে আসতে পারবেন কি না।
জানালেন, হ্যাঁ। আমি আসব। হোটেল লবিতেই আড্ডা দেওয়া যাবে।
মান্না দে’র এ কথা শুনে আমি প্লেনে উঠলাম।
গেলাম। হোটেল রুমে গিয়ে ফ্রেশ হলাম। তারপর ফোন করতেই ওপাশ থেকে বিস্ময় গলায়, এত পাগল! তুমি বেঙ্গালুরু পর্যন্ত চলে এসেছ?
বিনয়ের সঙ্গে বললাম, জ্বি। আপনি আসবেন কখন?
মান্না দে বললেন, তোমাকে আমি এক ঘণ্টা পর ফোন করছি।
এক ঘণ্টা পরে আমিই উত্তেজনায় তাঁকে ফোন করলাম।
মান্না দে বললেন, দ্যাখো, একটা মুশকিল হয়ে গেছে। আমার স্ত্রী তো খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমি আসলে আসতে পারব না।
বলছেন কী! ফোনের ওপাশ থেকে আমি তো
স্তব্ধবাক। এতটা দূরে, শুধুমাত্র তাঁর সঙ্গে দেখা করার উপলক্ষ নিয়ে এসেও এবারও দেখা করে যেতে পারব না!
নাছোড়বান্দা হয়ে গেলাম হঠাৎ। বললাম, তবে আমিই আসব আপনার কাছে।
উত্তর দিলেন একটু ভেবে, ঠিক আছে তাহলে তুমি কাল আসো। সকালে আসো।
জীবনে অনেক ভক্তের মুখোমুখি হয়েছেন মান্না দে। কিন্তু কল্পনা করেননি এত পাগল ভক্তও তাঁর আছে।
গেলাম সকালে, তাঁর দেওয়া সময় ধরে।
বাড়িতে ঢুকতেই বললেন মান্না দে, তোমাকে আমি আধা ঘণ্টার বেশি সময় দিতে পারব না। এমনকি চা-ও খাওয়াতে পারব না।
তারপর যা হলো, আধা ঘণ্টা নয়। বললেন দুই ঘণ্টা কথা।
জানালেন, আনন্দলোক কেমন করে হেমন্ত সম্পর্কে আমার বরাত দিয়ে এটা লিখে দিল আমি বলতে পারব না। এমন কথা আমি কি বলতে পারি! হাতে কলম আছে আর লিখে দিল সেটা?
বললাম, প্রতিবাদ পাঠান।
বললেন, লাভ কী? সারা জীবন এমন বহু নিউজ ভুল ব্যাখ্যা করে ছাপা হয়েছে। সেসব নিয়ে যদি মাথা ঘামাই, তবে গানটা হবে না। আমার গানের কাজ আমি করে যাই। ওদের লেখার কাজ ওরা লিখে যাক।
আরও জানালেন, আমার যারা ভক্ত, যেমন তুমি বুঝেছ- আমি এমন কথা বলতে পারি না। তারা তো ঠিক বুঝেছে আমি কতটা সাধারণ মানুষ। এ ধরনের আলটপকা মন্তব্য আমি লিখে দিলে কোনো কোনো কাগজ সেটা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করবে। বেশি বড় বড় মানুষের মুখোমুখি হতে ভয় পাই বলে আমার জীবনে কফি হাউসে যাওয়া হয়নি। সে জন্য কলকাতা থেকে দূরে থাকি। আমার স্ত্রী বিদুষী। পড়াশোনা করা মেয়ে। গান আর তার সঙ্গে জীবনযাপনের মধ্যেই আমার যত আনন্দ।
মান্না দে বললেন, আমার গাওয়া গানের মধ্যেও আমি মারপ্যাঁচ করার চেষ্টা করি না। লঘুভঙ্গিতে উপস্থাপনার চেষ্টা করি। গায়কীর কারণে যদি সেটা বিশেষত্ব পায়, পায় উচ্চাঙ্গ মর্যাদা, সেখানে আমার কোনো হাত নেই। আছেন সৃষ্টিকর্তা সহায়।
বাংলা গানে হেমন্ত, হিন্দিতে রফি আর কিশোর কুমারের সঙ্গে নিজের একটা আলাদা অবস্থান তৈরি হয়েছে সেটা ভেবেই তিনি অনেক তৃপ্ত। এর বেশি কিছু প্রত্যাশা করেন না!
মান্না দে সব শেষে বললেন, আমি সবকিছুর পরেও খুব সাধারণ মানুষ হয়ে আজীবন থাকতে চাই। যে কারণে ভিড়ভাট্টা, মূল গণ্ডির বাইরে বেঙ্গালুরুতে এসে থাকছি। আমি নিজের মতো করে নিজের সুখেই বাঁচতে চাই।
কিন্তু কোনো শিল্পীই নিজের মতো করে বেঁচে থাকতে পারেন না। তাঁকে বেঁচে থাকতে হয় শ্রোতাদের হৃদয়ে মনে। মান্না দে’ও তেমনিভাবে বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়জুড়ে।