শনিবার, ২ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

বই পড়াতে এবার সেলুন পাঠাগার

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

বই পড়াতে এবার সেলুন পাঠাগার

প্রচন্ড ভিড়, সময় কাটছে না। ঘুরে আসতে গেলে আবার সিরিয়ালটা নাও থাকতে পারে। সেলুনে চুল-দাড়ি কাটতে গিয়ে প্রচন্ড ভিড়ে বসে না থেকে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে অভিনব কার্যক্রম শুরু করেছে রাজশাহীর কেন্দ্রীয় কিশোর পাঠাগার। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সংগঠনটির উদ্যোগে নগরীর ১০টি সেলুনে আনুষ্ঠানিকভাবে এসব পাঠাগারের উদ্বোধন করা হয়েছে। নগরীর ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের তেরখাদিয়া উপশহর এলাকায় ‘সেলুনভিত্তিক পাঠাগার’-এর উদ্বোধন করেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনোয়ার হোসেন আনার। এটি দেশের প্রথম সেলুনভিত্তিক পাঠাগার বলে দাবি করছেন উদ্যোক্তারা। কেন্দ্রীয় কিশোর পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা সোহাগ আলী বলেন, দিন দিন গণগ্রন্থাগারের পাঠক কমছে। বইপড়ার পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ না থাকায় আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের বইপড়া কর্মসূচি গ্রহণ করি, যেন পাঠক গ্রন্থাগারে না গিয়ে ঘরে বসেই বই পড়ার সুযোগ পান। তিনি জানান, তাদের কর্মসূচির মধ্যে ‘পলান সরকার বইপড়া আন্দোলন’ অন্যতম। যা মহানগরীতে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। নগরীর সব ওয়ার্ডের তিন শতাধিক সেলুনে ‘সেলুনভিত্তিক পাঠাগার’ গড়ে তোলার উদ্যোগের অংশ হিসেবে ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে উপশহর, তেরখাদিয়া, বসুয়া, উপশহর নিউমার্কেট, বিভাগীয় স্টেডিয়াম এলাকা, তেরখাদিয়া কলেজপাড়া এলাকায় ১০টি সেলুনে এ পাঠাগার কার্যক্রম শুরু করেছে কেন্দ্রীয় কিশোর পাঠাগার। পর্যায়ক্রমে নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে তিন শতাধিক সেলুনে ‘সেলুনভিত্তিক পাঠাগার’ গড়ে তোলা হবে বলে জানিয়েছেন এর উদ্যোক্তারা।

রাজশাহী কেন্দ্রীয় কিশোর পাঠাগারটির প্রতিষ্ঠাতা যুবকের নাম সোহাগ আলী। নগরীর তেরখাদিয়া উত্তরপাড়া এলাকায় কেন্দ্রীয় কিশোর পাঠাগারটি গড়ে তুলেছেন তিনি। সোহাগ আলী নিজেই ওই পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক। যুবক-যুবতী থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা মূলত এ পাঠাগারের পাঠক। বই পড়তে এখানে আসেন বয়ঃবৃদ্ধরাও।

এ পাঠাগারের নিয়মিত সদস্য রাজশাহী কলেজের ম্যানেজমেন্ট দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আলী হোসেন। তিনি জানান, অবসর পেলেই এ পাঠাগারে বসেন তিনি। আহরণ করেন অজানা তথ্য। তিনি জানান, এখানে অনেক বই আছে। যেখান থেকে জ্ঞান আহরণ করে নিজেকে যোগ্য করে তোলা যায়। অবসরে খোশ গল্প কিংবা আড্ডা না দিয়ে কিছুটা সময় হলেও কেন্দ্রীয় কিশোর পাঠাগারে সময় কাটান তিনি। সেখানে গিয়ে নতুন কোনো বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারেন। পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা সোহাগ আলী বলেন, ‘জ্ঞানের মশাল প্রজ্বলিত করার দৃঢ় প্রত্যয়ে-এসো পড়ি-দেশ গড়ি’ এ স্নোগানকে সামনে রেখে ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি মাত্র ১৮টি বইকে পুঁজি করে শুরু করি কেন্দ্রীয় কিশোর পাঠাগার। ক্ষুদ্র পরিসরে শুরু হলেও পাঠাগার তৈরির অদম্য ইচ্ছা থেকে পিছুটান ছিল না। নিজের বলতে তেমন কিছু নেই। অভাব-অনটনের সংসার। তাই বলে পাঠাগার তৈরি হবে না।’ নিজের ইচ্ছা ও আগ্রহের কাছে হার মানেননি সোহাগ। প্রায় দেড় যুগ ধরে অল্প অল্প করে সেই পাঠাগারে বই কিনে এখন পরিণত হয়েছে সমৃদ্ধ তথ্যভান্ডারে। আবার কেউ আগ্রহী হয়ে কিছু কিছু বই উপহার দিয়েছেন। বর্তমানে পাঠাগারটিতে ৩ হাজার ১২৮টি বই আছে। পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী প্রতিদিন দুটি জাতীয় ও তিনটি আঞ্চলিক পত্রিকা সন্নিবেশিত করা হয়েছে পাঠ্য তালিকায়। এ ছাড়াও দেশি ও বিদেশি পাঁচটি মাসিক ও ত্রৈমাসিক পত্রিকা রাখা হচ্ছে পাঠাগারটিতে। সোহাগ আলী বলেন, এ পাঠাগারের কারণে ওই এলাকার সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন এসেছে। কয়েক বছর আগে তেরখাদিয়া উত্তরপাড়া এলাকা বেকার ছেলেদের আড্ডার প্রিয় জায়গা ছিল। প্রায়ই সেখানে যৌন হয়রানি, ছিনতাই, চুরির মতো ঘটনা ঘটত। তবে সেই চিত্র এখন পরিবর্তন হয়েছে। সেখানে এখন শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে।

তিনি জানান, পাঠাগারের নাম কিশোর হলেও সব শ্রেণির মানুষের জন্যই এটি উন্মুক্ত। আশপাশের শিশু থেকে বৃদ্ধদের মাঝে পাঠভ্যাস গড়ে তোলার লক্ষ্যে স্থাপিত হয় পাঠাগারটি। সেই থেকে প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত চলে এর কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাঠাগারটিতে পাঠকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন ৩৫ থেকে ৪০ জন পাঠক এখানে আসেন। এ ছাড়াও পাঠাগারটির নিয়মিত সদস্য আছে ১২০ জন। এ পাঠাগারে বাংলাদেশের ৫ জন বিখ্যাত ব্যক্তির নামে নামকরণ করা হয়েছে ৪টি গ্যালারি। এগুলো হলো- কবিগুরু রবীন্দ্র গ্যালারি, নজরুল গ্যালারি, বেগম রোকেয়া গ্যালারি, বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর গ্যালারি ও লালন শাহ গ্যালারি। এখানে রয়েছে শিশু-কিশোর ও তরুণদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার জন্য আলোকচিত্র। ১৯টি আলোকচিত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে ফিরে দেখা ১৯৭১ গ্যালারিটি। এখানে আছে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ৩ মার্চের অসহযোগ আন্দোলন, ২৫ মার্চের গণহত্যা, পাকিস্তানিদের হত্যা ও নির্যাতনের চিত্র, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা, ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ ও বিজয় উল্লাসসহ মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ছবি।

পাঠাগার সংলগ্ন দরিদ্র অসহায় ছিন্নমূল পিছিয়ে পড়া শিশুদের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে গত বছরের ১ জানুয়ারি সেখানে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রীয় কিশোর পাঠাগারে প্রতিদিন সকালে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চলে। ৩০ জন ছাত্র-ছাত্রী এবং একজন শিক্ষিকা আছেন। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কেন্দ্রীয় কিশোর পাঠাগারে সাধারণ পাঠকদের জন্য রয়েছে কম্পিউটার কর্নার। এ কর্নারে একজন পাঠক বিনামূল্যে  সর্বোচ্চ ২০ মিনিট কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারেন। শুধু কি তাই! এখানে আছে কৃষি কর্নারও। কেন্দ্রীয় কিশোর পাঠাগারে গত বছরের ১০ জুন স্থাপিত হয় কৃষি কর্নার। কৃষি কর্নারে আছে বাংলাদেশে উৎপাদিত কয়েক জাতের ধান বীজ। বিভিন্ন

 

জাতের দেশীয় ফল

ও ক্যাকটাসের গাছসহ কৃষিবিষয়ক বই এবং পত্রিকা। পাঠাগারে ছোট একটি র‌্যাকে শুরু হয়েছে মিনি সংগ্রহশালার কার্যক্রম। মুদ্রা, দেশ-বিদেশের ডাকটিকিট, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী জিনিসপত্র, কাসা-পিতল, ক্যামেরাসহ বেশকিছু পুরনো বিষয় স্থান পেয়েছে এ মিনি সংগ্রহশালায়।

কিশোর পাঠাগারের বিস্ততি আরও ছড়িয়ে দিতে নতুন উদ্যোগ ‘সেলুনভিত্তিক পাঠাগার।’

সর্বশেষ খবর