শনিবার, ২৫ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা
আমেরিকায় প্রথম বাংলাদেশি সিনেটর

জর্জিয়ায় সিনেটর বাংলাদেশি শেখ রহমান

জর্জিয়ায় সিনেটর বাংলাদেশি শেখ রহমান

ছবি : রাফিয়া আহমেদ

আমেরিকার মধ্যবর্তী নির্বাচনে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের ডিস্ট্রিক্ট-৫ থেকে ডেমোক্রেটিক দলের মনোনয়নে স্টেট সিনেটর নির্বাচিত হন বাংলাদেশি-আমেরিকান শেখ রহমান। সম্প্রতি বাংলাদেশে আসেন এ সিনেটর। আমেরিকার আইনসভার সদস্য হওয়া প্রথম এ বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলেছেন সাইফ ইমন

শৈশব এবং কৈশোর বাংলাদেশেই কাটিয়েছেন শেখ মুজাহেদুর রহমান। গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলায়। মুক্তিযোদ্ধা ও সরকারি কর্মকর্তা বাবার সন্তান শেখ মুজাহেদুর রহমান বাংলাদেশে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্নের পর পাড়ি জমান আমেরিকায়। তিনি বিশ্বাস করতেন পরিশ্রম ও অধ্যবসায় যখন এক বিন্দুতে মেলানো যায় তখন সাফল্য ধরা দেবেই। আমেরিকায় এসে ভর্তি হন সেন্ট্রাল পিডমন্ট কমিউনিটি কলেজে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অদম্য ইচ্ছা থেকেই বাবার কাছ থেকে কোনো খরচ নিতেন না তিনি। একের পর এক রেস্টুরেন্টে কাজ খুঁজতে খুঁজতে সঙ্গের অনেকেই যখন হাল ছেড়ে দিচ্ছিল তিনি তখন আরও নতুন উদ্যমে পথচলা শুরু করলেন। ৫০টিরও বেশি রেস্টুরেন্ট থেকে ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি নর্থ ক্যারোলাইনা রেস্টুরেন্টে ডিশওয়াশারের কাজ পেয়েছিলেন। চালিয়েছেন ট্যাক্সি ক্যাবও। জীবনযুদ্ধে হার না মানা এ অদম্য সৈনিকই এখন আমেরিকার জর্জিয়া স্টেটের সিনেটর বাংলাদেশি-আমেরিকান শেখ রহমান হিসেবে গোটা বিশ্বে পরিচিত। ডেমোক্রেটিক দলের মনোনয়নে স্টেট সিনেটর নির্বাচিত হন তিনি। আমেরিকার যে কোনো পর্যায়ের আইনসভার সদস্য হওয়া প্রথম বাংলাদেশি তিনিই। জর্জিয়া স্টেট সিনেটে বিজয়ী শেখ রহমানের এ সাফল্যকে মার্কিন রাজনীতির জন্যই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকরা। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসনবিরোধী বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে শেখ রহমানের জয় একটি বড় জবাব। এ প্রসঙ্গে শেখ রহমান বলেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প ইজ অ্যাকচুয়েলি হি ইজ ফ্রম হিমসেল্ফ। আমেরিকার লোকজন সবাই তার পক্ষে নয়, একটা অংশ শুধু। সত্যিকথা বলতে গেলে কিছু সংখ্যক লোক আছে যারা ভয়ে আছে। কিন্তু ইউনাইটেড স্টেটস অলরেডি চেইঞ্জড। আমি ১৯৮১ সালে যখন সেখানে গিয়েছিলাম এখন আর সেই ইউনাইটেড স্টেটস নেই। প্রতি মুহূর্তে এটি চেইঞ্জ হচ্ছে। কিছু লোক আছে যারা রিয়েলি অরিড। এটার সুযোগ নিয়েই সে নমিনেশন পেয়েছিল এবং ইলেকটেড হয়েছে।’

নির্বাচনী প্রচারণার সময় শেখ রহমান অভিবাসন নীতির পক্ষেই কথা বলেছিলেন। নিজের অভিবাসী পরিচয়টি ভুলে যাননি তিনি। নির্ভয়ে ও সোচ্চারে নিজের অভিবাসী পরিচয়টি সবার সামনে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘আলটিমেটলি সবাই কিন্তু ইমিগ্রেন্ট। আমি হয়তো ৪০ বছর আগে গেছি। অন্য বংশধররা হয়তো ৫০ বছর বা ১০০/২০০ বছর আগে গেছে। সবাই পৃথিবীর কোনো না কোনো প্রান্ত থেকেই এসেছে। আমার মনে হয় এ বিষয়টা আমার কাজে এসেছে। আমি জর্জিয়ার প্রথম অভিবাসী সিনেটর হতে চেয়েছিলাম এবং হয়েছি। আমি বলেছিলাম যে, আমি রিপ্রেজেন্ট করতে চাই অভিবাসীদের পক্ষে। সাইড লাইনে না থেকে আমাদের ফ্রন্ট লাইনে আসতে হবে। আমাদের সামনে আসতে হবে। আমাদের লিড করতে হবে। আমাদের জায়গা চাই এবং এটাই আমাদের মেইন ইস্যু।’

তিনি যখন আমেরিকায় যান তখন বাংলাদেশি ইয়ং জেনারেশন সবেমাত্র যাওয়া শুরু করেছে আমেরিকায়। এর আগে বেশ কিছু বাংলাদেশি উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন। ১৯৯৫ সালে শেখ রহমান আমেরিকার নাগরিকত্ব পান। জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইকোনমিকস অ্যান্ড গ্লোবাল স্টাডিজে পড়াশোনার সময়ে তিনি স্টুডেন্ট সিনেটর নির্বাচিত হয়েছিলেন। একই সময়ে গ্লোবাল স্টাডিজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। শেখ রহমান বলেন, ‘আমি ৫০টিরও বেশি হোটেলে জবের জন্য চেষ্টা করেছিলাম। অবশেষে একটা জব পেয়েছিলাম। ঘণ্টায় আয় হতো ৩ ডলার ৩৫ সেন্ট করে। আমার রাজনৈতিক জীবন এর এক বছর পর থেকেই শুরু হয়। তখন এক মেয়র গভর্নর ইলেকশনের জন্য রান করছিলেন। আমি তখন তার পক্ষে কাজ শুরু করেছিলাম। ভোটারদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে আমি প্রার্থীদের ইনফরমেশন দিতাম। এভাবেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। আমি প্রায় ২০ বছর কাউন্টিতে বিভিন্ন ইলেকশনে হেল্প করেছি। কিন্তু গত ১০-১২ বছর ধরে আমি একটিভলি ইনভল্বড।’ নাগরিকত্ব পাওয়া প্রসঙ্গে শেখ রহমান স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘আমি একটু ফিরে যেতে চাই। অর্থনৈতিক কারণে আমার পড়ালেখা ছেড়ে দিতে হয়। তারপর আমাকে চাকরি করতে হয়। আমি ম্যানেজমেন্টে হাই লেভেল পর্যন্ত উঠেছিলাম। আমার একটা বিশেষ ইচ্ছা ছিল যে, আমাকে আবার ইউনিভার্সিটিতে ফিরে যেতে হবে এবং ভালো একটা ইউনিভার্সিটি থেকে সার্টিফিকেট নেব। এটাই ছিল আমার লক্ষ্য। যখন আমি বিভিন্ন করপোরেশনে চাকরি করেছি তখন অনেক ডিসক্রিমিনেশন দেখেছি। প্রমোশন পাইনি। আমি পেপসিতো পিজা হাটের মতো একটা বড় অর্গানাইজেশনে কাজ করেছি। আমি সেখানে ট্রেইনার ম্যানেজার ছিলাম। আমি ট্রেইন করতাম মানুষকে। অনেকেই ছিল যারা আমার কাছ থেকে ট্রেনিং নিয়ে হাই লেভেল এক্সিকিউটিভ হয়ে গেছে কিন্তু আমি রয়ে গেছি আগের জায়গাতেই। আমাকে বলা হতো আমার ইংরেজি ভালো না। এরকম নানা রকম কথা। আমি কিন্তু নাগরিকত্ব পাওয়ার অনেক আগে থেকেই করপোরেটে মুভ করি। ১৯৮৫ সালেই আমি ম্যানেজমেন্ট লেভেলে চাকরি করেছি। ওই জায়গা থেকে আমার সিইও হয়ে যাওয়ার কথা। আমি যেভাবে কাজ করেছি। আমার শুধু ডিগ্রি না থাকার কারণে ওপরে উঠতে পারছিলাম না। আমি তখন চাকরি ছেড়ে দিয়ে ইউনিভার্সিটিতে গেলাম। ততদিনে আমি কিছু টাকা-পয়সাও জমিয়েছি। ইউনিভার্সিটি অব জর্জিয়া থেকে অনার্স করার আগে আমি একটা অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রিও নেই। আমি ভেবেছিলাম, যদি কোনো কারণে আমি পড়াশোনা শেষ করতে না পারি তাহলে অন্তত একটা ডিগ্রি থাক। এরপর আমি জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইকোনমিকস অ্যান্ড গ্লোবাল স্টাডিজে পড়াশোনা করি। সেখানে আমার মেইন অ্যাডভাইজার ছিলেন ড. হিলেন বার্গ। তিনি ছিলেন জিমি কার্টারের আন্ডারে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট। তিনি ছিলেন ভেরি ওয়েল নোন ডিপ্লোমেট। পলিটিক্স অব ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক্যাল রিলেশনের ওপর খুবই দক্ষ ছিলেন। তিনি আইএমএফের, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও বটে। আমি এমন একজন মানুষের আন্ডারে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমি ছিলাম তার একজন টপ স্টুডেন্ট। তখনই আমি দক্ষ হয়ে উঠেছিলাম আমেরিকান পলিটিক্স বিষয়ে। আমি ইউনিভার্সিটি ছাত্র সংঘের সিনেটরও ছিলাম। ওখানে আমাদের ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশন ছিল। আমি যার বোর্ড অব ডিরেক্টরও ছিলাম। ১৯৮৩ সালে আমি নমিনেশন পেয়েছিলাম ৬০০ কলেজের মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অব দ্য কান্ট্রি নির্বাচনের জন্য। আমি অবশ্য ইলেকশনে তখন জয় লাভ করিনি। কিন্তু আমি সে সময় বিভিন্ন অর্গানাইজেশনে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছি।’ মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলা- এ বোধ বাংলাদেশে থাকাবস্থাতেই তৈরি হয়েছিল শেখ রহমানের। তিনি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছেন। মওলানা ভাষানীর ভাষণও শুনেছিলেন অনেকবার। তিনি কৈশোরেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন। যা পরবর্তী জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। সেই থেকেই মানুষের অধিকার আদায়ে এগিয়ে আসার একটা প্রত্যয় তৈরি হয়েছিল শেখ রহমানের ভিতরে। ব্যক্তি জীবনে এক ছেলে এবং এক মেয়ের বাবা তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি এখন থেকেই আমার ছেলেকে তৈরি করতে শুরু করেছি। যেন সে ভবিষ্যতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পারে। সেভাবেই আমি আমার ছেলেকে বড় করছি।’ দেশের বাইরে বাংলাদেশিদের এমন নানা সাফল্য গোটা বিশ্বের সব বাংলাদেশিকেই গর্বিত করে। জর্জিয়ার সিনেটর শেখ রহমানের ছেলে যদি একদিন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পারে তাও হবে বাংলাদেশিদের জন্য অনেক বড় গর্বের।

সর্বশেষ খবর