নারী ক্রিকেট দুনিয়ায় বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করে রীতিমতো হইচই ফেলে দেন দরিদ্র পরিবারের সন্তান মারুফা আক্তার। নীলফামারী সদর উপজেলার সংগলশী ইউনিয়নের ঢেলাপীর এলাকায় তার বাড়ি। বাবা আইমুল্লাহ হক বর্গাচাষি আর মা মর্জিনা বেগম গৃহিণী। মা-বাবা, চার ভাই-বোনসহ ছয়জনের পরিবার তার। তাঁর পিঠাপিঠি বড় বোন মাহফুজা আক্তারের বিয়ে হয়েছে। কেবল ভিটেমাটি ছাড়া আর কোনো জায়গাজমি নেই মারুফাদের। ঘরের যে ভিটে সেটিও দিয়েছেন মারুফার নানা।
ছোটবেলা থেকেই মারুফা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতেন। তাই ছোট বোনের আবদার সাধ্যমতো পূরণ করতে বড় ভাই আল আমিন প্রাইভেট পড়ানোর উপার্জিত আয়ে বোনের জন্য ব্যাট, বল ও খেলার বিভিন্ন সরঞ্জাম কিনে নিয়ে আসতেন। বড় ভাইয়ের আন্তরিকতা দেখে আরও বেশি অনুপ্রাণিত হতেন মারুফা। স্বপ্নকে করেছেন আরও প্রসারিত। পঞ্চম শ্রেণি পাস করেই মারুফা ভাইয়ের কাছে বায়না ধরেন সৈয়দপুর শহরে গিয়ে কোচ ইমরানের কাছে ক্রিকেট অনুশীলনের। এতে মা-বাবার চরম আপত্তি থাকলেও তা উপেক্ষা করে রেলওয়ে মাঠে অনুশীলন শুরু করেন মারুফা। এরই মধ্যে ২০১৮ সালে প্রতিভা অন্বেষণ ক্যাম্পের মধ্য দিয়ে বিকেএসপির নজরে আসেন। তারপর ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিক নৈপুণ্য দেখিয়ে ১৮ বছর বয়সেই ডাক পান জাতীয় দলে। ছোটবেলায় ভাইদের সঙ্গে ক্রিকেট খেললে মা-বাবা বকাঝকা করতেন। স্কুলে যাওয়ার আগে খুব সকালে বাবার সঙ্গে ক্ষেতে গিয়ে বাবাকেও সাহায্য করতেন। স্কুল থেকে ফিরে খাওয়া শেষ করেই ব্যাট-বল হাতে ভাই ও পাড়ার ছেলেদের নিয়ে কখনো উঠানে আবার কখনো রেললাইনের পাশে ক্রিকেট খেলতেন। মারুফার বাবা আইমুল্লাহ হক বলেন, ‘আমার সেই ছোট্ট মেয়েটি আজ দেশের হয়ে সুনাম কুড়াচ্ছে, এর চেয়ে গর্বের আর কী হতে পারে। আমার চার সন্তানের মধ্যে সবার ছোট মারুফা। বড় সন্তানের নামে কেউ আমাকে এখন ডাকে না। সবাই মারুফার বাবা হিসেবে আমাকে সম্বোধন করেন। এতে আনন্দে বুক ভরে যায়। মারুফার এতদূর পথ পাড়ি দেওয়া সহজ ছিল না। অন্যের জমি বর্গাচাষ ও দিনমজুরি করে কোনো রকমে সংসার চালাই। বলা যায়, ১৮ বছর বয়সী মারুফার হাত ধরেই এসেছে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচে ঐতিহাসিক জয়! সেই ম্যাচে তাঁর ২৯ রানে ৪ উইকেটের সৌজন্যে ভারতকে প্রথমবারের মতো ওয়ানডেতে হারায় বাংলাদেশ। মসৃণ রানআপ, দুর্দান্ত ইনসুইং এবং উইকেট থেকে মুভমেন্ট আদায় করে নেওয়ার অনন্য দক্ষতা মারুফাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তুলেছে। মারুফার ক্রিকেটার হয়ে ওঠার গল্পটা এখন বিশ্বের যে কোনো দেশের নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার। ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করতেন মারুফা। পড়াশোনার পাশাপাশি ফসলের মাঠে পড়ে থাকা মারুফা নিজের ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নটাও বাঁচিয়ে রেখেছেন। করেছেন পরিশ্রম। তারপর অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ভালো করে জাতীয় দলে জায়গা করে নেন। চেহারায় কৈশোরের ছাপ! এ বয়সেই নারী ক্রিকেট দুনিয়ায় ঝড় তুলেছেন মারুফা। তাঁর বোলিং অ্যাকশন আর ঝোড়ো গতি ব্যাটারদের কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। প্রথমবারের মতো ওয়ানডেতে ভারতবধের যেই ইতিহাস রচিত হয়েছে, তাঁর পাতা সুসজ্জিত করেছেন তিনি ৭ ওভারে ২৯ রানে ৪ উইকেট নিয়ে। তাঁর ক্যারিশম্যাটিক বোলিংয়ে মুগ্ধ বিশ্ব। আত্মবিশ্বাসী ও পরিশ্রমী মারুফা বলেন, ‘আমার স্বপ্ন এখন জাতীয় দলের বোলিংয়ে নেতৃত্ব দেওয়া। এই স্বপ্নটা আজকের নয়; সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি। বাংলাদেশকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই।’ এদিকে, শুক্রবার প্রকাশিত এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৪.০৬ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে পেসার মারুফা আক্তার। নিজের ফলাফলে দারুণ উল্লসিত মারুফা বলেন, ‘অনুশীলনের কারণে পড়াশোনা সেভাবে করতে পারিনি। ভেবেছি পরীক্ষার ফল ভালো হবে না। কিন্তু ফলাফল শুনে খুব খুশি হয়েছি। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।’ মারুফার বাবা মো. আইমুল্লাহ বলেন, ‘খেলাধুলার পাশাপাশি মেয়ে যে ফলাফল করেছে, তাতে আমি খুশি।’