মঙ্গলবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বাংলাদেশের অর্থনীতির বিস্ময়কর উন্নয়ন

সাজ্জাদুল হাসান

বাংলাদেশের অর্থনীতির বিস্ময়কর উন্নয়ন

শেখ হাসিনা মানেই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে এগিয়ে যাওয়া উজ্জ্বল এক বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক মুক্তিতে, মানবিক ও আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে তিনি অবিচল দৃঢ় এবং লড়াকু। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত বাঙালিকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ উপহার দিয়ে গেছেন। পাক হানাদার বাহিনী নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সমগ্র দেশকে একটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে রেখে যায়। দেশ পুনর্গঠনের জন্য যখন নিরলসভাবে বঙ্গবন্ধু কাজ করে যাচ্ছিলেন তখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল শূন্যের কোঠায়, বৈদেশিক সাহায্য আসাও শুরু হয়নি; এমনি একটি পরিস্থিতিতে দেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা আর শিক্ষার ব্যবস্থা করা ছিল এক দুরূহ কাজ। বিশ্বের অনেক অর্থনীতিবিদের ধারণা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করলেও দেশটি কখনই অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তবে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় বিশ্বাস এ দেশের কর্মজীবী মানুষের হাতগুলো কাজে লাগিয়ে তিনি এ দেশকে ‘সোনার বাংলায়’ পরিণত করতে পারবেন। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী কুচক্রী মহল ১৯৭৫ সালে তাঁকে হত্যা করে এ অগ্রযাত্রা সমূলে উৎপাটনের অপচেষ্টা চালায় এবং দেশের উন্নয়নের গতি থামিয়ে দেয়।

ইতিহাসের রক্তবীজে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে পা রেখেই ১৯৮১ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। তবে তাঁর এ আগমন কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। পথে পথে ছড়ানো ছিল সংকট ও মৃত্যুঝুঁকি। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দীর্ঘ লড়াই ও সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক বিজয়ের ফলে জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবরূপ দানের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি আবারও ষড়যন্ত্রের শিকার হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে গণতন্ত্রকে মুখ থুবড়ে ফেলে দেওয়া হয় আর ব্যাহত হয় অর্থনৈতিক অগ্রগতি। দীর্ঘ সংগ্রাম আর রাজনৈতিক অপশক্তিকে মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধুকন্যা ২০০৯ সালে আবার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় এসে দূরদর্শী পরিকল্পনা গ্রহণ করে জনগণের জীবন ও জীবিকার উন্নয়ন সাধনে লিপ্ত হন এবং এ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ১২ বছর ধরে দুর্বার গতিতে চলমান।

পিতার উত্তরসূরি হয়ে দেশ ও জনগণের শান্তি ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তাঁর এ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ও কর্মময় জীবন স্বল্পপরিসরে কোনোভাবেই তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবু অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে আজকে বাংলাদেশের যে অবস্থান তার কিছুটা সংক্ষেপে আলোকপাতের চেষ্টা করব।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতি আজ বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিগত এক দশকে শতকরা ৬ ভাগের অধিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, মুদ্রা ও অর্থবাজারের ধস, অভ্যন্তরীণ অপশক্তির চক্রান্ত, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর বিশাল জনগোষ্ঠী থাকা সত্ত্বেও ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি আর অব্যাহত সামাজিক উন্নয়ন সত্যিই বিস্ময়কর ঘটনা। অনেক অর্থনীতিবিদ একে ‘উন্নয়নের গোলকধাঁধা’ (Development Puzzle) হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন। বিশ্বব্যাংকের মানদন্ডে বাংলাদেশ ২০১৫ সালে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। অন্যদিকে জাতিসংঘের সূচক অনুযায়ী ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটবে। তবে বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯-এর নেতিবাচক প্রভাব না পড়লে ২০২৪ সালেই এ উত্তরণ ঘটত। কভিড-১৯-এর কারণে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কিছুটা মন্থর হলেও বাংলাদেশ এখনো চারটি দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশের মধ্যে রয়েছে। অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে কভিড-১৯ মোকাবিলা করে দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে, যা অনেক উন্নত দেশের পক্ষে এখনো সম্ভব হয়নি। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ফোর্বস ম্যাগাজিনে লিডারশিপ স্ট্র্যাটেজি শিরোনামে এবং ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে করোনা মোকাবিলায় সঠিক ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। তা ছাড়া এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. টেড্রোস আধানম গেব্রিয়েসুস কভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গৃহীত কার্যক্রমের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

বাংলাদেশে সামষ্টিক অর্থনীতির গতিধারা

বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী জিডিপির (GDP) বিচারে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের ৪১তম অর্থনীতি। তাদের তথ্যমতে ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৯৮৯ মার্কিন ডলার। একই সময়ে ভারতের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৯০১ মার্কিন ডলার আর পাকিস্তানের ১ হাজার ১৯৪ মার্কিন ডলার। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। আইএমএফের প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০২০ সালে বাংলাদেশের মোট জিডিপির পরিমাণ ছিল ৩৫২.৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ২০০৯ সালে ছিল মাত্র ১০২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ছাড়া আইএমএফের প্রাক্কলনমতে ২০২৬ সালে বাংলাদেশের জিডিপি হবে ৫৬১.১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশকে আরও শক্তিশালী অর্থনীতিতে পরিণত করবে।

কেবল জিডিপি প্রবৃদ্ধিই নয়, অন্যান্য অর্থনৈতিক সূচকেও বাংলাদেশ আজ ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিশ্বের বহু উন্নত দেশ সংকোচনমূলক অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করলেও বাংলাদেশ সম্প্রসারণমূলক নীতি গ্রহণ করে বিদ্যমান অর্থবছর পর্যন্ত ২৮টি ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ১ লাখ ২৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়, যা মোট জাতীয় আয়ের ৪.২%। সেই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে টিকা কেনা, স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন আর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে বিনামূল্যে টিকা পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। একই সঙ্গে খাদ্য উৎপাদন এবং পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাও সচল রাখার জন্য নেওয়া হয়েছে নানামুখী উদ্যোগ। ফলে বিশ্বের বহু দেশে নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলেও ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৫.৭১% প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। এ ছাড়া, মুদ্রাস্ফীতিও সহনশীল পর্যায়ে রয়েছে (মাত্র ৫.৬%)। ফলে অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।

বৈদেশিক খাত বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা

বিগত ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৫.৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; যা মাত্র নয় বছরে ১৬০% বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪০.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়। বিগত ২০১৯-২০ অর্থবছরে কভিড-১৯ এর কারণে রপ্তানি পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ১৬.৯৩% হ্রাস পেয়ে ৩৩.৭৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এলেও ২০২০-২১ অর্থ বছরে রপ্তানি ১৩.৬৪% বৃদ্ধি পেয়ে ৩৫.১৮ বিলিয়নে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। চা, পাট, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য ও কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, শিপ বিল্ডিং, ওষুধ, আইসিটি, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রনিকস, প্লাস্টিকসহ প্রায় ৭০৫টি পণ্য আজ রপ্তানি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

অন্যদিকে, প্রবাসী আয় ৩৬.১% বৃদ্ধি পেয়ে ২০২০-২১ অর্থ বছরে ২৪.৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। এর ফলে, বাণিজ্য ঘাটতি পূর্ববর্তী বছরের ৪.৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়ে ৩.৮১ বিলিয়নে নেমে এসেছে। বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে যা অর্থনীতিকে একটা শক্ত ভিত্তিতে দাঁড় করাতে সহায়ক হবে।

কেবলমাত্র আমদানি-রপ্তানি নয়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ অনেক বিচক্ষণ নীতি অবলম্বন করেছে। ফলে মুদ্রা বিনিময় হারে ব্যাপক কোনো হ্রাস-বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়নি। বিগত ২০২০-২১ অর্থবছরে টাকার তুলনায় ডলারের বিনিময় হার ০.০৫% অবমূল্যায়ন করা হয় যা রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে।

বিগত ২০১৮ সালে বৈদেশিক বিনিয়োগ পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় প্রায় ৭১% বৃদ্ধি পেয়ে ৩.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে (আংকটাড রিপোর্ট, ২০২১)। তবে কভিড-১৯ এর কারণে বৈদেশিক বিনিয়োগের গতি কিছুটা হ্রাস পেলেও বর্তমানে ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল, ২১টি হাইটেক পার্ক স্থাপনের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে, যা দেশীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগকে ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করছে। এ ছাড়া, Ease of Doing Business-এ বাংলাদেশের র‌্যাঙ্কিং ২০১৮ সালের ১৭৬তম অবস্থান থেকে ২০২০ সালে ১৬৮তম অবস্থানে উন্নীত হয়েছে এবং ২০২১ সালে এ অবস্থান শততম এর কাছাকাছি আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

অবকাঠামো উন্নয়ন

বিগত এক দশকে দেশের অবকাঠামোগত ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। দেশে শিল্প, কৃষি ও জনগণের জীবন মান উন্নয়নে বিদ্যুতের অপরিসীম গুরুত্ব বিবেচনা করে বিদ্যুৎ খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করে। ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২০০৯-১০ সালের ৫,২৭১ মেগাওয়াট থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে প্রায় ২৫,০০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। দেশের শতভাগ জনগণ আজ বিদ্যুৎ নেটওয়ার্কের আওতায় রয়েছে, যা বিগত দশকের শুরুতেও ছিল একটি অলীক ধারণা। একই সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ এবং অন্যান্য মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে যা দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে পৌঁছে দিতে সহায়ক হচ্ছে। দেশে বর্তমানে ২২৪১৮.৯৫ কিলোমিটার সড়ক পথ এবং ৩ হাজার ১৮ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি করে নৌপথে চলাচল ও মালামাল পরিবহনের জন্য নেওয়া হচ্ছে সমন্বিত উদ্যোগ। চট্টগ্রাম ও মংলা পোর্ট আধুনিকায়নের কাজও চলমান রয়েছে। পায়রা পোর্ট ও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ শেষ হওয়া আজ সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

সামাজিক অগ্রগতি

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আর উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা, চিকিৎসা, আবাসন ব্যবস্থা, কর্মসংস্থান সুযোগ সৃষ্টি, দক্ষতা উন্নয়ন আর সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সম্প্রসারণের মাধ্যমে দারিদ্র্যের হার ২০০৫ সালের ৪০% থেকে হ্রাস পেয়ে ২০.৫% নেমে এসেছে। শিশু মৃত্যুর হার ১৯৯০ সালের প্রতি হাজারে ১৪৬ থেকে মাত্র ৩৬-তে নামিয়ে আনা, প্রাথমিক শিক্ষায় শতভাগ ভর্তি, শিক্ষার হার ৭৫% উন্নীত হওয়াসহ সামাজিক অগ্রগতির জন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘের সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য পুরস্কৃত হয়েছে। প্রায় ১৭.৩৩ কোটি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর নিকট সামাজিক ও অর্থনৈতিক সেবাও দ্রুত পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। এ ছাড়া, বর্তমান সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনও বাংলাদেশের জন্য এখন আর কোনো অলীক স্বপ্ন নয়।

বিশ্ব ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাসে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে।

জাতিসংঘের হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট, ২০২০-এ উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৯০ থেকে ২০১৯ সময়ে Human Development Index (HDI)-এ বাংলাদেশের স্কোর ০.৩৯৪ থেকে ০.৬৩২-তে উন্নীত হয়েছে অর্থাৎ ৬০.৪% অগ্রগতি হয়েছে, যা দেশটিকে মধ্যম স্তরের উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছে দিয়েছে।

বাংলাদেশের উন্নয়ন রহস্য

ব্যাপক জনসংখ্যা, জমির স্বল্পতা, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশ সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে ক্রমাগত অগ্রগতি সাধন করে চলেছে, যা বিগত এক দশকে বিশেষভাবে বেগবান হয়েছে। এর কারণ বিশ্লেষণে দেখা যায়, সামাজিক উন্নয়নকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, শিক্ষা বৃত্তি, সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের প্রসার, কমিউনিটি ক্লিনিক, আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আবাসন নিশ্চিতকরণ সমাজ বিবর্তন আর সামাজিক বৈষম্য রোধে বৈপ্লবিক ভূমিকা রেখেছে।

জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার ধারাবাহিকভাবে বাজার ব্যবস্থার সম্প্রসারণের নীতি অনুসরণ করেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রতি গুরুত্বারোপ করলেও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে কৃষিকে প্রাধান্য দেওয়া, শিল্পায়নের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করা, রপ্তানি সহায়ক বাণিজ্যনীতি প্রবর্তন ও সহায়তা প্রদান করে দেশের অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার করা হয়েছে। তবে, বঙ্গবন্ধুর নীতির ন্যায় সরকার একদিকে যেমন সমগ্র অর্থনীতিকে বাজার ব্যবস্থার ওপর সম্পূর্ণ ছেড়ে দেয়নি, অনুরূপভাবে বাজার ব্যবস্থার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণও আরোপ করা হয়নি। ভারসাম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। একই সঙ্গে, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ক্ষেত্রে বিদ্যমান সুবিধাসমূহ সর্বাত্মক কাজে লাগানোর জন্য নেওয়া হয়েছে সামগ্রিক উদ্যোগ। সেই সঙ্গে রাজস্ব ও মুদ্রা নীতিতে ছিল প্রয়োজনীয় তদারকি যা বেসরকারি খাতে উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করায় ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

পিতার প্রতি অঙ্গীকার এবং দেশপ্রেম থেকে জননেত্রী শেখ হাসিনা রাজনীতিতে এসেছেন। তাঁর এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী শিক্ষা, জনগণের প্রতি গভীর ভালোবাসা, দূরদর্শী রাজনৈতিক অঙ্গীকার, মুক্তিযুদ্ধের অদম্য প্রেরণা। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কর্মের প্রয়াস নিঃসন্দেহে জাতি হিসেবে আমাদের মাথা উঁচু করে দেয়। তিনি যা বিশ্বাস করেন তাই বলেন, যে উন্নয়নের কথা বলেন তা করে দেখান। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তিনি এ জন্য বারবার প্রশংসিত হয়েছেন এবং পুরস্কৃত হয়েছেন। তার স্বীকৃতিস্বরূপ অতি সম্প্রতি  জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সল্যুশনস নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন) মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে “এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কারে” ভূষিত করেছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতায় দেশ আজ ক্রমান্বয়ে উন্নত থেকে উন্নততর দিকে প্রবাহমান।  তাই আমরা দৃঢ়ভাবে আশাবাদী ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ করার জন্য তিনি যে পথ নকশা প্রণয়ন করেছেন তাঁর এ উদ্যোগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে যার যার অবস্থান থেকে দেশ গড়ার কাজে সর্বস্তরের মানুষ সম্পৃক্ত হলে তা বাস্তবায়ন সম্ভব।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে ৭৫তম জন্মদিনে অশেষ শ্রদ্ধা ও আন্তরিক শুভেচ্ছা।  মহান আল্লাহর কাছে আপনার দীর্ঘায়ু ও সুস্থতা কামনা করি।

লেখক : সাবেক সিনিয়র সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

সর্বশেষ খবর