শিরোনাম
শনিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধু হত্যা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও সংবিধান লঙ্ঘন প্রসঙ্গ

শ ম রেজাউল করিম

বঙ্গবন্ধু হত্যা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও সংবিধান লঙ্ঘন প্রসঙ্গ

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। আত্মস্বীকৃত খুনিরা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করেন যে, ‘ক্ষমতা থেকে বঙ্গবন্ধুকে সরানোই ছিল তাদের লক্ষ্য। কিন্তু তিনি এমন যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন যে, জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে পরিবেশ পাল্টে দিতে সক্ষম ছিলেন, সে কারণে তাঁকে হত্যা করা ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না।’ তাদের এ বক্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। কারণ, ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতাচ্যুত করার সঙ্গে তাঁর শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পরিবারের নারী সদস্য ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনকে কেন হত্যা করা হয়েছিল? কেন ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল? বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাষ্ট্রপতি, তাঁকে হত্যার পরে নিয়ম অনুসারে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন। তিনি না থাকলে জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল মালেক উকিল দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন। কিন্তু কোন যুক্তিতে বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হলেন? কেনইবা বঙ্গবন্ধু হত্যার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তান সরকার খুনি মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দিল। বঙ্গবন্ধুর জানাজা ও লাশ দাফনের সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল? বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী আরও কয়েকটি দেশ বাংলাদেশকে কেন স্বীকৃতি দেয়? তাহলে কি তারা অপেক্ষা করছিল যে, বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকাবস্থায় এ দেশকে তারা স্বীকৃতি দেবে না? পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটির আহ্বায়ক চরম স্বাধীনতাবিরোধী গোলাম আযমকে কেন পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসার সুযোগ করে দেওয়া হয়? স্বাধীনতাবিরোধী রাজনীতিক শাহ আজিজ, মশিউর রহমান যাদু মিয়া, খান এ সবুর, মাওলানা আবদুল মান্নান, আবদুল আলিমসহ অনেকেই পুনর্বাসিত হয় রাজনীতিতে এবং সরকারে, কী কারণে? মুক্তিযুদ্ধের প্রাণসঞ্চারী জয় বাংলা স্লোগানের পরিবর্তে পাকিস্তান স্টাইলে ‘জিন্দাবাদ’ আমদানি করা হলো? কার্যত বাংলাদেশ পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সম্পূর্ণরূপে ভূলুণ্ঠিত করা হয়। তাহলে কি এটা স্পষ্ট নয় যে, ১৯৭১ সালের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই স্বাধীনতাবিরোধী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র পরস্পর যোগসাজশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল। ঘটনার পরম্পরা বিশ্লেষণ করলে সমীকরণে তা-ই প্রতিভাত হয়।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্ম টুঙ্গিপাড়ায়। শৈশব থেকেই ন্যায়ের পক্ষে দ্রোহের লক্ষণ দেখা যায় তাঁর মধ্যে। ১৯৩৮ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক স্কুল পরিদর্শনে এলে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়। ১৯৩৯ সালে অতি অল্প বয়সে স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা করার দুঃসাহস দেখালে প্রথম গ্রেফতার হন। ১৯৪৬ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সহকারী নিযুক্ত হন। ১৯৪৭ সালে বিএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায়সঙ্গত দাবি সমর্থন করলে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাবের প্রতিবাদ জানান এবং ১১ মার্চ বাংলা ভাষার দাবিতে ধর্মঘট করলে গ্রেফতার হন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন কারাগারে থাকাবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। কারাগারে থাকাবস্থায় ১৯৫২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কারাগারে অনশন শুরু করেন। ১৯৫৩ সালের ১৬ নভেম্বর প্রাদেশিক আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ওই বছর ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। ১৯৫৪ সালের ১৪ মে সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ১৯৫৫ সালের ৫ জুন পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ১৭ জুন পল্টন জনসভায় তিনিই সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি করেন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর ইস্কান্দার মির্জা সামরিক শাসন জারি করেন এবং ১২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আওয়ামী লীগকে পুনর্জীবিত করা হয় এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী কমিটি গঠন করেন।

১৯৬৬ সালে তিন মাসে আটবার গ্রেফতার হন। ১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি দায়ের করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। আদালতের মাধ্যমে সাজানো রায় নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিঃশেষ করাই ছিল লক্ষ্য। ২৮ জানুয়ারি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে আদালতে লিখিত বিবৃতি দেন। তাঁর মুক্তির দাবিতে ছাত্রসমাজের ১১ দফা কার্যত আন্দোলনের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়। ১৯৬৯ সালের ৩০ জানুয়ারি প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবর বেতার ও টেলিভিশনে নির্বাচনে ভাষণ দিয়ে গোটা জাতির সামনে মুক্তির ম্যান্ডেট উপস্থাপন করে বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ নামের পোস্টার প্রকাশ করেন, যা বাঙালি জাতিকে জাগ্রত করে তোলে। ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ১৬৭ আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং প্রাদেশিক পরিষদে ২৯৮টি আসন লাভ করে ১৭ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যরা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...’ গান গেয়ে ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের শপথ নেন এবং জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে মুক্তির সংকল্প ব্যক্ত করেন। ১৯৭১ সালের ১০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিন দফা বৈঠক করে বঙ্গবন্ধুকে ‘পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী’ সম্বোধন করেন। ২৭ জানুয়ারি জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে অযৌক্তিক দাবি উত্থাপন করায় ওই বৈঠক ব্যর্থ হয়। ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হয় ১৩ ফেব্রুয়ারির একটি সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে। হঠাৎ করে অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে পাকিস্তানি সরকার। ২ মার্চ ঢাকায় হরতাল পালিত হয়। সরকার কারফিউ জারি করে এবং গুলিতে তিনজন নিহত ও ৬০ জন আহত হন। অসীম দূরদর্শী শেখ মুজিব বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানিদের কুমতলব। তাই গোটা জাতিকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ইয়াহিয়া খান ১৬ মার্চ বিস্ফোরণমুখী বাংলাদেশে এসে বঙ্গবন্ধুকে বৈঠকে ডাকেন। কালো পতাকা নিয়ে বৈঠকে যান তিনি। ২৩ মার্চ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। সবই ছিল বঙ্গবন্ধুর সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত। ২৫ মার্চ বর্বরোচিত গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি জান্তা। ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানে, দেওয়া হয় মৃত্যুদন্ড। এদিকে ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদ গঠন এবং বঙ্গবন্ধুকে করা হয় রাষ্ট্রপতি। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। উল্লেখ্য, ১১ নভেম্বর ইয়াহিয়া ও ভুট্টো কারাগারে দেখা করতে এলে বঙ্গবন্ধু করমর্দনের হাত ফিরিয়ে দেন। ২ ডিসেম্বর কারাগারে ইয়াহিয়া সমঝোতার প্রস্তাব দিলে বঙ্গবন্ধু তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ৮ জানুয়ারি মুক্তি পেয়ে লন্ডন ও ভারত হয়ে ১০ জানুয়ারি স্বাধীন স্বদেশে ফিরে আসেন বিজয়ের মহানায়ক।। এভাবেই তিনি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ নেয় আমেরিকা, চীনসহ অন্য কয়েকটি দেশ। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও রাশিয়া আমাদের পাশে দাঁড়ায়। যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি যারা মেনে নিতে পারেনি, তারা দেশকে অস্থিতিশীল করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে এগোতে থাকে।

১৯৭২ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে কর্নেল ফারুক মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে অস্ত্র ক্রয়ের প্রস্তাব দেয়। ১৯৭৩ সালের ১১ জুলাই কর্নেল রশিদ মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে জানায়, ব্রিগেডিয়ার জিয়ার নেতৃত্বে একটি কমিটির পক্ষ থেকে তাকে অস্ত্র ক্রয়ের প্রস্তাব নিয়ে পাঠানো হয়েছে। ১২ জুলাই কর্নেল ফারুক একই রূপ প্রস্তাব নিয়ে যায়। ১৯৭৪ সালে ১৩ মে কর্নেল ফারুক গং মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে শেখ মুজিব সরকারকে উৎখাতে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সাহায্য চান। সেখানে উল্লেখ করে, উচ্চতম পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তাদের নির্দেশেই...। ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ আর্মড রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড সৈয়দ ফারুক রহমান জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করে বঙ্গবন্ধুর সরকার উচ্ছেদের অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিতে অনুরোধ করে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের এক সপ্তাহ আগে সিআইএর স্টেশন চিফ চ্যারির সঙ্গে জিয়াউর রহমানের বৈঠক হয় এক ব্যবসায়ীর বাসায়। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়। ৯ দিনের মধ্যেই জিয়াউর রহমান হয়ে যান সেনাপ্রধান। সেনা কর্মকর্তা হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি ও সংবিধানকে জীবনের বিনিময়ে হলেও রক্ষা করার, কিন্তু করলেন তার বিপরীতটা। ১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল তিনি আবু সাদাত মো. সায়েমকে পিস্তল টেকিয়ে পদত্যাগ করিয়ে নিজেই রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ দখল করেন। তিনি সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা হয়েও সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে নিজেকে রাষ্ট্রপতি দাবি করে ‘হ্যাঁ-না’ ভোটের প্রহসনের মাধ্যমে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার অপকৌশল নেন। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর গঠন করেন বিএনপি। ১৯৭৫-এর ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করা হলেও সংবিধানকে স্থগিত করা হয়নি। সেক্ষেত্রে সামরিক শাসন জারি, মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণ, জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখল কোনো কিছুরই আইনগত কোনো ভিত্তি ছিল না। এমনকি খন্দকার মোশতাক নিজেও সামরিক শাসন জারির ঘোষণা দেননি রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতা দখল করে। তাহলে কীভাবে এলো সামরিক শাসন, কে জারি করল?

বঙ্গবন্ধু হত্যাসহ ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল পর্যন্ত সংঘটিত সব অপকর্মকে বৈধতা দিতে ১৯৭৯ সালের পার্লামেন্টে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইনে রূপান্তরিত করতে এবং সংবিধানের অংশে পরিণত করতে বিল আনা হয়। আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল থেকে তীব্র প্রতিবাদ জানানো সত্ত্বেও পাস করা হয় ইতিহাসের জঘন্যতম ওই আইন। ৯ এপ্রিল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্বাক্ষর করেন ওই আইনে। রুদ্ধ হয়ে যায় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও অবৈধ ক্ষমতা দখলকে চ্যালেঞ্জ করার আইনি সুযোগ। ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু ভবনে ঢুকতে গেলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি জিয়াউর রহমানের জীবদ্দশায় কখনো তিনি ওই বাড়িতে যেতে পারেননি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের জন্য দোয়া করতে বাধ্য হয়েছেন। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন সরকার গঠন করে ১২ নভেম্বর ইনডেমনিটি আইন বাতিল করেন। তার বিরুদ্ধে কর্নেল ফারুক ও সুলতান শাহরিয়ার রশিদ হাই কোর্টে রিট দায়ের করে, যা ১৯৯৭ সালে ২৮ জানুয়ারি খারিজ হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করে, যা ১৯৯৮ সালের ১৯ এপ্রিল খারিজ হয়। শুরু হয় বিচার কার্যক্রম। বিচারাদালত ১৫ জন খুনিকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করে। হাই কোর্টে আপিল হলে বিচারপতি মো. রুহুল আমিন ও বিচারপতি খায়রুল হক দ্বিধাবিভক্ত রায় দেন। তৃতীয় বিচারক ফজলুল করিম ১২ জনের ফাঁসি বহাল রাখেন, যা আপিল বিভাগেও বহাল হয়। আসামিপক্ষ পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করলেও একই রায় বহাল থাকে। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমা শেষে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি পাঁচ খুনির মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়। উল্লেখ্য, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী বারবার বলা সত্ত্বেও বিএনপি সরকার আপিল বিভাগে একজন বিচারপতি নিয়োগ না দেওয়ায় ঝুলে থাকে আপিল। শেখ হাসিনা পুনরায় ক্ষমতায় এসে বিচার বিভাগের স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখায় আপিল নিষ্পত্তি হয়। জাতিকে অপেক্ষা করতে হয় জনকের হত্যার বিচারের জন্য ৩৫ বছর। পর্দার আড়ালে থেকে জিয়াউর রহমানই করেছেন সব ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা, প্রতিদানে খুনের পরে তিনিই হয়েছেন সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারি।

বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি কর্নেল ফারুক ও রশিদ লন্ডন টিভি, স্যাটারডে পোস্ট, লন্ডন সানডে টাইমসসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততার কথা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছেন। ফৌজদারি অপরাধ বিজ্ঞানের নীতিমালা অনুযায়ী, জিয়াউর রহমানকে কোনোভাবেই নির্দোষ ভাবার সুযোগ নেই; বরং খুনের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা প্রত্যক্ষ ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষাতে প্রমাণিত হয়। খুনিদের এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে তিনি এই জঘন্য হত্যাকান্ড সংঘটনে ‘কমান্ড’ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি ধ্বংস করা হয়েছিল। খুনিদের বিচার না করে দায়মুক্তি দিয়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতি সৃষ্টি করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে জাতির জনকের খুনিদের, জেল হত্যার খুনিদের, যুদ্ধাপরাধীদের, বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীসহ সব হত্যাকান্ডের বিচার করে প্রমাণ করেছেন, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। অপরাধীদের দাম্ভিকতা চূর্ণ করে দিয়ে আইনের শাসন ফিরিয়ে এনেছেন। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে লক্ষণীয়, জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাবস্থায়ই জিয়াউর রহমানের হত্যা মামলার অপমৃত্যু হলো। তাহলে প্রশ্ন জাগে, তিনি কি ক্ষমতার স্বার্থেই নিজ স্বামী হত্যাকারীদের সঙ্গে কৌশলগত আপস করে নিলেন? এভাবেই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি ধ্বংস হয়, ক্ষমতায় আসে অবৈধ ব্যক্তিরা এবং খুনিদের দেওয়া হয়েছিল প্রশ্রয়। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী ও সপ্তম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণকে অবৈধ, বেআইনি এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ বলে রায় দেয়। অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীদের কৃত সব কর্মকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। একইভাবে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতা দখলকে অবৈধ ঘোষণা করে। এভাবেই উত্তরণ হয় গণতন্ত্রের অভিযাত্রার। প্রতিষ্ঠিত হয় আইনের শাসন ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা, যার কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার। তিনিও অন্তত ১৯ বার জীবননাশের আক্রমণের মুখোমুখি হন। সর্বশেষ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন সরকার সরাসরি অংশ নেয় এই নারকীয় গ্রেনেড হামলায়। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের উৎসাহিত করা, পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া এবং খুন-পরবর্তী দায়মুক্তি দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। একই ধারাবাহিকতায় ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় বেগম খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, ডিজিএফআইর প্রধান, এনএসআইর প্রধান, পুলিশ প্রধানসহ সরকার ব্যবস্থাই জড়িত ছিল। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মতোই ২১ আগস্টের খুনিদের পরিত্রাণ দিতে জজমিয়া কাহিনির মতো নিকৃষ্ট আষাঢ়ে গল্প সৃষ্টি করেছিল খালেদা জিয়া সরকার।  এভাবেই বাংলাদেশে খুনের রাজনীতি ও সাংবিধানিক রাজনীতি ধ্বংসের ভয়াল খেলায় মেতে ওঠে স্বাধীনতাবিরোধী ও ক্ষমতালিপ্সু দেশি ও আন্তর্জাতিক মহল।

                লেখক : মন্ত্রী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।

 

সর্বশেষ খবর