এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের ফুটবল পারফরম্যান্স নিয়ে কথা উঠলে সবার আগে আসে মোতালেব হোসেনের নাম। যার নেতৃত্বে ১৯৮২ সালে এশিয়াডে প্রথম জয় পায় বাংলাদেশ। বাদল রায় ও আশিষ ভদ্রের গোলে দিলি্ল এশিয়াডে মালয়েশিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়েছিল লাল-সবুজরা। তখন ফুটবলে মালয়েশিয়ার ছিল দোর্দণ্ড প্রতাব। সে আসরে গ্রুপের প্রথম দুই ম্যাচে ভারতের বিরুদ্ধে ২-০ গোলে এবং চীনের বিরুদ্ধে ১-০ গোলে হেরে যায় বাংলাদেশ। তৃতীয় ম্যাচে অধিনায়ক মোতালেব হোসেনের কৌশলে প্রথম জয় পায় দেশ। এখন পর্যন্ত এশিয়াডে ফুটবল থেকে বাংলাদেশের বড় অর্জন এটি। অবশ্য বাংলাদেশ এশিয়াডে জিতেছেই আর একবার মাত্র, নেপালের বিরুদ্ধে ১৯৮৬ সালে সিউল এশিয়ান গেমসে। তবে মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচটি-ই এখনো এশিয়াডে ফুটবলের বড় বিজ্ঞাপন হয়ে আছে। সেই ম্যাচের স্মৃতি রোমন্থন করে গিয়ে মোতালেব বলেন, 'সে এক মধুর স্মৃতি। কখনো ভোলার নয়। দেশের হয়ে যে কোনো জয়ই অনেক মধুর। তবে ওই জয়টি অন্যরকম।'
'৮৬-এর পর গত ২৮ বছরে এশিয়াডে আর কোনো জয় পায়নি বাংলাদেশ। তবে এবার আশাবাদী মোতালেব। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'আফগানিস্তানকে হারাতে পারে বাংলাদেশ, যদি কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে। দেখেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আফগানরা তো ঠিক মতো প্রস্তুতি নিতে পারে না। এমন অবস্থায় বাংলাদেশ স্বাভাবিক খেলাটা যদি প্রদর্শন করতে পারে তবে হারবে না এটা বলতে পারি। ব্যতিক্রম কিছু ঘটলে সেটা অন্য কথা।' তবে বাংলাদেশের প্রস্তুতি নিয়ে সন্তুষ্ট নন মোতালেব, 'আমাদের ছেলেরা যে প্রস্তুতি নিয়েছে এটা খুবই পুওর। সাফল্যের জন্য দরকার ছিল দীর্ঘ প্রস্তুতির।'
১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৮৭, দীর্ঘ ২০ বছর জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন মোতালেব। ছিলেন দেশের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক। কিন্তু মোতালেব জানান, তিনি শুধু গোলরক্ষক নন, দলের প্রয়োজনে স্ট্রাইকার হিসেবেও খেলেছেন, '১৯৮৫ সালের কথা। তখন আমি আবাহনীর গোলরক্ষক। মালদ্বীপের একটি ক্লাবের বিরুদ্ধে খেলা। ওই ম্যাচে শেষের দিকে আমি গোলরক্ষকের জার্সি খুলে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলেছি। আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোলও আছে আমার। '৭০-এর দশকে আমি রহমতগঞ্জের হয়ে ফরোয়ার্ড হিসেবেই খেলেছি।'
মোতালেবের ফুটবল ক্যারিয়ারের মধুর স্মৃতিগুলো রয়েছে গোলরক্ষক হিসেবেই। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে জয় পেয়েছি তার জন্যই, সিঙ্গাপুরের বিরুদ্ধে দুর্দান্তভাবে পেনাল্টি আটকে দিয়েছিলেন মোতালেব। তিনি বলেন, 'আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা এটি। আমরা এক গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর ওরা পেনাল্টি পেয়েছিল। সেটি আমি আটকে দিয়েছি।' নিজের জীবনের সবচেয়ে বেদনাময় স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, '১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, মালয়েশিয়া বিকালে আমাদের খেলা ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে। সকালে নাস্তা করার সময় শুনলাম বঙ্গবন্ধু সপরিবারে খুন। বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। যে মানুষটি তার কিছুদিন আগেই আমার পিঠ চাপড়ে গালে হাত দিয়ে সবার সামনে বলেছিলেন, মোতালেব তুমি দেশের সেরা গোলরক্ষক। সেদিন আমি কী যে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম। আর এমন একজন মানুষের এমন মৃত্যুর খবরে আমি ভেঙে পড়েছিলাম। আমার জীবনের সবচেয়ে বেদনাময় স্মৃতি এটি।'
ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কাজী সালাউদ্দীনের স্বপ্ন, ২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপে খেলবে বাংলাদেশ! 'ভিশন-২০২২' সম্পর্কে মোতালেব বলেন, 'অবশ্যই একটা টার্গেট থাকতে হবে সামনে। তবে কাতার বিশ্বকাপে খেলতে হলে এখন থেকেই কাজ করতে হবে। ছোট্ট একটা গল্প বলি, ১৯৯৫ সালে আমি ব্রাজিলে কোচিংয়ের জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম। তখন চীন ২০০২ কোরিয়া-জাপান বিশ্বকাপকে সামনে রেখে ১০০ জন ১৪ বছর বয়সী তরুণ ফুটবলারকে ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠিয়েছিল। এই ছেলেগুলোই যাতে এশিয়ার বিশ্বকাপে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। ঠিকই ২০০২ বিশ্বকাপে চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নিয়েছিল চীন।' মোতালেব বলেন, 'আমাদের ফুটবলারদের দীর্ঘমেয়াদি কোচিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বিদেশি কোচদের জন্য যে টাকা ব্যয় করা হয়, ওই টাকা দিয়ে দেশীয় কোচ নেওয়ার পাশাপাশি ৬ মাস অন্তর অন্তর পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে প্রীতি ম্যাচ খেলার ব্যবস্থা করতে হবে। আর গ্রামেও ফুটবলের উন্মাদনাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে দেখা যাবে দ্রুত উন্নতি ঘটছে ফুটবলে।'