করপোরেট সংস্কৃতির বিষয়টি ভিন্নধর্মী। এ ক্ষেত্রে কার্যক্রম পরিচালনা বা উদ্যোগকে বাস্তবে রূপায়িত করার প্রক্রিয়ায় জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা অন্য রকম। দেশে বৃহৎ করপোরেট গ্রুপ বসুন্ধরা। গ্রুপের পরিচালিত প্রাইভেট ক্লাব হলো বসুন্ধরা কিংস।
‘গুড করপোরেট’ সিটিজেন হিসেবে বসুন্ধরা গ্রুপ তাদের ব্যাপক সামাজিক কর্মকাণ্ডের আওতায় দেশের ফুটবলে সরাসরি অবদান রাখার জন্য বসুন্ধরা কিংস পরিচালনা করছে। দেশের অন্যান্য ক্লাবের চিন্তা-ভাবনা ও কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে বসুন্ধরা কিংসের সঙ্গে অনেক ফারাক। পেশাদারি ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য ‘এস্টিমেট’ তৈরি করে সেটি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত করা। এ ক্ষেত্রে ‘এক্সিলেন্স’ এবং এক্সিলেন্স আর ‘বটম লাইন’ অর্থাৎ ফলাফল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এগিয়ে চলার পাশাপাশি এক্সিলেন্সে কোনো ছাড় নেই।
বসুন্ধরা গ্রুপ কর্তৃক পরিচালিত ক্লাব ঘরোয়া ফুটবলে প্রথম প্রিমিয়ার লীগে খেলতে নেমেছে ২০১৮-১৯ মৌসুমে। আর এসেই পেশাদার ফুটবল লীগে একনাগাড়ে পাঁচবার শিরোপা জয় করে দেশের ফুটবল ইতিহাসে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। গত ফুটবল মৌসুমে তিনটি ট্রফির মধ্যে জিতেছে চ্যালেঞ্জ এবং ফেডারেশন কাপ। লীগ শিরোপা তাদের হাতছাড়া হয়েছে। ফুটবলে সব সময় সবকিছু মনঃপূত হবে, তা কিন্তু নয়। ফুটবল কখনো ভালো দিকটা দেখায়, কখনো খারাপ। আর এই দুটি বিষয় খেলার অংশ। খেলোয়াড়দের ইনজুরি, সময়মতো ভালো খেলোয়াড় না পাওয়া, নতুন বিদেশি কোচের অধীনে খেলোয়াড়দের সম্ভাবনা এবং সামর্থ্যকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থতায় ষষ্ঠবারের মতো লীগ শিরোপার রেসে দলটি পিছিয়ে পড়ে।
স্বাভাবিকভাবে ক্লাব ম্যানেজমেন্টের খারাপ লেগেছে, সমর্থক ও ভক্তদের প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। সমর্থক ও গুণমুগ্ধরা তো ভেবেছে ক্লাব একনাগাড়ে ষষ্ঠবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়ে (প্রথম খেলতে নেমে) উপমহাদেশের ফুটবলে একটি নতুন অধ্যায়ের জন্ম দেবে। বিশ্বাস করি, এই অভিজ্ঞতা ক্লাব ম্যানেজমেন্ট শিক্ষণীয় হিসেবে নিয়েছে। ফুটবল দলগত খেলা। এখানে ব্যক্তিগতভাবে কোনো কিছু জেতার তো সুযোগ নেই। দীর্ঘ সময়ের লীগের জন্য প্রয়োজন দৃঢ় মানসিকতাসম্পন্ন উপযোগী ফিট খেলোয়াড়।
আসন্ন ফুটবল মৌসুমে বসুন্ধরা কিংসের লক্ষ্য খুব স্পষ্ট আর সেটি হলো প্রিমিয়ার লীগ শিরোপা পুনরুদ্ধার। পাশাপাশি অন্য সব টুর্নামেন্টে সমর্থকদের বিজয় উপহার। দেশে বিভিন্ন দলের হয়ে খেলেছেন, খেলেছেন বসুন্ধরা কিংসে—এ ধরনের পরীক্ষিত শক্ত মানসিকতাসম্পন্ন খেলোয়াড়দের (এমানুয়েল সানডে, রাফায়েল, অগস্তো, দরিয়েলতন ও এমানুয়েল টনি) লম্বা মৌসুমের জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাঁরা ফুটবলে কমিটেড। অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সাদারল্যান্ড অনূর্ধ্ব-২১ দলে খেলা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মিডফিল্ডার কিউবা মিচেলকে। এ ছাড়া দলে স্থানীয় প্রয়োজনীয় খেলোয়াড় ধরে রাখার পাশাপাশি নতুন খেলোয়াড় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে দল শুধু শক্তিশালী ভারসাম্যময় হয়নি, অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ম্যাচিউরিটি নিয়ে মাঠে লড়তে পারবে।
এএফসি চ্যালেঞ্জ লীগের প্লে অফে এবার বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছে ঢাকা আবাহনী লিমিটেড ও বসুন্ধরা কিংস। প্লে অফে হারলেই বিদায়। কঠিন চ্যালেঞ্জ। গত ১২ আগস্ট বিকেলে হোম ভেন্যু ঢাকার জাতীয় স্টেডিয়ামে খেলেছে আবাহনী কিরগিজস্তানের ক্লাব মুরাস ইউনাইটেডের বিপক্ষে। ক্লাবটি নতুন হলেও এরই মধ্যে সেন্ট্রাল এশিয়ার ক্লাব ফুটবলে শক্তিমত্তার স্বাক্ষর রেখে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ফুটবলকাঠামো উন্নয়নে ক্লাবটি প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছে। এই ক্লাবে ইউক্রেন জাতীয় দলের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় খেলেন।
যোগ্য এবং শক্তিশালী দল হিসেবে আবাহনীকে ২-০ গোলে পরাজিত করেছে মুরাস ইউনাইটেড। আবাহনী বুঝতে পেরেছে শক্তির পার্থক্য এবং দুর্বলতাগুলো কোথায়। একজন মাত্র বিদেশি খেলোয়াড় দিয়াবাতের ওপর ভরসা করে আবাহনী মাঠে নেমেছে—এ ছাড়া তাদের তো আর কোনো বিকল্প ছিল না। ২০১৯ সালে আবাহনী গ্রুপ পর্বের বেড়া অতিক্রম করে এএফসি কাপে আঞ্চলিক সেমিফাইনাল খেলেছিল। যত সময় গড়াচ্ছে এএফসি কম্পিটিশনগুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ছে। অগোছালো ফুটবল দূরে সরে যাচ্ছে।
১২ আগস্ট রাতে কাতারের দোহায় সুইইম বিন হামাদ স্টেডিয়ামে মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়ার অনেক পুরনো এবং ঐতিহ্যবাহী ক্লাব আল কারামাহরের বিপক্ষে বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও প্রথম থেকে সাহসের সঙ্গে উজ্জীবিত দলগত খেলার মাধ্যমে ছয় মিনিটের মধ্যে প্রতিপক্ষ সিরিয়ার লীগে আটবারের চ্যাম্পিয়ন আল কারামাহর ক্লাবের জালে বল ঢোকাতে সক্ষম (১-০) হয়েছে বসুন্ধরা কিংস। গোল করেছেন এমানুয়েল সানডে। এই সানডে এবার প্রথম চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন বসুন্ধরা কিংসের সঙ্গে। মাঠে খেলোয়াড়দের সমঝোতা ছিল চোখে পড়ার মতো।
ঢাকায় স্থানীয় খেলোয়াড়রা কোচ সৈয়দ গোলাম জিলানী, মাহবুব হোসেন রক্সি ও নুরুজ্জামানের অধীনে ১৪ দিন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। দোহায় যোগ দেওয়া বিদেশি সব খেলোয়াড়ের সঙ্গে অনুশীলনের সুযোগ হয়েছে মাত্র দুই দিন। যে সুবিধা বসুন্ধরা কিংসের স্থানীয় খেলোয়াড়রা পেয়েছেন, সেটি হলো বিদেশি খেলোয়াড়দের দক্ষতা এবং সামর্থ্য সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হওয়া। এর জন্য মাঠের লড়াইয়ে তেমন সমস্যা হয়নি। মানিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। সিরিয়ার ক্লাবটি ভাবতেই পারেনি বাংলাদেশের বসুন্ধরা প্রথমার্ধে (১-০) গোল করে এই গোল ধরে রেখে গ্রুপ পর্বে চলে যাবে। প্রতিপক্ষ বসুন্ধরা কিংসের উজ্জীবিত খেলার শুধু প্রশংসা করেনি, তারা অবাক হয়েছে মাঠের লড়াই দেখে। চ্যালেঞ্জ লীগে অচেনা সিরিয়ান ক্লাবের বিপক্ষে বসুন্ধরা কিংসের গোছানো ফুটবল দেখে স্টেডিয়ামে উপস্থিত বাঙালি এবং অন্য দেশের দর্শকরা আনন্দিত হয়েছে। পুরো খেলায় দর্শকরা উৎসাহ জুগিয়েছে।
এএফসি চ্যালেঞ্জ লীগে দ্বিতীয় পর্বে বাংলাদেশের দল হিসেবে পৌঁছে যাওয়া—এটি বসুন্ধরা কিংসের জন্য আসন্ন ঘরোয়া ফুটবলে দারুণ বুস্ট-আপ। এই প্রেরণা দলটিকে আসন্ন ফুটবল মৌসুমে দলগতভাবে চিত্তাকর্ষক ফুটবল খেলতে অনুপ্রাণিত করবে। ফুটবল মৌসুম শুরু হবে এবার চ্যালেঞ্জ কাপের মাধ্যমে আগের নিয়ম অনুযায়ী। একটিমাত্র ম্যাচ খেলা হবে গত মৌসুমের লীগ শিরোপা বিজয়ী মোহামেডান ও ফেডারেশন কাপ বিজয়ী বসুন্ধরা কিংসের মধ্যে।
বসুন্ধরা কিংসের দায়িত্ব এখন অনেক বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে চ্যালেঞ্জও। বিদেশে ভালো খেলতে হবে এবার কিংসকে। খেলতে হবে অনেক বেশি শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিপক্ষে। আর এর জন্য যথাযথ প্রস্তুতির প্রয়োজন। ২৮ আগস্ট এএফসি চ্যালেঞ্জ লীগের গ্রুপ পর্বের ড্র অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে জানা যাবে গ্রুপ পর্বে কারা খেলবে বাংলাদেশের বসুন্ধরার বিপক্ষে। খেলা শুরু হবে অক্টোবরে, আর সেটি কয়েক মাস ধরে চলবে। টুর্নামেন্টের প্লে অফে জয়ী ৯ দল খেলবে সরাসরি গ্রুপ পর্বে জায়গা করে নেওয়া ১১ দলের সঙ্গে।
লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া।
বিডি প্রতিদিন/নাজিম