ক্যানবেরার মানুকা ওভালে হাজার হাজার বাঙালি যখন গলা ছেড়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইছিলেন, তখন একবারও মনে হয়নি সুদূর অস্ট্রেলিয়ার রাজধানীতে খেলছে বাংলাদেশ। সমর্থকদের গগনবিদারী আওয়াজে মনে হচ্ছিল মিরপুর কিংবা চট্টগ্রামে খেলছে টাইগাররা। মানুকা ওভালের সেই দর্শকপ্রিয়তার কথা আজীবন স্মৃতিপটে লেখা থাকবে বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে। চির জাগরুক থাকবে মাশরাফি-সাকিবদের মনের গহিনে।
এক সময় ফুটবলের ছায়ায় হাঁটতো বাংলাদেশের ক্রিকেট। খেলা হতো শীতকালে। ক্রিকেটপ্রেমীরা মাঠমুখি হতেন অলস সময় কাটাতে। সেটা সত্তর-আশির দশকের কথা। কিন্তু এখনকার চিত্র একেবারেই ভিন্ন। ফুটবল বরং হাঁটে ক্রিকেটের ছায়ায়। ক্রিকেট এখন এক নম্বর খেলা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মানেই দর্শকের ঢল, হুমড়ি খেয়ে পড়া। ক্রিকেট মানেই প্রাণের খেলা। মনের খেলা। ক্রিকেট এখন রক্তের কণিকা। নাচন তোলার খেলা। বাংলাদেশ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কিংবা এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন নয়। তারপরও বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের এই উন্মাদনা অন্য যে কোনো দলের চেয়ে এগিয়ে যোজন যোজন। এই ভালোবাসা আর ক্রিকেট উন্মাদনা এবং বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন সমার্থক শব্দ।
ক্রিকেটপ্রেমীদের এই ক্রিকেট উন্মাদনা, ভালোবাসায় মুগ্ধ বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। বাংলাদেশের ক্রিকেট যে আজকের অবস্থানে, তার পিছনে শুধু পারফরম্যান্স নয়, ক্রিকেটপ্রেমীদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার সংযোজনও অনেক। কাল ম্যাচের আগের দিন অফিশিয়াল সংবাদ সম্মেলনে ক্রিকেটের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার জন্য ক্রিকেটপ্রেমীদের অভিবাদন জানান টাইগার অধিনায়ক, 'আমাদের পারফরম্যান্স আহামরি ভালো নয়। তারপরও দেশের মানুষ আমাদের যেভাবে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছেন, তা অসাধারণ। তারা আমাদের ক্রিকেটকে অনেক কাছে নিয়ে এসেছেন। পৃথিবীর কোথাও এমনটি দেখা যায় না। দেখুন অস্ট্রেলিয়া চার বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। অথচ তাদের দেশে অন্যান্য খেলাগুলোতে মানুষ হয়। ক্রিকেট উন্মাদনা তেমন একটা নেই। আমাদের দর্শকদের এই ক্রিকেট ভালোবাসাকে সন্মান জানাই। দুই-তিন ম্যাচ হারলেও মাঠে এসে যেভাবে আমাদের সমর্থন জোগান, এক কথা অসাধারণ। তাদের এই ক্রিকেট ভালোবাসাকে স্যালুট করি।'
আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দেখতে পুরো অস্ট্রেলিয়া যেন ভেঙে পড়েছিল! সিডনি, মেলবোর্ন, পার্থ, ক্যানবেরা থেকে হাজার হাজার সমর্থক উপস্থিত হয়েছিলেন মানুকা ওভালে। ক্রিকেটাররা যাতে কোনো রকম একাকিত্ব অনুভব না করেন, দেশীয় আবহ উপভোগ করতে পারেন তার চেষ্টার কার্পণ্য ছিল না প্রবাসী বাঙালিদের। ক্যানবেরার সেই জনস্রোত দেখা যায়নি ব্রিসবেনে। কারণ আর কিছু নয়, বৃষ্টি। বৃষ্টি ভাসিয়ে নিয়েছিল খেলা। 'ক্রিকেটের হৃদয়' মেলবোর্নের বিশাল স্টেডিয়ামে হাজার হাজার বাঙালি উপস্থিত হয়েছিলেন। এসব এখন স্মৃতি। কিন্তু বড্ড তরতাজা। প্রবাস জীবনে থাকা হাজার হাজার বাঙালি সব কাজ-কর্ম বাদ দিয়ে মাঠে উপস্থিত হন প্রিয় দলকে মনপ্রাণ উজাড় করে সমর্থন জোগাতে।
ক্রিকেট শুধু দেশের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত নয়। মিডিয়ারও রয়েছে এর প্রতি আলাদা টান। দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। প্রিয় দলের রিপোর্ট করতে উপস্থিত হয়েছেন ৩০ জন ক্রীড়া সাংবাদিক। ক্রীড়া সাংবাদিকরা কখনো ক্যানবেরা, কখনো ব্রিসবেন, মেলবোর্ন, নেলসন ঘুরে বেড়াচ্ছেন দলের রিপোর্ট কাভার করতে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রতি সাংবাদিকদের এই ভালোবাসায় মুগ্ধ টাইগার অধিনায়কও, 'বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন যে অবস্থানে, তাতে সাংবাদিকদের অবদানও অনেক। তারা যদি এভাবে তুলে না ধরতেন, তাহলে বিষয়গুলো এত ফোকাস হতো না। ক্রিকেটাররাও এত ফোকাস হতেন না, যা দেশের মানুষ অনুসরণ করছে। সত্যি বলতে কী কাভারেজের জন্যই বাংলাদেশের ক্রিকেট এত কাছাকাছি দেশবাসীর। এসবের অবদান মিডিয়ার। সব মিলিয়ে ক্রিকেট আমাদের সবাইকে একটি ইমোশনের জায়গায় এনে ঠেকিয়েছে।'
আজ সংবাদপত্র যখন পাঠকের হাতে, তখন হয়তো খেলার ফলও জেনে যাবেন সবাই। সংবাদ পাঠকের কাছে পৌঁছানোর আগেই মাশরাফির কথা শতভাগ সত্যি প্রমাণিত হবে আরও একবার। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি দেখতে ভোর হতেই গোটা দেশ হুমড়ি খেয়ে পড়বে টেলিভিশনের সামনে। মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান, সব ধর্মাবলম্বীর মানুষ নিজ নিজ ধর্মালয়ে দুই হাত তুলে প্রার্থনা করবেন প্রিয় দলের সাফল্যের জন্য। দেশের মানুষের এই ক্রিকেটপ্রেম পুরো দেশকেই এক সুতোয় গেঁথে ফেলবে সন্দেহ নেই। এমন করে গেঁথেছে এর আগে বহুবার।