প্রশ্নটি শুনে হাসলেন। হাসির প্রকৃত অর্থ বোঝা গেল না! এরপর অবশ্য মাথা নাড়েন। বিশ্বকাপের আসরে এবারের সবচেয়ে আলোচিত তারকা কুমার সাঙ্গাকারা। টানা চার ম্যাচে সেঞ্চুরি করে এখন অনন্য উচ্চতায় এই লঙ্কান। লঙ্কানের অবিশ্বাস্য ব্যাটিংশৈলীতে মুগ্ধ ক্রিকেটবিশ্ব। সাঙ্গাকারার পর দ্বিতীয় আলোচিত বিষয় এখন, ব্যাট। বিশ্বকাপে সাফল্য পেতে ক্ষুধার্ত ক্রিস গেইল, ডেভিড ওয়ার্নাররা ব্যবহার করছেন ভারী ও লম্বা ব্যাট। টানা দুই সেঞ্চুরির পর মাহমুদুল্লাহর কাছেও প্রশ্নটি এলো, ভারী ব্যাট ব্যবহার করছেন কিনা? অনেকক্ষণ ভেবে ঠাণ্ডা গলায় উত্তর মাহমুদুল্লাহর, 'না'।
বিশ্বকাপ শুরুর আগে অনেকেই বলছিলেন, পেসারদের গতি, বাউন্স ও সুইংয়ের বিপক্ষে জোর লড়তে হবে ব্যাটসম্যানদের। ক্রিকেট মহাযজ্ঞ শুরুর পর নিউজিল্যান্ডে সেটার দেখাও মিলেছে। কিউই বোলারদের গতি, সুইংয়ে নাকাল হয়েছেন বিশ্বের তাবত তাবত সেরা ব্যাটসম্যানরা। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় বিশ্বকাপ এখন ব্যাটসম্যানদের জন্য। ব্যাটসম্যানদের সেই রেসে শামিল বাংলাদেশের মাহমুদুল্লাহ, মুশফিকুর রহিমও। তবে সবাইকে ছাড়িয়ে সাঙ্গাকারা। ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ। বয়স ৩৭।
অথচ খেলছেন যুবকের মতো! ৬ ম্যাচে সাঙ্গাকারা করেছেন ৪৯৬। তাতে আবার টানা চার সেঞ্চুরি। এরপরই দক্ষিণ আফ্রিকার এবি ডি ভিলিয়ার্স, ৬ ম্যাচে ৪১৭ রান। দুই সেঞ্চুরি করে তিলকারত্নে দিলশানের রান ৬ ম্যাচে ৩৯৫। মাহমুদুল্লাহর রান ৫ ম্যাচে ৩৪৪। বিশ্বকাপে রান সংগ্রহের তালিকায় এখন চার নম্বরে রয়েছেন তিনি। অন্যদের তুলনায় মাহমুদুল্লাহ ম্যাচ খেলেছেন অবশ্য একটি কম। মাহমুদুল্লাহর ব্যাটিংয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেন কালকের ম্যাচে নেতৃত্ব দিতে নামা সাকিব আল হাসান, 'মাহমুদুল্লাহ যেভাবে ব্যাটিং করেছেন, এক কথায় অসাধারণ। তবে একজন পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে তার কাজ শেষ হয়ে যায়নি। তাকে আরও রান করতে হবে। সাঙ্গাকারা যদি চারটি সেঞ্চুরি করতে পারেন, তাহলে সে কেন পারবে না।'
গত চার আসরে যেখানে একটিরও দেখা মেলেনি। সেখানে এক আসরেই পরপর দুটি সেঞ্চুরি। তাও আবার বিশ্বকাপে। তুঘলকি কাজ-কারবার নয়তো! না, একেবারে নিখাদ সত্যি। বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে বিশ্বকাপে পরপর দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি করে মাহমুদুল্লাহ এখন মহাতারকা। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম সেঞ্চুরিও মাহমুদুল্লাহর। অ্যাডিলেড ওভালে সেই স্বপ্নপূরণ করেন মাহমুদুল্লাহ। কাল হ্যামিল্টনের সেডন পার্কে করেন আরও এক সেঞ্চুরি। টানা দুই সেঞ্চুরি করে মাহমুদুল্লাহ এখন ক্রিকেট মহাযজ্ঞের সোনালি খাতায় মোড়ানো রেকর্ড বুকে।
অবশ্য টানা দুই সেঞ্চুরির মালিক একমাত্র মাহমুদুল্লাহই নন, শাহরিয়ার নাফিস করেন ২০০৬ সালে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয়পুরে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ১২৩ ও খুলনায় খেলেন ১০৫ রানের ইনিংস।
কোয়ার্টার ফাইনাল আগেই নিশ্চিত হয়েছে দুই দলের। কালকের ম্যাচটির গুরুত্ব তাই কমে গিয়েছিল বহুলাংশে। তারপরও নকআউট পর্বে নামার আগে নিজেদের ঝালিয়ে নেওয়ার জন্য মোক্ষম সুযোগ ছিল কাল। সেই কাজটি সুচারুভাবে করেন মাহমুদুল্লাহ। ২৭ রানে তামিম ইকবালের সাজঘরে ফেরার পর ক্রিজে আসেন মাহমুদুল্লাহ। এসেই টিম সাউদির সুইংয়ে বিভ্রান্ত হয়ে ক্যাচ দেন দ্বিতীয় স্লিপে দাঁড়ানো কোরি অ্যান্ডারসনকে।
কিন্তু অ্যান্ডারসন ফেলে দেন। ফেলে দেওয়ার পর হয় তো পাশে দাঁড়ানো রস টেলর বলেন, 'ম্যাচটিই ছেড়ে দিলে!' তবে শেষ পর্যন্ত সেটা আর হয়নি। অবশ্য মাহমুদুল্লাহ সুযোগটিকে কাজে লাগাতে মোটেও হেলাফেলা করেননি। বোল্ট, সাউদি, অ্যান্ডারসনদের গতি ও সুইংয়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে মানিয়ে নিয়ে খেলেন ১২৮ রানের নান্দনিক এক ইনিংস। অপরাজিত ইনিংসটি খেলেন ১২৩ বলে ১২ চার ও ৩ ছক্কায়। ১১৫ ওয়ানডে ক্যারিয়ারে যা দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। এবং দুটিই বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপের এবারের আসরে টানা চার সেঞ্চুরি করে সাঙ্গাকারা উজ্জ্বল করেছেন রেকর্ড বুককে। দুটি করে সেঞ্চুরি করেছেন তিলকারত্নে দিলশান ও শেখর ধাওয়ান।
দুই ওপেনারকে হারানোর ধাক্কা সামলে ওয়ানডাউনে খেলতে নামা সৌম্য সরকারকে নিয়ে যোগ করেন ৯০ রান। সৌম্য তার কারিয়ারের প্রথম হাফ সেঞ্চুরি করে সাজঘরে ফিরেন ৫১ রানে। সৌম্যর বিদায়ের পর দলের সেরা দুই তারকা সাকিব আল হাসান ও 'মি. ধারাবাহিক' মুশফিক দ্রুত সাজঘরে ফেরার পর ফের হাল ধরেন মাহমুদুল্লাহ। এবার সঙ্গী সাবি্বর রহমান রুম্মন। ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে দুজনে মাত্র ৪৮ বলে যোগ করেন ৭৮ রান। সাবি্বর খেলেন ২৩ বলে ৪০ রানের ঝড়ো ইনিংস। দুজনের আক্রমণাত্দক ব্যাটিংয়ে শেষ ১০ ওভারে সংগৃহীত স্কোর ১০৪! ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যা ছিল ৮৮।
'মি. কুল' মাহমুদুল্লাহ কাল সেঞ্চুরি করে আরও একবার প্রমাণ করেন, সত্যিকার পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না। বছর খানেক আগেও যেখানে সমালোচনার তীক্ষ্ন বাণে জর্জরিত হয়ে তিক্ত হয়ে পড়েছিল তার জীবন, আজ বিশ্বের সবচেয়ে সুখী এক মানুষ মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ।