ক্রিকেট ছিল শান্তির প্রতীক! ক্রিকেটে ছিল সাম্যের জয়গান! ভারত-পাকিস্তানের মতো দুটি চরম শত্রুভাবাপন্ন দেশকেও এক সুতোয় বেঁধেছে ক্রিকেট। অথচ সেই ক্রিকেটই এখন চরম সংকটাপন্ন! অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মাটিতে বিশ্বকাপের মহাযজ্ঞ শেষ হতেই ক্রিকেট-আকাশে দেখা দিয়েছিল মেঘ। কাণ্ডজ্ঞানহীন 'শ্রীনিবাসন কাণ্ডে'র পর আইসিসি সভাপতির পদ ছেড়ে দিয়েছেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। দেশে ফিরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই সাংবাদিকদের সঙ্গে বলেছিলেন, ক্রিকেটের এখন ঘোর দুর্দিন। বিপদাপন্ন ক্রিকেটকে রাহুগ্রাস থেকে বাঁচাতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে ক্রীড়াঙ্গন থেকে নির্বাসনে যাবে জনপ্রিয় এ খেলা। কামালের কথারই অনুরণন তুললেন সাবেক আইসিসি সভাপতি এহসান মানি।
আড়ালে-আবডালে বহু আগে থেকেই আইসিসির বাগডোর ছিল 'বিগ থ্রি'র (ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া) হাতে। গত বছর 'ওপেন সিক্রেট' এই বিষয়টাকেই একটা সাংবিধানিক রূপ দিয়ে দিল 'ওরা তিন'। ক্রিকেটের সর্বোচ্চ মঞ্চের দখল নিয়ে নিল 'বিগ থ্রি'। এরপর আর কোনো বাধা রইল না স্বেচ্ছাচারিতায়। বৈধ হয়ে গেল সবই! যেমন বিশ্বকাপের ফাইনালে সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চ্যাম্পিয়ন দলের হাতে ট্রফি দিলেন দুর্নীতির অভিযোগে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড থেকে বহিষ্কৃত আইসিসির চেয়ারম্যান এন শ্রীনিবাসন। অথচ আইসিসির সংবিধান বলছে, বিজয়ী দলকে ট্রফি দেবেন কেবল আইসিসি সভাপতি। ক্রিকেটে এ 'আধিপত্যবাদ' নিয়ে শঙ্কিত অনেকেই। যার প্রতিবাদে পদত্যাগ করলেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। এবার তাই নিয়ে সরব হলেন সাবেক আইসিসি সভাপতি এহসান মানি। ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থার সভাপতি ছিলেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার লর্ডসে সাম্প্রতিক ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ বিপদ নিয়ে নিজের শঙ্কা প্রকাশ করেন এহসান মানি।
'আইসিসিতে পরিবর্তন এসেছে এক বছর হলো। এরই মধ্যে খেলাটার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হতে হচ্ছে। এখনকার মতো এতটা শঙ্কিত আমি কখনোই ছিলাম না।' ক্রিকেটে 'বিগ থ্রি'র বজ আঁটুনি আইসিসিকে কার্যত নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে। বানিয়েছে 'ঠুঁটো জগন্নাথ'! এখানে ভারত, ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া ছাড়া অন্য কারও কিছু বলার নেই। অধিকারও নেই। ওরা বলল, আগামী বিশ্বকাপ হবে ১০ দলের। এর মধ্যে আটটা খেলবে সরাসরি র্যাঙ্কিং নিয়ে। বাকি দুটোকে খেলতে হবে বাছাই পর্ব। আইসিসিও এ প্রস্তাবে সম্মত! ক্রিকেট একটা বৈশ্বিক খেলা হিসেবে তার অবস্থান হারাতে যাচ্ছে বলেই মনে করেন এহসান মানি। তার মতে, 'এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে ক্রিকেটের ১০টি পূর্ণ সদস্য দেশকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।' মানি বলেন, '১০টি দেশের পাঁচটিই (বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুয়ে) মহাসংকটে আছে। তাদের না আছে অর্থ, না আছে ক্রিকেটীয় যোগ্যতা।' তার মতে, আগামী বিশ্বকাপে যদি বাছাই পর্বে বাংলাদেশ এবং জিম্বাবুয়ে বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করে তবে সহযোগী দলগুলোর কোনো প্রতিনিধিত্বই থাকবে না ক্রিকেটের মহাআয়োজনে। সে ক্ষেত্রে জনপ্রিয় খেলা হিসেবে ক্রিকেট হয়ে পড়বে প্রশ্নবিদ্ধ। এহসান মানি বলেন, 'ক্রিকেট বিশ্বকাপ হতে হবে উন্মুক্ত, প্রতিবন্ধক নয়।' তার মতে, আইসিসির দায়িত্ব হচ্ছে আর্থিক সহায়তা দানের মাধ্যমে ক্রিকেটের বিস্তার করা। আইসিসিকেই নিশ্চিত করতে হবে ক্রিকেটাররা যেন আইপিএলের মতো অর্থের ছড়াছড়ি থাকা টুর্নামেন্টগুলোর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে জাতীয় দলের দায়িত্বকে।
অনেকটা 'নিউ ইম্পেরিয়ালিজম'র (নব্য সাম্রাজ্যবাদ) মতোই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে 'বিগ থ্রি'। এই নব্য সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রথম আওয়াজ তুলেছিলেন আইসিসি সভাপতির পদ ছেড়ে দিয়ে আ হ ম মুস্তফা কামাল। এবার এহসান মানিদের মতো সাবেক প্রেসিডেন্টরাও এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। এই ধারা খুব সহজে থামবে বলে মনে হয় না! শ্রীনিবাসনদের জন্য এটা অশনি সংকেতই!