বসুন্ধরা বাংলাদেশ ওপেন নিয়ে স্বাগতিক গলফারদের স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়া। দেশের মাটিতে প্রথমবারের অনুষ্ঠিত গলফ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হবে বাংলাদেশের কোনো গলফার। শিরোপা জেতা তো দূর কথা সেরা ১০-এ নেই বাংলাদেশের কেউ। চেনা পরিবেশ, চেনা কোর্স তারপরেও সিদ্দিকুর-জামাল-সোহেলরা ভালো করতে পারেননি। টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া বাংলাদেশি ৩১ গলফারের মধ্যে 'কাট' পেয়েছেন মাত্র ৬জন। লিডারবোর্ডে সেই ছয়জনও তো আধিপত্য বিস্তার করতে পারেননি। হতাশায় শেষ হলো সিদ্দিকুরদের মিশন।
যে কুর্মিটোলা গলফ কোর্সে বাংলাদেশি গলফাররা হরহামেশায় ১৭-১৮ 'আন্ডার পার' খেলে থাকেন, সেই কোর্সে ১৪ আন্ডার পার খেলে শিরোপা জয় করে নিলেন সিঙ্গাপুরের মারদান মামত। বাংলাদেশি গলফারদের মধ্যে চার রাউন্ড মিলে পারের চেয়ে কম শট খেলেছেন কেবলমাত্র সাখাওয়াত হোসেন সোহেল। সিদ্দিকুরদের ব্যর্থতা খুঁজতে গিয়ে বের হয় আসল রহস্য।
১. হঠাৎ পার সংখ্যা কমানো : কুর্মিটোলা ১৮ হোলে ছিল ৭২ পার। দেশের গলফাররা সচরাচর সেভাবেই অনুশীলন করেছেন। কিন্তু টুর্নামেন্ট শুরুর আগের দিন হঠাৎ করে ৩ নং হোলে এক পার কমিয়ে দেওয়া হয়। ৫ পারের ওই হোলে করা হয় ৪ পার। এতে দূরত্ব বেড়ে যায়। যে কারণে এই তিন নম্বর হোলেই সিদ্দিকুর, সোহেল ও দুলাল তিনটি করে 'বগি' পেয়েছেন। দুলাল ডাবল বগিও পেয়েছেন।
২. ৪নং হোলে হঠাৎ বাউন্ডারি: আগে বাউন্ডারি ছিল না ৪নং হোলে। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে হঠাৎ বাউন্ডারি দেওয়ায় ঝামেলায় পড়ে যান গলফাররা। কেননা আগে ইচ্ছামতো ড্রাইভ করতো। অনুশীলনও করেছেন সেভাবেই। কিন্তু টুর্নামেন্টে বাউন্ডারি থাকার কারণে তা অতিক্রম করলেই পেনাল্টি খেতে হয়েছে। তাই এই হোলে বাংলাদেশি গলফাররা বার্ডি তো পায়নি, উল্টো বগি খেতে হয়েছে। হঠাৎ বাউন্ডারি দেওয়া প্রসঙ্গে গলফার সাখাওয়াত সোহেল বলেন, 'এই বাউন্ডারি দেওয়াতে আমাদের জন্য সমস্যা হয়েছে। এটা করলেও হতো। অথবা বাউন্ডারিটা আগে দিলেও তো আমরা সেভাবে অনুশীলন করতাম।' এ প্রসঙ্গে এশিয়ান ট্যুরের চিফ রেফারি থাইল্যান্ডের ইয়ং সাং বলেন, 'নিরাপত্তার জন্যই বাউন্ডারি দেওয়া হয়েছে।'
৩. পাটিং গ্রিনের গতি পরিবর্তন: হোলের চারপাশে মসৃণ ঘাসের যে সমতল অংশ থাকে তাকে বলে পাটিং গ্রিন। কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবের এই পাটিং গ্রিনের স্বাভাবিক গতি থাকে প্রতি সেকেন্ডে ৮.৫ থেকে ৯.৫ ফিট। দেশের মাটিতে এমন গ্রিনের পাট করে অভ্যস্ত সিদ্দিকুর-সোহেলরা। কিন্তু এই টুর্নামেন্টে এশিয়ান ট্যুর কর্তৃপক্ষ পাটিং গ্রিনের গতি বাড়িয়ে করেছে প্রতি সেকেন্ডে ৯.৭ থেকে ১০.৫ ফিট। এতে ড্রাইভ ও অ্যাপ্রোচে বাংলাদেশের গলফাররা ভালো করলেও পাট করতে গিয়ে তারা সহজে হোলে ফেলতে পারছিলেন না। এ সম্পর্কে সাখাওয়াত সোহেল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, 'এই কোর্সে আমরা ধীর গতির পাটিং গ্রিনে খেলে অভ্যস্ত। কিন্তু হঠাৎ পরিবর্তনে খেলতে খুবই সমস্যা হচ্ছে। হঠাৎ কেন এমন করা হলো বুঝলাম না।' কেন হঠাৎ করে গ্রিনের গতি বাড়িয়ে দেওয়া হলো, এ প্রসঙ্গে টুর্নামেন্টের জানতে চাইলে এশিয়ান ট্যুরের চিফ রেফারি থাইল্যান্ডের ইয়ং সাং বলেন, 'আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনেই গতি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে গলফারদের খেলতে কোনো সমস্যা না হয়।'
৪. আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ : কখনো বৃষ্টি, কখনো বাতাস এমন আবহাওয়ায় খেলে অভ্যস্ত নন বাংলাদেশের গলফাররা। গলফারদের মধ্যে যারাও খেলেছেন, তারা বৃষ্টি হলেও বৃষ্টির মধ্যেই খেলা চালিয়ে গেছেন। বিদ্যুৎ চমকালেও খেলা চালিয়ে গেছেন। কিন্তু গলফের নিয়ম হচ্ছে বিদ্যুৎ চমকালে তা যদি কোর্সের ২০ কিলোমিটারের মধ্যে হয় তবে খেলা সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করতে হবে। তাই এই আসরে অনেকবারই খেলা বন্ধ করতে হয়েছে। আর একবার বন্ধ করে নতুন করে শুরু করতে গিয়েই মনোযোগ হারিয়ে ফেলছেন গলফাররা। আগের দিন সিদ্দিকুর বলেছেন, 'ভাবতেও পারিনি এমন আবহাওয়ার মধ্যে খেলতে হবে! এমন পরিবেশে অন্যরা অনুশীলন করলেও আমরা বাংলাদেশের গলফাররা কখনো খেলিনি। তাই বেশ সমস্যা হচ্ছে।'
৫. কঠোরভাবে আইন মেনে না চলা : অনুশীলনে কিংবা স্থানীয় টুর্নামেন্টে কখনো কঠোরভাবে আইন মেনে চলা হয়নি। যে কারণে হঠাৎ কঠোর নিয়ম মেলে চলতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছেন গলফাররা। এ প্রসঙ্গে কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবের রুলস কমিটির কো-অর্ডিনেটর এবং টুর্নামেন্টের রেফারি মেজর (অব.) মাহমুদুর রহমান চৌধুরী বলেন, 'আসলে আমাদের এখানে আগে কখনো এতো বড় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট হয়নি বলে গলফার অনেক নিয়মই জানতেন না। অনেক নিয়ম আবার জানার পরও মানতেন না। যেমন অনেক সময় হয়তো তারা ড্রাইভ করে বল ফেয়ারওয়ের বাইরে ফেললেন, কিন্তু পরে ফেয়ারওয়েতে নিয়ে মারলেন। কিন্তু এখানে তো খুবই কড়াকড়ি। হঠাৎ কড়া নিয়ম-কানুন মানতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে যাচ্ছেন হয়তো।'
৬. দর্শকের চাপ : এই টুর্নামেন্টে দর্শকের চাপও সামাল দিতে হয়েছে গলফারদের। বাইরের তারকা গলফাররা তো এমন পরিস্থিতি দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু স্থানীয় গলফারদের জন্য এটা খুবই চাপ।
টুর্নামেন্টের আগে কঠোর অনুশীলন করেছিলেন বাংলাদেশের গলফাররা। কিন্তু হঠাৎ নিয়মের বেড়া-জালে পড়ে তাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়ে গেছে। সেরা ১০ এর মধ্যে নেই কোনো বাংলাদেশের গলফার। এ প্রসঙ্গে মেজর (অব.) মাহমুদুর রহমান চৌধুরীর ভাষ্য, 'যেকোনো টুর্নামেন্টে সাধারণত স্বাগতিক দেশের গলফাররা বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের গলফাররা উল্টো ঝামেলায় পড়েছেন। আমার বিশ্বাস পরের টুর্নামেন্টে চিত্র অন্য রকম হবে। বাংলাদেশের গলফারদের আধিপত্য থাকবে লিডারবোর্ডে।' বাংলাদেশে এশিয়ান ট্যুরের দ্বিতীয় আসর বসবে আগামী বছর মার্চের শেষ সপ্তাহে।