কিছু কিছু মুহূর্ত অনুধাবনের জন্য সময়ের প্রয়োজন হয়। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে অতিরিক্ত মিনিটের শেষ সেকেন্ডটা যখন অতিক্রম করছে বার্সেলোনার কাউন্টার আক্রমণের শিকার জুভেন্টাস। বুড়ো বুফন দুরন্ত ফর্মে থেকেও পেদ্রো-নেইমারের আক্রমণ রুখতে পারলেন না। রেফারির শেষ বাঁশি বেজে উঠার আগেই নেইমারের জোরালো শটে বল বুফনকে পেরিয়ে আঘাত করল জুভেন্টাসের জালে। নিশ্চিত হয়ে গেল বার্সেলোনার ৩-১ গোলের জয়। কিন্তু বার্সা তারকাদের দেখে কে বলবে, ওরা প্রথম ক্লাব হিসেবে দ্বিতীয় ইউরোপীয়ান ট্রেবল নিশ্চিত করল! সাদামাটা যে উচ্ছ্বাস ওটা তো যে কোনো ম্যাচ জিতেই করে থাকে বার্সেলোনা। তবে ধাতস্থ হওয়ার পর সত্যিই উৎসবে মাতল কাতালানরা। নেইমার গোলপোস্টের সামনে হাঁটু মুড়ে দু হাতে চোখ বন্ধ করে প্রার্থনায় রত হলেন। মেসি-ইনিয়েস্তা-সুয়ারেজরা ভক্তদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে উচ্ছ্বাস করতে শুরু করলেন। আর জাভি হার্নান্দেজ! জুভেন্টাস শিবিরে প্রবেশ করে আন্দ্রে পিরলোকে বুকে জড়িয়ে বার বার পিঠ চাপড়ে দিয়ে যাচ্ছিলেন সান্ত্বনা। অথচ একটু পর এমন সান্ত্বনার প্রয়োজন পড়ল বার্সা অধিনায়কেরই!
আ ফেয়ারওয়েল উইথ ট্রেবল! বিদায় বেলায় জাভি হার্নান্দেজের জন্য এরচেয়ে বড় প্রাপ্তির আর কিছু হতে পারতো না। যে দলটাকে নিয়ে মৌসুমের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বিতর্কের শেষ ছিল না। ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছিল যাদের এক আধটা শিরোপা জয়ের স্বপ্নজাল! ওরাই কিনা ইতিহাস গড়ল! এর পিছনের রহস্যটা মেসির চেয়ে বেশি কেউ জানে না। ওরকম ভয়ঙ্কর দিনগুলোতেও দলকে কিভাবে সামলাতে হয় অধিনায়ক জাভি তা ভালোই জানতেন। জানতেন, একমাত্র মেসিই পারে দলের এই অবস্থায় কিছু একটা করতে। একদিন ড্রেসিং রুমে একা পেয়ে আচ্ছামতো বকুনি দিলেন প্রিয় বন্ধুকে। 'তুমি কি চাও আরও একবার রোনালদো ব্যালন ডি'অর জিতুক আর তুমি কেবল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে!' জাভির ওই বকুনিটা মহৌষধের কাজ করেছিল। এরপর বছর ঘুরতেই সম্পূর্ণ নতুন বার্সেলোনাকে দেখল বিশ্ব। এমন এক বার্সেলোনা যারা সব বিতর্কের পরও সেরা ক্লাব হতে জানে। এমন এক মেসিকে দেখল যাকে নিয়ে নতুন গবেষণায় রত হলেন ফুটবলবোদ্ধারা।
ম্যাচটা এমন হবে কেউ ভাবেনি। বার্সেলোনা সেরা। এতে আর সন্দেহ কি। কারণ ওদের এমএসএন (মেসি-সুয়ারেজ-নেইমার) আছে। কিন্তু জুভেন্টাসও কি কম! একজন কার্লোস তেভেজ, একজন বুফন কিংবা একজন আন্দ্রে পিরলো কি প্রতি বছরেই জন্ম নেয়! ওদের মতো ফুটবলাররা কালেভদ্রে আসে। আর একাই যে কোনো ম্যাচের ভাগ্য বদলে দেওয়ার সামর্থ্য রাখে। কিন্তু গত শনিবারের ম্যাচটা দেখে কে বলবে জুভেন্টাসের প্লেয়ার লিস্টে তেভেজ-পিরলো-বুফনদের মতো ফুটবলারেরও নাম ছিল! পরিসংখ্যান বলছে, ৬২-৩৮ বল পজেশনে এগিয়ে বার্সেলোনা। কিন্তু এই পরিসংখ্যান সত্যি বলতে কিছুই প্রকাশ করে না। ম্যাচটা যারা দেখেছেন তারাই কেবল বলতে পারবেন ম্যাচ কতটা একতরফা ছিল। জুভেন্টাস যে ইন্টার মিলান, এসি মিলান আর নেপোলির মতো দলকে বহু পেছনে ফেলে ইতালিয়ান সিরিএ লিগ জিতেছে, জিতেছে ইতালিয়ান কাপ এর প্রমাণ কই! চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে এর ছিটেফোঁটাও দেখা গেল না। আরও একবার কেবল স্প্যানিশ লিগের শ্রেষ্ঠত্বই প্রমাণ হয়নি বরং গত এক দশকে এককভাবে শ্রেষ্ঠ দলের মুকুটটা পরে থাকল বার্সেলোনা। ২০০৬ থেকে ২০১৫। এই ১০টা বছরে চারটা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় করা কি সোজা কথা! অথচ এ সময়ের মধ্যে বায়ার্ন মিউনিখ, ইন্টার মিলান, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদ আর চেলসির মতো ক্লাবের মহা উত্থান দেখেছে ভক্তরা। ভেবেছে এই বুঝি ওরা কেড়ে নিল বার্সার মুকুট। কিন্তু বার বার ওটা ফিরে এসেছে কাতালুনিয়ায়। শনিবার যেমন স্বীকৃতি দিয়ে গেলেন জুভেন্টাস অধিনায়ক জিয়ানলুইগি বুফন! 'ওরা আমাদের চেয়ে অনেক ভালো দল। আর মেসি! ও নিঃসন্দেহে একজন অ্যালিয়েন। ভিনগ্রহের কেউ!'
লুইস এনরিকে হাঁটছেন পেপ গার্ডিওলারই পথে। ২০০৮-০৯ সালে পেপ গার্ডিওলা বার্সেলোনায় তার প্রথম মৌসুমেই জিতেছিলেন ট্রেবল। এনরিকেও তাই জিতলেন। তবে এরপরও কেন জানি, এনরিকের কণ্ঠে বিচ্ছেদের সুর! তারপরও বলে দিচ্ছেন, বার্সেলোনা সামনের বছরগুলোতেও এই সফলতা ধরে রাখবে। কারণ! বার্সেলোনার রয়েছে একজন মেসি, একজন নেইমার আর একজন সুয়ারেজ। আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাকেও তো মনে রাখতে হবে! উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে ম্যাচ সেরা হয়ে তিনি আবারও প্রমাণ দিলেন, বড় ম্যাচগুলোতে কি রকম দারুণ খেলতে জানেন ইনিয়েস্তা। ২০১০ বিশ্বকাপ ফাইনাল, ২০১২ ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল এবং ২০১৫ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল, সবখানেই তো ইনিয়েস্তা সেরা!