ছোটগল্পের সার্থক লেখক কী উপন্যাস লিখতে গিয়ে বার বার শুধু পাণ্ডুলিপিই ছিঁড়ে ফেলবেন! তা কি করে হয়? তাহলে ছোটগল্পের জনক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাথা থেকে কিভাবে গোরা, শেষের কবিতা, চোখের বালি, নৌকাডুবি, যোগাযোগ ও ঘরে বাইরের মতো বিখ্যাত উপন্যাসগুলো বেরিয়েছিল? যদি চেষ্টায় ছোটগল্পের লেখকও এক সময় জগদ্বিখ্যাত ঔপন্যাসিক হয়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল কেন ওয়ানডেতে আগুনঝরা পারফরম্যান্স দেখানোর পর টেস্টে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না?
ওয়ানডে যদি ছোটগল্প হয় টেস্ট ক্রিকেট তো উপন্যাস-ই। এতো দিন ওয়ানডেতে একের পর এক বাঘা বাঘা দলগুলোকে হারিয়ে সিরিজ জিতলেও টেস্টে ছিল বাংলাদেশ ছিল নখদন্তহীন। একই দল, খেলোয়াড় একই, শুধুমাত্র ফরম্যাটের পরিবর্তের কারণে কেন ফলাফলে এমন আকাশ-পাতাল পার্থক্য!
কাল চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে অবশ্য দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। এবার বুঝি টেস্টেও জেগেছে বাংলাদেশ! তাই তো বিশ্বের এক নম্বর টেস্ট দলের বিরুদ্ধে প্রথম দিনটা নিজের করে নিল টাইগাররা।
দক্ষিণ আফ্রিকার মতো শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপকে মুশফিকরা গুঁড়িয়ে দিয়েছে মাত্র ২৪৮ রানে। টেস্টে বাংলাদেশ আগে কখনো এমন স্বপি্নল দিন অতিবাহিত করেছে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। শুধুমাত্র বাংলাদেশ কেন, টেস্ট ইতিহাসেই এমন ঘটনা বিরল-র্যাঙ্কিংয়ের ৯ নম্বর দলের কাছে এক নম্বর দল নাস্তানাবুদ, প্রথম দিনেই! চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম দিন শেষে এ কথা বলাই যায়, 'ছোটগল্পে'র পর এবার শক্ত হাতে 'উপন্যাস'ও লিখতে শুরু করেছে টাইগাররা!
ওয়ানডেতে দারুণ ধারাবাহিক বাংলাদেশ। শেষ ২০ ম্যাচের মধ্যে জয় এসেছে ১৫টিতেই। ঘরের মাঠে টাইগাররা টানা চার সিরিজ জয় করেছে। জিম্বাবুয়ে, পাকিস্তান, ভারতের পর এই দক্ষিণ আফ্রিকাকেও বধ করেছে লাল-সবুজরা। এর মধ্যে বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালেও ওঠার তরতাজা গল্পও আছে। কিন্তু টেস্টে বাংলাদেশ কেন যেন পেরে উঠছিল না। অথচ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে পাঁচ দিনের ক্রিকেটেই বেশি ভালো করার কথা বাংলাদেশের! কেননা প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতেই বড় হয় এদেশের সাধারণ মানুষ। শরীরে এবং মননে তাদের দৃঢ়তা ইস্পাতের চেয়ে কঠিন! আর দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটে তো এই দুই বৈশিষ্ট্যই বেশি প্রয়োজন-ফিটনেস এবং দৃঢ় মানসিকতা। তবে ধীরে ধীরে টাইগাররা নিজেদের সামর্থ্য সম্পর্কে সচেতন হচ্ছেন বলেই হয়তো দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলকে টেস্টে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন।
'টেস্ট ক্রিকেট ১৫ সেশনের খেলা। এখানে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হয় প্রতিটি সেশনেই। এর মধ্যে অন্তত ৭-৮ সেশনে আধিপত্য বিস্তার করতে পারলে জয় না পেলেও ড্র অনিবার্য।' -বে-সরকারি এক টেলিভিশনের লাইভ অনুষ্ঠানে কথাগুলো বলেছেন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান। বাংলাদেশ প্রথম দিনের তিন সেশনের মধ্যে দুই সেশনেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে উড়িয়ে দিয়েছে। অথচ প্রথম সেশনে পাত্তাই পায়নি মুশফিকরা, ২৮ ওভারে মাত্র এক উইকেট হারিয়ে ১০৪ রান করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।
মেঘলা আকাশ দেখেও টস জয়ের পর হাশিম আমলার ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়ে যারা সোশ্যাল মিডিয়া সরব হয়েছিলেন তারাও তখন মুখে কুলুপ অাঁটেন। কিন্তু লাঞ্চের পর পাল্টে যায় পরিস্থিতি। এলগার ও ডু-প্লেসিসের ৭৮ রানের জুটিটা ভেঙে দেন তাইজুল ইসলাম। তারপর থেকেই নিয়মিত বিরতিতে পড়তে থাকে প্রোটিয়াদের উইকেট।
তাইজুল ৪৭ রানে এলগারকে এবং প্লেসিসকে ৪৮ রানে সাজঘরে পাঠিয়ে দেন সাকিব আল হাসান। তারপর দলীয় ৬০তম ওভারে 'সাতক্ষীরার সুপারম্যান' মুস্তাফিজুর রহমানের স্বপি্নল ডেলিভারি। কাটার মাস্টার চার বলে তিন নেন। ওই ওভারের প্রথম বলে হাশিম আমলা ক্যাচ তুলে দেন উইকেটরক্ষক লিটন দাসের কাছে। দ্বিতীয় বলে জেপি ডুমিনি এলবিডব্লু। হ্যাটট্রিকের সুযোগ তৈরি হলেও কুইনটন ডি কককে তৃতীয় বলে আউট করতে পারেননি মুস্তাফিজ। কিন্তু চতুর্থ বলে কাটার মাস্তারের যে বলে ডি ককের স্ট্যাম্প উড়ে যায় ওই বলে আউট হয়ে যেত যেকোনো ব্যাটসম্যান। বল এতো বেশি কাট করেছিল যে, ডিফেন্স করেও রক্ষা পাননি প্রোটিয়া ব্যাটসম্যান।
মাত্র ১৭৩ রানে টপ অর্ডারের ছয় ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোর বোর্ড তখন 'মহাশ্মশান'। তবে স্রোতের প্রতিকূলে দাঁড়িয়ে একাই লড়াই করে যাচ্ছিলেন টেম্বা বাভুমা। টেস্ট ক্যারিয়ারে নিজের প্রথম হাফ সেঞ্চুরিও তুলে নিয়েছেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই বাভুমাকেও ২২ গজ থেকে তাড়িয়েছেন মুস্তাফিজ। মাত্র ২৪৮ রানে অলআউট দক্ষিণ আফ্রিকা। ৩৭ রানে ৪ উইকেট নিয়ে টেস্টেও স্বপি্নল অভিষেক হলো মুস্তাফিজের।
দক্ষিণ আফ্রিকাকে আড়াই'শর নিচে অলআউট করে টাইগাররা এখন যেন স্বপ্নকাতুর! চট্টগ্রামের 'তক্তমার্কা' ব্যাটিং উইকেটে প্রথম দিনই দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলের ১০ উইকেট নেওয়া তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। ইতিবাচক ভাবনাটা প্রসারিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে এখনো বাকি চার দিন তথা ১২ সেশন। অনেক কিছুই ঘটতে পারে।