দুই ওভালের মাঝে দূরত্ব ৮ হাজার মাইল-ইংল্যান্ডের 'দ্য ওভাল' এবং শ্রীলঙ্কার 'পি. সারা ওভাল'। মাত্র সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার ব্যবধানে দুই ওভালে আজ বিদায়ী ম্যাচ খেলতে নামছেন দুই গ্রেট ক্রিকেটার- অস্ট্রেলিয়ার মাইকেল ক্লার্ক এবং শ্রীলঙ্কার কুমার সাঙ্গাকারা। ক্রিকেটের ইতিহাসে এমন ঘটনা আর কখনো ঘটেনি- একই দিনে দুই দলের গ্রেট ক্রিকেটার খেলতে নামছেন তাদের বিদায়ী ম্যাচ। কাকতালীয়ভাবে দুই স্টেডিয়ামের নামও 'ওভাল'।
একের পর এক সাফল্য দিয়ে দুই তারকাই দেশ ও ব্যক্তিগত অর্জনের খাতা ভর্তি করে রেখেছেন। কিন্তু তারপরও দূরত্ব ও সময়ের ব্যবধানের মতো দুই গ্রেটের বিদায়টাও হবে দুই রকমভাবে। নিজ দেশে কুমার সাঙ্গাকারার বিদায়টা যেখানে হতে যাচ্ছে উৎসব মুখর, সেখানে পরদেশে (ইংল্যান্ডে) মাইকেল ক্লার্কের বিদায়টা হবে খুবই বিষাদময়!
কুমার সাঙ্গাকারা-বিদায়ের ঘোষণা আগেই দিয়েছেন। পূর্ব নির্ধারিতই ছিল, তিনি ঘরের মাঠ কলম্বো থেকেই ক্রিকেট গুডবাই জানাবেন। সে অনুযায়ী সব প্রস্তুতিও সম্পন্ন। গোটা শ্রীলঙ্কা যেন ফুলের মালা দিয়ে অপেক্ষা করছে মহাতারকার বিদায়ী লগ্নের জন্য। লঙ্কান ক্রিকেটাররাও প্রাণপ্রিয় সতীর্থকে বিদায় জানানোর দারুণ এক উপলক্ষ এনে দিয়েছেন- আগের ম্যাচে নাটকীয়ভাবে ভারতকে হারিয়ে। এই ম্যাচ জিতলেই নিশ্চিত হয়ে যাবে সিরিজ। এক ম্যাচ হাতে রেখে সিরিজ জিতে কিংবদন্তি ক্রিকেটারকের কিংবদন্তির রূপের বিদায় জানাতে চান তারা। যদি সত্যি সত্যি ম্যাচে শ্রীলঙ্কা জিতে যায়, তবে বিদায়বেলার এর চেয়ে বড় উপহার আর কি হতে পারে সাঙ্গাকারার জন্য!
মাইকেল ক্লার্ক-ব্যর্থতার দায় কাঁধে নিয়ে হঠাৎ অবসরের ঘোষণা দিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছেন। তার সিদ্ধান্তে হতবাক সতীর্থরাও। এক ম্যাচ আগেই মর্যাদার অ্যাশেজ সিরিজ হাতছাড়া হওয়ার দুঃখে নেতৃত্ব থেকে পদত্যাগের পাশাপাশি অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের অধিকারী ক্লার্কের বিদায় হচ্ছে খুবই বেদনাদায়ক পরিস্থিতিতে। এমন বাজে সময়ে একজন গ্রেট ক্রিকেটারের বিদায়ের কথা ভাবাই যায় না! তবে সিরিজ হারলেও ক্লার্কের জন্যই শেষ ম্যাচটা জিততে চায় অস্ট্রেলিয়া। নতুন অধিনায়ক স্টিভ স্মিথ সদর্পেই ঘোষণা দিয়েছেন, 'ক্লার্ক একজন গ্রেট ক্রিকেটার। তার বিদায়টা অবশ্যই বিজয় দিয়ে হতে হবে। তাই সিরিজ হারলেও ওভালে আমরা ক্লার্কের জন্যই জিততে চাই।'
১৫ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে শ্রীলঙ্কাকে অনেক কিছু দিয়েছেন কুমার সাঙ্গাকারা। রেডর্কে রঙিন ব্যক্তিগত পরিসংখ্যানের খাতাও। ১৩৩ টেস্টের ক্যারিয়ারে ৩৮টি সেঞ্চুরি করেছেন। রয়েছে ৫২টি হাফ সেঞ্চুরিও। সাঙ্গার মোট রান ১২,৩৫০। ক্রিকেটের ইতিহাসে বাঁ হাতি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সাঙ্গাকারাই এখন পর্যন্ত সেরা। টেস্টে তার গড় ৫৭.৭১। সর্বকালের সেরা ১০ ব্যাটসম্যানের কথা উঠলেও সেখানে থাকবে সাঙ্গার নাম।
শ্রীলঙ্কান তারকা অন্তত ১১ বার টেস্টে দুই শতাধিক রান করেছেন। এর মধ্যে ১০টি ডাবল সেঞ্চুরি এবং ১টি ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছে। টেস্টে সাঙ্গাকারার চেয়ে ডাবল সেঞ্চুরির ইনিংস বেশি রয়েছে কেবলমাত্র স্যার ডন ব্রাডম্যানের। তার ১২টি ডাবল সেঞ্চুরির ইনিংস ছিল।
সাঙ্গাকারা নিজেকে ব্যাটসম্যানের আগে উইকেটরক্ষক হিসেবে ভাবতেই পছন্দ করতেন। উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে তিনি গ্লাভস বন্দী করেছেন ১৮২টি ক্যাচ। ২০টি স্ট্যাম্পিংও আছে। সাঙ্গাকারা একজন পরিপূর্ণ ক্লাসিক ব্যাটসম্যান। তার বাউন্ডারি হাঁকানোর দৃশ্য ছিল দেখার মতো। টেস্ট ক্যারিয়ারে তিনি ছক্কা হাঁকিয়েছেন মাত্র ৫২টি, কিন্তু বাউন্ডারি ১৪৮৪টি।
একজন ক্রিকেটারের শক্তি হচ্ছে তার পারফরম্যান্স। কিন্তু মাইকেল ক্লার্ক কখনো পারফরম্যান্সের সঙ্গে আপোষ করেননি। একের পর এক ব্যর্থ হওয়ার পরও দলে অাঁকড়ে পড়ে থাকতে হবে-এমন ক্রিকেটার নন ক্লার্ক। তবে প্রতিটি ক্রিকেটারের জীবনেরই চড়াই-উৎরাই থাকে। তাই ক্লার্কও ব্যতিক্রম ছিলেন না। তবে ছিলেন টেস্টে বোলারদের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক। যেকোনো বোলারকে তিনি ঠাণ্ডা মাথায় 'খুন' করতেন!
১১৪ ম্যাচের টেস্ট ক্যারিয়ারে ৪৯.৩০ গড়ে করেছেন ৮৬২৮ রান। ২৭টি হাফ সেঞ্চুরির সঙ্গে ২৮টি সেঞ্চুরি। আর মাত্র একটি সেঞ্চুরি করতে পারলেই ছুঁয়ে ফেলতেন স্যার ডন ব্রাডম্যানকে। ২০১২ সালটা ছিল ক্লার্কের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে সফল বছর। ক্যারিয়ারের একমাত্র ট্রিপল সেঞ্চুরিসহ চারটি ডাবল সেঞ্চুরিই করেছেন ওই বছর। তবে ক্লার্কের বড় অর্জন তার অধিনায়কত্ব ক্যারিয়ারে। দলনেতা হিসেবে সবার কাছেই ভীষণ প্রিয়। তাই তো বিষণ্ন হলেও প্রিয় তারকার বিদায়টা জয় দিয়ে আনন্দমুখর করতে বদ্ধ পরিকর অসি ক্রিকেটাররা।
একসঙ্গে দুই ওভালে বেজে উঠবে বিউগলের করুণ সুর। বিষাদের অাঁচটা আগে থেকেই অনুভব করতে পাচ্ছেন সমর্থকরা। ভক্তদের প্রত্যাশা-বিজয় দিয়েই শেষ হোক দুই গ্রেটের ক্যারিয়ার। জয় হোক দুই ওভালের।