বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক কোচ রিচার্ড পাইবাস এখন বসুন্ধরা ক্রিকেট নেটওয়ার্কের গেম ডেভেলপমেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে ঢাকায় রয়েছেন। তিনি এখানে পুরুষ ও নারী ক্রিকেটারদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি পরিচালনা করছেন, যার আওতায় রয়েছেন উদীয়মান প্রতিভা থেকে শুরু করে অভিজাত পর্যায়ের ক্রিকেটাররা।
বহু দশক ধরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোচিং করানো পাইবাস বিশেষ গুরুত্ব দেন স্কিল ডেভেলপমেন্ট, টি-টোয়েন্টি ও দীর্ঘ ফরম্যাটের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি এবং উচ্চ-পারফরম্যান্স সংস্কৃতি গড়ে তোলার ওপর। একান্ত সাক্ষাৎকারে পাইবাস বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ, যুব উন্নয়নের দিকনির্দেশনা এবং বসুন্ধরা ক্রিকেট নেটওয়ার্কে তার ভিশন নিয়ে কথা বলেন।
প্রশ্ন : আপনি বাংলাদেশে ফিরে আসায় বেশ খুশি মনে হচ্ছে। ধরে নিচ্ছি, বসুন্ধরা ক্রিকেট নেটওয়ার্কের সঙ্গে কাজ করে আপনি সন্তুষ্ট?
রিচার্ড পাইবাস : হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি আগেও বলেছি—এটি নিঃসন্দেহে আমার দেখা সেরা ক্রিকেট সুবিধাগুলোর একটি। এক কথায় অসাধারণ। এখানে প্রশস্ত জায়গা রয়েছে, আর বাংলাদেশের মতো দেশে—যেখানে তাপ, বৃষ্টি ও আর্দ্রতা প্রায়ই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়—সেখানে এই ধরণের আধুনিক ইনডোর সুবিধা সত্যিই অসাধারণ এক সম্পদ। এমনকি বর্ষাকালের মতো প্রতিকূল আবহাওয়াতেও আমরা নির্বিঘ্নে অনুশীলন চালিয়ে যেতে পারি। যদি আপনি আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় তৈরি করতে চান, তবে আপনার দরকার আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ-সুবিধা। এই কেন্দ্রটি সেই প্রয়োজন পূরণ করছে—এটি খেলোয়াড়দের জন্য সত্যিকারের আশিস। এর পেছনে যে দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিকল্পনা রয়েছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। এর পাশাপাশি বাইরের অনুশীলন সুবিধাগুলোও দারুণ। সব মিলিয়ে, এটি এখন বাংলাদেশের ক্রিকেট উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠছে।
প্রশ্ন : এখানে কাজ করার অভিজ্ঞতা এখন পর্যন্ত কেমন?
রিচার্ড পাইবাস : আপনি পৃথিবীর যেখানেই যান না কেন, প্রতিভা সবসময়ই থাকে। আসল বিষয় হলো—আপনি সেই প্রতিভার যথাযথ বিকাশ ঘটাতে পারেন কি না। এখানে কিছু অসাধারণ তরুণ ক্রিকেটারের সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমি সত্যিই উপভোগ করছি। যা আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে, তা হলো — এই প্রোগ্রামটি সম্পূর্ণ লিঙ্গ-সমতা ভিত্তিক। ছেলে-মেয়েরা এখানে একসঙ্গে, সম্মানজনক ও ইতিবাচক পরিবেশে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। যেসব বাবা-মায়ের মেয়েরা ক্রিকেটে আগ্রহী, তাদের জন্য এটি একটি চমৎকার সূচনা বিন্দু। এখানে জাতীয় দলের ক্রিকেটার থেকে শুরু করে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার, জুনিয়র এবং একেবারে নতুনরাও আছে—একই প্ল্যাটফর্মে। গত কয়েক মাস ধরে আমরা বিশেষভাবে মনোযোগ দিয়েছি খেলোয়াড়দের স্কিল ডেভেলপমেন্ট এবং ছোটদের জন্য শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করার লক্ষ্যে। তবে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে—এই প্রজন্ম টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট দেখে এবং খেলেই বড় হচ্ছে। চার-ছক্কা মারা এখন সহজাত হয়ে উঠেছে, কিন্তু ওয়ানডে কিংবা টেস্টের মতো দীর্ঘ ফরম্যাটে টিকে থাকা, কৌশল পরিবর্তন করা বা ইনিংস গড়ে তোলা—এসব সূক্ষ্ম বিষয় বুঝতে ও রপ্ত করতে সময় লাগে। সেই ব্যবধানটা দূর করাই এখন আমাদের অন্যতম ইচ্ছা।
প্রশ্ন : একেবারে নতুন খেলোয়াড় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেটার পর্যন্ত— খেলোয়াড়দের ভিন্ন ভিন্ন চাহিদার ভারসাম্য কীভাবে বজায় রাখেন?
রিচার্ড পাইবাস : আমরা খুব সতর্কভাবে খেলোয়াড়দের ভাগ করি, যেন কেউ তার সক্ষমতার সীমার বাইরে চলে না যায়। আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের জন্য নির্দিষ্ট ও লক্ষ্যভিত্তিক অনুশীলন থাকে, প্রথম শ্রেণির খেলোয়াড়দের জন্য আলাদা কাঠামোবদ্ধ চর্চা, আর তরুণ ও নতুনদের জন্য মূল ফোকাস থাকে মৌলিক দক্ষতা অর্জনে। আমাদের ইনডোর নেট ব্যবস্থাটি মূলত টেকনিক্যাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট এবং কিছু কৌশলগত কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়। এরপর আমরা সেই দক্ষতাগুলোকে মাঠভিত্তিক বাস্তব পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করি—সিচুয়েশনাল ট্রেনিং ও বাইরের সিমুলেশনের মাধ্যমে। সবচেয়ে বড় সুবিধাগুলোর একটি হলো এখানে প্রচুর টার্ফ উইকেট রয়েছে, যা খুবই দুর্লভ। ঢাকার অনেক একাডেমিতে কেবলমাত্র নেট রয়েছে, কিন্তু পর্যাপ্ত মাঠ নেই। এখানে খেলোয়াড়রা দুটোই পায়—উন্নত নেট সুবিধা এবং ফিল্ডিং অনুশীলনের জন্য পর্যাপ্ত সময় ও জায়গা। আর এই দুটো একসাথে থাকাটাই একজন ক্রিকেটারের পূর্ণাঙ্গ ক্রিকেটার হয়ে উঠার জন্য অত্যন্ত জরুরি।
প্রশ্ন : ব্যক্তিগতভাবে আন্তর্জাতিক, ঘরোয়া ও ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে এত দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য কোচিং ক্যারিয়ারের পর— এই নতুন অধ্যায়কে আপনি কীভাবে দেখছেন?
রিচার্ড পাইবাস : আমাকে এখানে এসে এই যাত্রায় অবদান রাখার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, এবং শুরু থেকেই এটি আমার কাছে দারুণ লেগেছে। যখন আমি সুযোগ-সুবিধাগুলো নিজের চোখে দেখলাম, দৃষ্টিভঙ্গি শুনলাম এবং পুরো প্রোগ্রামের বিস্তৃতি বুঝতে পারলাম—তখন সত্যিই রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। আমি কয়েক দশক ধরে কোচিং করছি—ঠিক কতজন খেলোয়াড়ের সঙ্গে কাজ করেছি, তা এখন আর গুনে বলা যায় না! কিন্তু আমি এখনও এই কাজটাকে ভালোবাসি। এমন খেলোয়াড়দের সঙ্গে কাজ করতে পেরে ভালো লাগে, যারা আন্তরিক, যারা শিখতে চায়, নিজেকে উন্নত করতে চায়। একজন কোচ হিসেবে এর চেয়ে তৃপ্তিদায়ক আর কিছু হতে পারে না। এখানে স্থানীয় কোচদের সঙ্গে কাজ করছি, তাদের দক্ষতা উন্নয়নে সহায়তা করছি। তাদের শেখার আগ্রহ, জিজ্ঞাসা, এবং খেলার প্রতি ভালোবাসা আমাকে আমার নিজের শুরুর দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। এই অধ্যায়টা আমার কাছে একরকম "লেবার অব লাভ"—ভালোবাসা থেকে করা কাজ। আমি এখানে আমার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে পারছি, সেরা অনুশীলনের ধারণাগুলো ছড়িয়ে দিতে পারছি, এবং সবচেয়ে বড় কথা—দেখতে পাচ্ছি খেলোয়াড় ও কোচেরা ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছে। এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কিছু হতে পারে না।
প্রশ্ন : ২০১২ সালে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে আপনার সংক্ষিপ্ত সময়ে আপনি একটি প্রতিভাবান প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ইতোমধ্যে ক্যারিয়ার শেষ করেছেন, কেউ বা শেষের পথে। তাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?
রিচার্ড পাইবাস : অভিজ্ঞতাটা সত্যিই দারুণ ছিল। বিজয়কে (এনামুল) আবার দেখে ভালো লাগলো, এবং শুনেছি মুশি (মুশফিকুর রহিম) হয়তো শিগগিরই অবসর নিতে চলেছেন। আমি যাদের সঙ্গে কাজ করেছি, তাদের অনেকেই এখন দলের সিনিয়র খেলোয়াড়, কেউ কেউ ইতোমধ্যে বিদায়ও নিয়ে ফেলেছেন। সেই সময়কার দলের সঙ্গে আমার অনেক সুন্দর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ওরা শুধু ভালো ঘরোয়া ক্রিকেটারই নয়, বরং আন্তর্জাতিক মানে নিজেদের প্রমাণ করেছে। বলা যায়, তারা বাংলাদেশ ক্রিকেটকে একধাপ ওপরে তুলে নিয়ে গিয়েছিল—একটি নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছিল। এই মুহূর্তে আমরা যেসব প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ করছি, সেটিও ঠিক সেই পথেই এগুচ্ছে। আমি নিশ্চিত, একটি পরিণত, প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক দল গঠনের ভিত্তি হিসেবে এটি পরবর্তী প্রজন্মকে সেই একই পথ অনুসরণ করতে সাহায্য করবে।
সৌজন্যে ডেইলি সান