আকারে ছোট হলেও, অনেকটা যেন নাসার পুরনো দিনের মহাকাশযান! টানা ৭১৮ দিন (দু’বছরের চেয়ে মাত্র ১২ দিন কম) ধরে খুব কাছের কক্ষপথ থেকে চুপিচুপি পৃথিবীকে পাক মারার পর রবিবার সেই রহস্য মোড়া ‘এক্স-৩৭বি’ নেমে পড়ল ফ্লোরিডার সমুদ্রসৈকতে। তার অবতরণের খবরটা জানাল মার্কিন বিমানবাহিনী।
লম্বায় ৩০ ফুট বা ৯.১ মিটার (মানে, একটা আড়াই তলা বাড়িকে মাটির সঙ্গে সমান্তরাল রাখলে তা যতটা জায়গা জুড়ে থাকে)। আর তার একটা ডানা থেকে অন্য ডানাটার দূরত্ব ১৫ ফুট। সরকারি ভাবে, যা মার্কিন সেনাবাহিনীর একটি ড্রোন। যা রকেটের পিঠে চেপে মহাকাশে গিয়ে খুব কাছের কক্ষপথে থেকে চক্কর মারে পৃথিবীকে। ২০১০ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত চুপিচুপি ‘এক্স-৩৭বি’-কে মহাকাশ পাঠানো হয়েছে চার বার। পাঠানো হয়, কিছু দিন মহাকাশে কাটিয়ে সে ফিরে আসে। তার পর আবার তাকে পাঠানো হয় মহাকাশে। কিন্তু কেন পাঠানো হয়? কেনই-বা তাকে বার বার চুপিচুপি পাঠানো হয় মহাকাশে?
বিশ্বজুড়ে গত সাত বছর ধরেই এই জল্পনা চলছে। সম্ভবত, এ ব্যাপারে পুরো বিশ্বকে রহস্যে মুড়ে রাখতেই মার্কিন সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কোন দিন তার উৎক্ষেপণের দিনক্ষণ কাউকে জানানো হয়নি। মহাকাশে গিয়ে কোন কাজটা করে ‘এক্স-৩৭বি’?
এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানীদের ‘নানা মুনির নানা মত’।
কারও ধারণা, কাকপক্ষী টের পাওয়ার আগেই এটা মহাকাশ থেকে আচমকা বোমা ফেলে দিতে পারে আমেরিকার কোনও শত্রু দেশ বা কোনও উপদ্রুত অঞ্চলের ওপর।
কারও অনুমান, ‘এক্স-৩৭বি’ আমেরিকার শত্রু দেশের উপগ্রহকে বধ করার হাতিয়ার। যা ‘শত্রু’ উপগ্রহকে পুরোপুরি ধ্বংস বা তার যথেষ্ট ক্ষতি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে তার গোত্র ‘কিলার স্যাটেলাইট’ বা ঘাতক উপগ্রহ।
আবার কেউ কেউ মনে করেন, ‘এক্স-৩৭বি’ আদতে বোধহয় সুপার স্পাই প্লেন বা সর্বাধুনিক গুপ্তচর বিমান। যাকে বিভিন্ন সময়ে মহাকাশে পাঠিয়ে শত্রু দেশ বা বিভিন্ন উপদ্রুত এলাকাগুলির ওপর গোপনে নজরদারি চালায় মার্কিন বিমানবাহিনী। তার নিরাপত্তার স্বার্থে। কোনও দেশ আমেরিকাকে টার্গেট করেছে কি না, তার ওপর নজর রাখতে। বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই ধারণা, আগামী দিনে মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রটা হয়তো প্রস্তুত করছে এই ‘এক্স-৩৭বি’!
ঘটনা হল, জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়ন, খনিজ পদার্থ ও নতুন পানি, তেলের ভাণ্ডারের সন্ধানের জন্য যেমন বিভিন্ন দেশ মহাকাশে উপগ্রহ পাঠায়, তেমনই উপগ্রহ মহাকাশে যায় কোনও দেশের ওপর নজরদারি করতে, অন্য কোনও দেশের পরমাণু অস্ত্র ভাণ্ডারের ওপর নজর রাখতেও। আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ইতিমধ্যেই কৃত্রিম উপগ্রহকে ব্যবহার করেছে, করে চলেছে প্রতিরক্ষায়, প্রতি আক্রমণের কাজে। সন্দেহ নেই, শত্রু দেশের উপগ্রহগুলিকে মহাকাশে বধ করার ফন্দিও আঁটা হয়েছে কখনও সখনও। ২০১৫ সালে সেই আশঙ্কাটা জোরালো হয়েছিল একটি রুশ উপগ্রহের সন্দেহজনক গতিবিধিতে। অনেকেরই ধারণা হয়েছিল, মহাকাশে শত্রু দেশের পাঠানো উপগ্রহগুলিকে বিকল করে বা ধ্বংস করে দিতেই ওই উপগ্রহটি পাঠিয়েছে রাশিয়া। তা নিয়ে জাতিসংঘে অভিযোগও করেছিল কয়েকটি দেশ। তবে বিজ্ঞানী, সমরাস্ত্র বিশেষজ্ঞদের আরেকটি অংশ কিন্তু বলছেন, তাঁদের ধারণায় ধোঁয়াশা থাকলেও, মার্কিন বিমানবাহিনীর ‘এক্স-৩৭বি’ আদতে কোনও সমরাস্ত্র নয়।
সমরাস্ত্র বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘সিকিওর ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন’-এর অন্যতম কর্ত্রী ভিক্টোরিয়া স্যামসনের কথায়, ‘‘এই এক্স-৩৭বি চেহারায় আদতে একটা পিক-আপ ট্রাকের মতো। এর থেকে খুব কার্যকরী ক্ষেপণাস্ত্র বা বোমা ছোড়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া মহাকাশ থেকে ২৪ ঘণ্টা পৃথিবীর সব প্রান্তের ওপর নজর রাখার জন্য কক্ষপথে ‘এক্স-৩৭বি’-কে চক্কর মারানোর জন্য যে বিপুল পরিমাণ শক্তি বা জ্বালানির প্রয়োজন, তা জোগাড় করার সাধ্য নেই মার্কিন বিমানবাহিনীর এই রহস্যে মোড়া উপগ্রহটির। ‘এক্স-৩৭বি’ চলে সৌরশক্তিতে। তার সৌর প্যানেল সূর্যের আলো, বিকিরণ শুষে নিয়ে যে জ্বালানি বানায়, সেটাই ‘এক্স-৩৭বি’-কে দৌড় করায় কক্ষপথে। ফলে, নজরদারি বা বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার সাধ থাকলেও সাধ্য নেই ‘এক্স-৩৭বি’-র। ’’
সামরিক মহাকাশ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী মার্ক গুব্রুড বলছেন, ‘‘মার্কিন বিমানবাহিনীর এই উপগ্রহটি পৃথিবীর এত কাছের কক্ষপথে থাকে যে তার পক্ষে পৃথিবীর একটি বড় অংশের ওপর গোপন নজরদারি চালানো সম্ভব নয়। পৃথিবীর দূরের কক্ষপথে তাকে পাঠানোর জন্য যতটা শক্তি বা জ্বালানির প্রয়োজন, সেই জ্বালানিও তাকে দেওয়া হয় না। তা ছাড়া গুপ্তচর উপগ্রহ হলে তার ডানাই বা লম্বায় অতটা হবে কেন, যা পৃথিবী থেকে টেলিস্কোপে বা অন্য কোনও ভাবে ধরা পড়ে যায়! নজরদারির লক্ষ্য থাকলে কেনই বা ‘এক্স-৩৭বি’-কে রাখা হবে পৃথিবীর অত কাছের কক্ষপথে?’’
উপগ্রহটির উৎক্ষেপণের দিনক্ষণ বার বার মার্কিন বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে গোপন রাখা হলেও, ২০১৫ সালে চতুর্থ বার উৎক্ষেপণের ঠিক ৬ দিনের মাথায় মহাকাশে তার ‘টিকি’ দেখতে পেয়েছিলেন এমনকি, অপেশাদার জ্যোর্তির্বিজ্ঞানীরাও। তার পর কক্ষপথ বদলানোর জন্য কিছু দিন আবার উধাও হয়ে গিয়েছিল ‘এক্স-৩৭বি’। তা হলে কী ‘এক্স-৩৭বি’ মহাকাশে কোনও ল্যাবরেটরি? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হয়তো সেটাই। হয়তো কোনও সেন্সর বা কোনও প্রতিরক্ষা সরঞ্জামকে প্রায় মাইক্রো-গ্র্যাভিটিতে পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। তার সম্ভাব্য পারফরম্যান্স বুঝতে। এক মার্কিন সংস্থা ‘রকেটডাইন’ যেমন জানিয়েছে, এ বার তারা ‘এক্স-৩৭বি’-তে একটি থ্রাস্টারের ক্ষমতা পরখ করে দেখেছে। কোনও গ্রহ, উপগ্রহের কক্ষপথে আমাদের পাঠানো কৃত্রিম উপগ্রহকে ঠেলে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্যই দরকার হয় থ্রাস্টারের। সূত্র: আনন্দবাজার।
বিডি প্রতিদিন/এ মজুমদার