দ্য ভেলভেট আন্ডারগ্রাউন্ড (The Velvet Underground) নাকি ভেলভেট সানডাউন (Velvet Sundown)? এই প্রশ্নটিই বর্তমানে সংগীত জগতে সবচেয়ে বড় বিতর্ক উসকে দিয়েছে। ভেলভেট সানডাউন- এক কাল্পনিক রক গ্রুপ, যার মিউজিক, লিরিকস এবং অ্যালবাম আর্ট সবকিছুই তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) দ্বারা- যা অসহায়ভাবে প্রমাণ করে দিচ্ছে যে শিল্প এবং প্রযুক্তির মধ্যকার রেখা কতটা দ্রুত ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। Suno এবং Udio-এর মতো শক্তিশালী এআই গান জেনারেটরগুলোর উত্থানের ফলে এখন যে কেউ কেবল কয়েকটি নির্দেশ (প্রম্পট) ব্যবহার করেই গান তৈরি করতে পারছে। কিন্তু একজন শ্রোতা হিসেবে আপনি যা শুনছেন, তা কি ১০০ শতাংশই মানুষের সৃষ্টি, নাকি যন্ত্রের কেরামতি- তা জানবেন কীভাবে? যদিও প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে শুধু শুনেই পার্থক্য করা কঠিন, তবুও কিছু গোয়েন্দাগিরি আর টুল ব্যবহার করে এর রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব।
পর্দার আড়ালের রহস্য : শিল্পীর ব্যাকগ্রাউন্ড
একটি নতুন গান যখন আপনার মনে সন্দেহ জাগায়, তখন প্রথম কাজটি হলো শিল্পী বা ব্যান্ডের সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া। এটি অনেকটা সনাতন গোয়েন্দাগিরির মতো। স্ট্রিমিং পরিষেবা Deezer-এর গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের প্রধান ম্যানুয়েল মুসাল্লামের মতে, ‘‘সবচেয়ে স্পষ্ট সূত্রগুলো আসে ‘বাহ্যিক কারণগুলো’ থেকে।’’ ব্যান্ডটির কি কোনো সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট আছে? তাদের সামাজিক উপস্থিতির অভাব ইঙ্গিত দিতে পারে যে বাস্তবে তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। যদি তাদের অনলাইন উপস্থিতি থাকে, তবে তারা কী ধরনের কনটেন্ট পোস্ট করে আসছে এবং কতদিন ধরে সক্রিয়, তা পরীক্ষা করুন। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন : শিল্পী বা ব্যান্ডটির কি বাস্তব? তাদের কনসার্ট আসন্ন? অতীতে হওয়া কনসার্টের ভিডিও ফুটেজ ইউটিউবে আছে? তারা কি অ্যালবাম প্রকাশ করেছে? এসব প্রশ্নের উত্তর ‘না’ হলে সতর্ক হোন। এ ছাড়া, গান নির্মাতারা প্রায়শই (তবে সবসময় নয়) তাদের তৈরি সুরগুলো সরাসরি Suno বা Udio প্ল্যাটফর্মে প্রকাশ করেন। এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে গিয়ে ট্র্যাকের নাম বা নির্মাতার হ্যান্ডেল দিয়ে সার্চ করলে আসল উৎসটি খুঁজে পাবেন।
এআই ট্যাগ এবং গান স্ক্যানার ব্যবহার
স্ট্রিমিং জালিয়াতি এবং স্বচ্ছতার অভাব মেটাতে এখন কিছু স্ট্রিমিং পরিষেবা নিজেরাই পদক্ষেপ নিচ্ছে। Deezer সম্প্রতি এআই-তৈরি গান থাকা অ্যালবামগুলোতে ‘AI-generated content’ লেবেল দিয়ে ফ্ল্যাগ করা শুরু করেছে। কোম্পানির সিইও জানিয়েছেন, এই সিস্টেমটি এআই গান জেনারেটর দ্বারা তৈরি সব অডিওতে থাকা সূক্ষ্ম কিন্তু শনাক্তযোগ্য প্যাটার্নগুলো খুঁজে বের করতে অভ্যন্তরীণ প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি, কারণ তারা দেখছে যে প্রতিদিন তাদের প্ল্যাটফর্মে আপলোড হওয়া গানের ১৮% পর্যন্ত এআই-তৈরি হতে পারে। এ ছাড়াও, অনলাইনে কিছু তৃতীয় পক্ষের পরিষেবা বা গান স্ক্যানার পাওয়া যায়, যা গানটি মানুষের তৈরি নাকি এআই দ্বারা তৈরি, তা নির্ধারণের প্রতিশ্রুতি দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ফরাসি সংগীত ও শব্দ গবেষণা ইনস্টিটিউট IRCAM Amplifz-এর অনলাইন ডিটেক্টরে গান আপলোড করে এআই দ্বারা তৈরির সম্ভাবনা ৮১.৮% থেকে ৯৮% পর্যন্ত দেখানো সম্ভব হয়েছে। যদিও এই ডিটেক্টরগুলো ভুল করতে পারে, তবুও এগুলো একটি প্রাথমিক ধারণা দিতে পারে। তবে অসুবিধা হলো, IRCAM-এর টুলটিতে গানের লিঙ্ক সরাসরি পেস্ট করা যায় না, যার কারণে কেবল স্ট্রিমিংয়ে থাকা গান পরীক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
লিরিকস বা গানের কথা বিশ্লেষণ
এআই গানের সরঞ্জামগুলো মিউজিক এবং লিরিকস উভয়ই তৈরি করতে পারে। অনেক পেশাদার ব্যবহারকারী নিজেরা লিরিকস লিখতে পছন্দ করেন, কারণ তারা দেখেছেন যে এআই-তৈরি গানের কথা প্রায়শই দুর্বল হয়। তাই খারাপ রাইমিং স্কিম বা অতিরিক্ত পুনরাবৃত্তিমূলক লিরিক্যাল কাঠামো গানটি মানুষের তৈরি নয় এমন একটি সংকেত হতে পারে। ফিলাডেলফিয়া-নিবাসী লুকাস রামস, যিনি তার এআই ব্যান্ড Sleeping with Wolves-এর জন্য Suno ব্যবহার করেন, তিনি জানান যে এআই টুলটি তার গানের কথায় কিছু নির্দিষ্ট শব্দ বারবার ব্যবহার করে, যেমন ‘neon,’ ‘shadows,’ বা ‘whispers।’ তিনি বলেন, যদি কোনো গানে এই শব্দগুলো অতিরিক্ত থাকে, তবে তা ‘নিশ্চিত সংকেত’ হতে পারে যে এটি এআই দ্বারা তৈরি।
এ পরিস্থিতিতে শিল্পীদেরই তাদের শ্রোতাদের কাছে আরও স্বচ্ছ থাকা উচিত- এমনকি তাদের সৃষ্টিকর্মের (গানের) উৎস কী, তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা উচিত।
তথ্যসূত্র : অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)