বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যসেবা খাতে কর্মীর তীব্র সংকট চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর মতে, ২০৩০ সাল নাগাদ সারা বিশ্বে ৪৫ লাখ নার্সের ঘাটতি দেখা দেবে। বর্তমানে এক-তৃতীয়াংশ নার্স কর্মক্ষেত্রে মানসিক অবসাদে ভুগছেন, ফলে এই পেশায় কর্মীদের ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে সমস্যার সমাধান হিসেবে এসেছে নুরাবট (Nurabot)।
কী এই নুরাবট?
নুরাবট হলো একটি স্বয়ংক্রিয়, এআই-চালিত নার্সিং রোবট, যা নার্সদের দৈনন্দিন পুনরাবৃত্তিমূলক এবং শারীরিকভাবে কষ্টকর কাজে সাহায্য করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এর মধ্যে ওষুধ সরবরাহ, রোগীদের ওয়ার্ডে পথ দেখানো অথবা নমুনা আনা-নেওয়ার মতো কাজগুলো অন্তর্ভুক্ত। নুরাবটের নির্মাতা তাইওয়ানের বহুজাতিক কোম্পানি ফক্সকনের মতে, এই হিউম্যানয়েড রোবট নার্সদের কাজের চাপ ৩০% পর্যন্ত কমাতে পারে। ফক্সকনের ইউজার ডিজাইন ডিরেক্টর অ্যালিস লিন বলেন, ‘এটি নার্সদের প্রতিস্থাপন নয়, বরং তাদের সঙ্গে একটি অভিন্ন লক্ষ্য পূরণের জন্য কাজ করবে। ফলে নার্সরা রোগীদের যত্নের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে বেশি মনোযোগ দিতে পারবেন।’
প্রযুক্তির সমন্বয় ও দ্রুত উন্নয়ন
মাত্র ১০ মাসের মধ্যে তৈরি করা হয়েছে নুরাবট। এর হার্ডওয়্যার তৈরিতে ফক্সকন জাপানের রোবোটিক্স কোম্পানি কাওয়াসাকি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজর সঙ্গে অংশীদারি করেছে। নুরাবট চলাচলের জন্য চাকা ব্যবহার করে এবং এর দুটি রোবোটিক হাত দিয়ে জিনিসপত্র ওঠা-নামা করতে পারে। একাধিক ক্যামেরা ও সেন্সরের সাহায্যে এটি এর চারপাশের পরিবেশ চিনতে পারে। নুরাবটের যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য ফক্সকনের নিজস্ব চীনা লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল ব্যবহার করা হয়েছে। আর এর মূল এআই এবং রোবোটিক্স পরিকাঠামো তৈরি করেছে মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্ট এনভিডিয়া। এনভিডিয়া একাধিক এআই প্ল্যাটফর্ম একত্রিত করে এমন প্রোগ্রামিং তৈরি করেছে, যা রোবটটিকে হাসপাতালে স্বাধীনভাবে চলাচল, কাজগুলোর সময়সূচি তৈরি এবং মৌখিক ও শারীরিক নির্দেশনায় সাড়া দিতে সক্ষম করেছে। ভার্চুয়াল পরিবেশে রোবটটিকে প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষা করা হয়েছে, যার ফলে এর উন্নয়ন প্রক্রিয়া দ্রুত হয়েছে। এনভিডিয়ার ডেভিড নিউওলনি বলেন, এআই নুরাবটকে মানুষের মতো ‘উপলব্ধি করতে, যুক্তি দিয়ে বুঝতে এবং কাজ করতে’ সাহায্য করে, যাতে এটি নির্দিষ্ট রোগী ও পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে।
সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ
বিশ্বের প্রবীণ জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ২০৩০ সাল নাগাদ ৬০ বছরের বেশি বয়সিদের সংখ্যা ৪০% বাড়বে। হংকংয়ের টুং ওয়াহ কলেজের অধ্যাপক রিক কোয়ান বলেন, এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় এআই-সহায়তাযুক্ত সিস্টেমগুলো সময় এবং খরচ কমাতে পারে। তবে চ্যালেঞ্জও রয়েছে। কোয়ান মানুষের সঙ্গে সরাসরি মিথস্ক্রিয়ার প্রতি রোগীদের পছন্দের কথা তুলে ধরেন। এ ছাড়া হাসপাতালের অবকাঠামোগত পরিবর্তনও বড় চ্যালেঞ্জ। কোয়ান বলেন, ‘হংকংয়ের হাসপাতালগুলো খুব ভিড় ও সংকীর্ণ, যা রোবট চলাচলের জন্য উপযুক্ত নয়।’ তাই রোবটকে কার্যকর করতে হলে হাসপাতালের নকশা নতুন করে ভাবতে হবে। নিরাপত্তাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর মধ্যে শুধু শারীরিক ঝুঁকি কমানো নয়, নৈতিক এবং ডেটা সুরক্ষার প্রোটোকলও অন্তর্ভুক্ত। তাই তিনি ধীর ও সতর্ক পদ্ধতি গ্রহণের পরামর্শ দেন।
এর আগে সার্জিক্যাল রোবট কয়েক দশক ধরে ব্যবহৃত হলেও নুরাবটের মতো মুক্তভাবে চলাচলকারী রোবট হাসপাতালের কর্মীদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে নতুন। সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি জেনারেল হাসপাতালে বর্তমানে ৮০টিরও বেশি রোবট প্রশাসনিক কাজ থেকে শুরু করে ওষুধ সরবরাহে সাহায্য করছে।
যুক্তরাষ্ট্রেও ‘মক্সি’ নামের ১০০টি রোবট হাসপাতালে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে নার্সিং রোবটগুলো কতটা কার্যকর তা নিয়ে এখনো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, নার্সদের মধ্যে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি ও কাজের চাপ কমার ধারণা থাকলেও এর বাস্তব প্রমাণ এখনো সীমিত। প্রযুক্তিগত ত্রুটি, যোগাযোগের সমস্যা এবং প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। নুরাবট বর্তমানে তাইওয়ানের তাইচুং ভেটেরান্স জেনারেল হাসপাতালে পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। ফক্সকনের মতে, প্রাথমিক ফলাফল অনুযায়ী এটি নার্সদের দৈনন্দিন কাজের চাপ ২০-৩০% কমিয়ে দিচ্ছে। আগামী ২০২৬ সালের শুরুতে বাণিজ্যিকভাবে এটি বাজারে আসতে পারে।
তথ্যসূত্র : সিএনএন