স্বাস্থ্যসেবার ভবিষ্যৎ হলো-প্রযুক্তি। আর এই পরিবর্তনের কেন্দ্রে রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। অপেক্ষার সময় কমানো, দ্রুত রোগ নির্ণয়, কার্যকর চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করা কিংবা রোগীর সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ; সব ক্ষেত্রেই এআই স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবায় ‘এআই’ শুধু সহায়ক প্রযুক্তি নয়, বরং এ খাতের অংশ হয়ে উঠবে।
‘এআই’ স্বাস্থ্যসেবায় কীভাবে কাজ করছে
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আসলে ডিপ লার্নিং, মেশিন লার্নিং, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং এবং ডেটা বিশ্লেষণের সমন্বিত ফল। এই প্রযুক্তি বিশাল ডেটাসেট বিশ্লেষণ করে এমন সব প্যাটার্ন শনাক্ত করে, যা মানুষের চোখে ধরা পড়ে না। ফলে চিকিৎসকরা আরও নির্ভুলভাবে রোগ নির্ণয় করতে পারেন, সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং রোগীর চিকিৎসা হয় আরও কার্যকর। ফরচুন বিজনেস ইনসাইটসের পূর্বাভাস বলছে, ২০৩২ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবায় ‘এআই’র বাজার ৪৯০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।
রোগ নির্ণয় থেকে ওষুধ আবিষ্কার
‘এআই’ এখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের নানান ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, মেডিকেল ইমেজিং-যেখানে এমআরআই, সিটি স্ক্যান বা এক্স-রে থেকে দ্রুত সন্দেহজনক চিহ্ন শনাক্ত করতে এআই রেডিওলজিস্টদের সহায়তা করছে। ওষুধ আবিষ্কার ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে এআই গবেষণার সময় ও খরচ উভয়ই কমিয়ে আনছে। জিনোমিক্স, জীবনযাত্রার তথ্য ও পূর্ববর্তী চিকিৎসা ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে ব্যক্তিগত চিকিৎসার পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে, যা চিকিৎসা সেবাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে।
রোগীর সম্পৃক্ততা বাড়াতে ‘এআই’
স্বাস্থ্যসেবার বড় চ্যালেঞ্জ-রোগীদের সম্পৃক্ত রাখা। এআই-চালিত টুলগুলো রিয়েল টাইমে রোগীর স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করে এবং প্রয়োজনে সতর্কসংকেত পাঠায়। ফলে দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত রোগীরাও সঠিক সময়ে চিকিৎসা পেতে সক্ষম হন। সঙ্গে এআই-চালিত টেলিহেলথ সেবা রোগীদের ঘরে বসেই চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ দিচ্ছে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া, রিপোর্ট শেয়ার করা বা প্রাথমিক চিকিৎসা পাওয়ার মতো সাধারণ কাজগুলো অনেকটা স্বয়ংক্রিয়তায় হচ্ছে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্সের সফলতা
রোগ নির্ণয়ে ‘এআই’ আজকাল আস্থার নাম। এক্স-রে, সিটি-স্ক্যান কিংবা এমআরআই চিত্র থেকে অস্বাভাবিকতা শনাক্তে এআই দ্রুততর ও অধিক নিখুঁত। ফলে ক্যানসারের মতো রোগও প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ছে। শুধু তাই নয়, কোন রোগী কোন ওষুধে ভালো প্রতিক্রিয়া দেখাবে, তা-ও এআই আগেভাগেই পূর্বাভাস দিতে পারে। এমনকি আজকের পৃথিবীতে ওষুধ আবিষ্কারেও ‘এআই’ দারুণ দক্ষতার প্রমাণ রাখছে। সাম্প্রতিককালে গবেষণাগারে নতুন যৌগ আবিষ্কার থেকে শুরু করে কার্যকারিতা যাচাই-সব ধাপেই ‘এআই’ গতিকে বাড়াচ্ছে। একই সঙ্গে রোগীর জিনগত গঠন ও জীবনযাত্রা বিশ্লেষণ করে তৈরি করছে ব্যক্তিগত চিকিৎসা পরিকল্পনা। ফলে চিকিৎসা হচ্ছে আরও কার্যকর ও নিরাপদ
স্বাস্থ্যসেবায় এআই যেন এক সমাধান
গ্রামীণ অঞ্চলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাওয়া কঠিন। কিন্তু এআই-চালিত টেলিহেলথ সেবা এবং মোবাইল স্ক্রিনিং কিটের কারণে এখন দূরবর্তী এলাকারও সঠিক চিকিৎসা পৌঁছে যাচ্ছে। ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে চিকিৎসার নির্দেশনা অনুবাদ করা সম্ভব হচ্ছে, যা স্বাস্থ্যসেবার বৈষম্য কমাচ্ছে।
নির্দিষ্ট চিকিৎসায় ‘এআই’র সফলতা
কার্ডিওলজি থেকে অনকোলজি-প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ‘এআই’র ব্যবহার বাড়ছে। হৃদরোগ শনাক্তকরণে এআই-চালিত ইসিজি বিশ্লেষণ আশ্চর্যজনক ফল দিচ্ছে। ক্যানসার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এআই অনেক সময় মানুষের চেয়ে বেশি নির্ভুল ফলাফল দিচ্ছে। ডার্মাটোলজিতে ত্বকের ক্ষত বিশ্লেষণ কিংবা অপথালমোলজিতে রেটিনাল স্ক্যানের মাধ্যমে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি শনাক্তকরণ-সব ক্ষেত্রেই এআই স্বাস্থ্যসেবাকে আরও নির্ভরযোগ্য করে তুলছে।
ডেটা ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন
স্বাস্থ্যসেবায় প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ ডেটা তৈরি হয়, যার অনেকটাই অব্যবহৃত থেকে যায়। ‘এআই’ সে ডেটাকে রিয়েল-টাইমে বিশ্লেষণ করে চিকিৎসক ও গবেষকদের কাজে লাগাতে সাহায্য করছে। ফলে রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা ও গবেষণার মান অনেক উন্নত হচ্ছে।
স্বাস্থ্যসেবায় ব্যবহৃত এআই
এমএল বা মেশিন লার্নিং রোগীর রেকর্ড থেকে প্যাটার্ন বের করতে পারে, ডিপ লার্নিং জটিল নিউরাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে জেনেটিক্স ও মেডিকেল ইমেজ বিশ্লেষণ করে, এনএলপি রোগীর রেকর্ড ও নোট থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বের করে আনে, আর আরপিএ প্রশাসনিক কাজ করে চিকিৎসকদের সময় বাঁচায়।
রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মী উভয়ের জন্যই এআই
এআই শুধু রোগীদের অভিজ্ঞতা উন্নত করছে না, বরং স্বাস্থ্যকর্মীদের চাপও কমাচ্ছে। জরুরি কেসগুলো দ্রুত শনাক্ত করা, অ্যাপয়েন্টমেন্ট শিডিউলিং থেকে বিলিং পর্যন্ত বিভিন্ন কাজ স্বয়ংক্রিয় করা, এমনকি রোগী-চিকিৎসক যোগাযোগ উন্নত করা-সবকিছুই এআই সহজ করছে। গবেষণায় প্রমাণিত, এআই ব্যবহারে হাসপাতালে থাকার সময়ও কমানো সম্ভব।
চ্যালেঞ্জও রয়েছে, তবে সমাধান খোঁজা হচ্ছে
ডেটার মান ও প্রাপ্যতা, উচ্চ পরিকাঠামোগত ব্যয়, বিদ্যমান আইটি সিস্টেমে এআই-এর সংযোগ এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রযুক্তির প্রতি অনীহা-এসবই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি রোগীর গোপনীয়তা রক্ষা এবং অ্যালগরিদমের পক্ষপাতহীনতা নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ। এজন্যই দরকার স্বচ্ছ উন্নয়ন, শক্তিশালী তদারকি এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চলা।
ভবিষ্যতের স্বাস্থ্যসেবা হবে এআই-নির্ভর
ভবিষ্যতে পরিধানযোগ্য ডিভাইসগুলো রোগীর শরীরের ক্ষুদ্র পরিবর্তন শনাক্ত করে চিকিৎসকদের সতর্ক করবে। এমনকি কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে ক্লিনিকে চেক-ইন করা যাবে, আর একই সঙ্গে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য প্রবণতা বিশ্লেষণেও এআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অর্থাৎ এআই শুধু চিকিৎসা ব্যবস্থাকে উন্নত করছে না, বরং বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবার কাঠামোতেও মৌলিক পরিবর্তন আনছে।