মঙ্গলবার, ৭ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

রমজানে বন্ধ হোক ভোজন উৎসব

বিশেষ প্রতিনিধি

রমজানে বন্ধ হোক ভোজন উৎসব

গত সন্ধ্যায় পশ্চিম আকাশে চাঁদের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে সংযমের মাস রমজান এসে গেল। এ দেশে সংযমের রমজান আসে অসংযমের নানা আয়োজন নিয়ে। বাহারি ইফতার থেকে শুরু করে লাগামহীন কেনাকাটা, মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতা, বাজারে উপচে পড়া ভিড়, শেষ রাতের সাহরি পার্টি, টেলিভিশন চ্যানেলে নানা অনুষ্ঠানের ভিড়ে শেষ পর্যন্ত সংযমের রমজানটাই আড়ালে চলে যায়। মাসজুড়ে মুসলমানদের জন্য রোজা পালন করার কথা বলা হয়েছে মূলত সংযম শেখানোর জন্য। কথা, জীবনাচরণ ও খাদ্যে সংযমের মধ্য দিয়ে স্রষ্টার আরও সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই এ সিয়াম সাধনা। কিন্তু বাংলাদেশে রোজা এখন বাণিজ্যেরও বড় উপলক্ষ। অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতে রোজার সময় দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসের দাম কমে। বাংলাদেশে দাম বেড়ে চলে যায় নাগালের বাইরে। ব্যবসায়ীরা সারা বছর অপেক্ষা করেন কখন রমজান আসবে, মুনাফার পালে লাগবে হাওয়া। পাঁচ তারকা হোটেল থেকে শুরু করে পাড়ার ছোট্ট দোকানটিও ইফতারির বাহারি পসরা সাজিয়ে বসে। যেন রোজা মানেই খাওয়ার অশেষ আয়োজন! সারা দিন খাওয়া হবে না বলে রোজার সময় সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় খাওয়ার পালা। সন্ধ্যায় ইফতারির পর শুরু হয় রাতের খাওয়ার আয়োজন। সারা দিনের উপবাসের প্রস্তুতির জন্য ভোররাতের খাওয়াটাও হয় ব্যাপক। কয়েক বছর ধরে রাজধানীতে শুরু হয়েছে সাহরি পার্টি। ঢাকার বিত্তশালীরা সপরিবারে রেস্তোরাঁয় গিয়ে পার্টির আমেজে সাহরি খায়। অবশ্য আগে থেকে বুকিং দেওয়া না থাকলে সেই সাহরি পার্টিতেও জায়গা পাওয়া যায় না।  

বাণিজ্যিকীকরণের উৎকট আবরণে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে পবিত্র রমজান। রমজান যেন কেনাকাটারই মাস! খবরের কাগজগুলোতে পালা করে ছাপা হয় বাহারি ইফতারের সচিত্র খবর। টেলিভিশন চ্যানেলে বাজার ঘুরে ইফতারির নানা আয়োজন দেখানো হয়, ঈদের কেনাকাটার লাইভ সম্প্রচার করা হয়। ইফতারির নানা পদের রেসিপি নিয়েও অনুষ্ঠান থাকে। এগুলোর কোনোকিছুই রমজানের মৌলিক তাৎপর্যের সঙ্গে মানানসই নয়।

সংযমের মাস রমজানে খাদ্য উৎসবের উৎপীড়ন বন্ধ করা গেলে সুস্বাস্থ্যের বড় ভিত্তি হতে পারে এ মাসটি। ওজন কমাতে চাইলেও রোজা বা উপবাস খুব কার্যকরী। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ওজন কমাতে গিয়ে প্রতিদিন কঠোরভাবে খাবার নিয়ন্ত্রণের চেয়ে রোজার মতো সবিরাম উপবাস একটি ভালো বিকল্প। আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এজিংয়ের নিউরো সায়েন্স ল্যাবরেটরির প্রধান ড. মার্ক পি ম্যাটসনের গবেষণায় দেখা যায়, নিয়মিত ডায়েটিং করলে একজন মানুষের দেহে যে প্রভাবগুলো পড়ে রোজা বা উপবাসও সেই একই প্রভাব ফেলে। উপবাসের ফলে দেহে এমন কিছু প্রোটিন উৎসারিত হয় যেটা মস্তিষ্কের কোষগুলোকে অক্সিডেশনজনিত ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এবং স্নায়ুকোষের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। ফলে বয়সজনিত রোগ যেমন, অ্যালঝেইমার, হান্টিংটন বা পার্কিনসন্সের ঝুঁকি অনেকখানি কমে যায়। অনাহারের ফলে দেহে যে সাময়িক শক্তি সংকট হয় তা মস্তিষ্কের কোষগুলোকে প্রোটিন উৎপাদনে উৎসাহ দেয়, এমনকি নতুন ব্রেন সেলও জন্মায়।

রোজা রাখলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে। নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া মানে দেহকোষগুলোতে ইনসুলিনের স্থিতিশীল সরবরাহ। এ তৃপ্ত এবং অলস কোষগুলো তখন হয়ে যায় ইনসুলিন-রেজিস্ট্যান্ট। আর ডায়াবেটিসের লক্ষণ এটাই। কিন্তু মাঝে মাঝে খাওয়া-দাওয়া বাদ দিলে এ কোষগুলো আরও সংবেদনশীল হয়ে ওঠে এবং বিপাক করতে পারে দক্ষভাবে। ফলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চরক্তচাপ এবং হার্ট-অ্যাটাকের আশঙ্কাও কমে। এ ছাড়াও রমজানের উপবাস দেহে কোলেস্টেরল কমায়, স্ট্রেস কমায়, রক্তচাপ কমায়।

এবারের গ্রীষ্মে রমজানের সময়কাল হচ্ছে সাড়ে ১৪ ঘণ্টা থেকে ১৫ ঘণ্টা। এই দীর্ঘ সময় রোজা রাখার জন্য কিছু নিজস্ব প্রস্তুতি থাকা ভালো। দিনভর পানির তেষ্টা লাঘব করতে হলে ভোররাতে মাছ-মাংসসহ প্রোটিন না খাওয়াই ভালো। খাদ্য তালিকায় অতিরিক্ত প্রোটিন থাকলে দিনভর পানির কষ্ট পেতে হবে। খাবারে সবজির প্রাধান্য থাকলে সারা দিন পানির তেষ্টায় কষ্ট পেতে হবে না। অন্যদিকে ভাজাপোড়া ইফতার বাদ দিয়ে খেঁজুর পানির ইফতার শেষে রাতের খাবার খেলে রোজা রাখা বেশ অর্থবহ হতে পারে। সব মিলিয়ে এবারের রমজান থেকেই বন্ধ হোক প্রচলিত ভূঁড়িভোজনের উৎসব।

 

সর্বশেষ খবর